বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন

ডলারের অর্ধেকের বেশি ব্যয় হয় শিল্প খাতে

রাজ টাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৯ জুন ২০২২ ০৪:৩৫; আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪ ০৩:০৬

ছবি: প্রতীকি

দেশে আমদানিতে সবচেয়ে বেশি ডলার ব্যয় হয় শিল্প খাতে। শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আনতে ডলারের ৫৭ শতাংশ ব্যয় হয়। তবে একক পণ্য হিসাবে সবচেয়ে বেশি ডলার ব্যয় হয় জ্বালানি তেল আনার ক্ষেত্রে।

যা মোট আমদানির সাড়ে ৯ শতাংশ। দেশের শিল্প খাত থেকেই সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। এরপরই রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স। বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণ থেকে আসে মাত্র ৩ শতাংশ।

চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সম্প্রতি আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বাড়ায় ও রেমিট্যান্স কমায় বাজারে ডলারের সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কোন কোন খাতে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বাড়ানো যায় এবং কোন কোন খাতে কমানো যায় সে বিষয়টিও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। এর আলোকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়াতে ও ব্যয় কমাতে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বহুমুখী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আরও কিছু পদক্ষেপ অচিরেই নেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার যে সংকট চলছে তা মোকাবিলা করার জন্য প্রতিটি খাতে ব্যাকআপ বা শতভাগ প্রভিশন রাখতে হবে। অর্থাৎ যে ডলার খরচ হবে, তা যাতে কোনো না কোনো খাত থেকে আয় হয়। তাহলে বড় চাপ কমানো যাবে। এজন্য আমদানি ও বিদেশ ভ্রমণ খাতে ডলার ছাড়ে আরও কঠোর হতে হবে।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎস চারটি। এগুলো হচ্ছে- রপ্তানি আয়, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বৈদেশিক ঋণ। বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ের প্রধান খাত হচ্ছে দুটি। আমদানি ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ। এর বাইরে খুবই সীমিত আকারে ভ্রমণ, বিদেশে পড়াশোনা ও চিকিৎসা খাতে কিছু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়।

প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, প্রতিবছর গড়ে বাংলাদেশ ৭২০০ কোটি ডলারের কমবেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। এর বিপরীতে ব্যয় হয় সাড়ে ৬ হাজার কোটি ডলারের বেশি। বাকি থাকে ৭০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে একটি বড় অংশ যাচ্ছে ভ্রমণ, চিকিৎসা ও শিক্ষা খাতে। সামান্য কিছু থাকে তা যোগ হয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে।

এভাবেই রিজার্ভ বাড়ছে। করোনার পর হঠাৎ চাহিদা বেড়ে যাওয়া ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে আমদানি ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। ব্যয় বাড়লেও পরিমাণগতভাবে আমদানি কম হচ্ছে। যেভাবে আমদানি ব্যয় বেড়েছে, সেভাবে রপ্তানি আয় বাড়েনি। এদিকে রেমিট্যান্স কমে গেছে। এতে দেশের রিজার্ভে চাপ বেড়েছে। মোট আমদানি ব্যয়ের ৬০ শতাংশ মেটানো হয় রপ্তানি আয় দিয়ে।

বাকি ৪০ শতাংশ মেটানো হয় রেমিট্যান্স থেকে। অন্যান্য ব্যয়ও রেমিট্যান্স থেকেই মেটানো হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চ পর্যন্ত আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৫৮ কোটি ডলার। জুলাই থেকে মে পর্যন্ত রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭১৭ কোটি ডলার। রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৯১৯ কোটি ডলার। বৈদেশিক বিনিয়োগ হিসাবে গড়ে আসে ২৬০ কোটি ডলার। ঋণ হিসাবে ২২০ কোটি ডলার। ঋণ পরিশোধ করতে হয় বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চে আমদানি ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ৫৮ কোটি ডলার। এর মধ্যে শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি। অর্থাৎ মোট আমদানি ব্যয়ের ৫৭ শতাংশের বেশি।

ওই সময়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানিতে খরচ হয়েছে ২ হাজার ২১৩ কোটি ডলার। যা মোট আমদানির ৩৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এর মধ্যে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করে সেগুলো দেশীয় কারখানায় পরিশোধন করে বাজারে বিক্রি হয়। এজন্য অপরিশোধিত ভোজ্যতেল শিল্পের কাঁচামাল হিসাবে গণ্য করা হয়।

চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চে ৩১ কোটি ডলারের অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের তৈলবীজ আমদানি হয়েছে ৫৫ কোটি ডলারের। গার্মেন্ট শিল্পের অন্যতম কাঁচামাল টেক্সটাইলের কাপড় আমদানি হয়েছে ৮১৯ কোটি ডলারের। দেশীয় বস্ত্র শিল্পে তুলা থেকে সুতা উৎপাদন করা হয়।

সেই তুলা আমদানি হয়েছে ২৫ কোটি ডলারের। সুতা থেকে কাপড় তৈরি করে সেগুলো রপ্তানি করা হয়। এমন সুতা আমদানি হয়েছে ২৪৬ কোটি ডলারের। পোশাক শিল্পেরই কাঁচামাল কোপরা ৩৯ কোটি ডলার, সিনথেটিক ফাইবার ১১৮ কোটি ডলার ও রাসায়নিক পণ্য ৫৭৫ কোটি ডলারের আমদানি হয়েছে।

শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল অর্থাৎ পুরো তৈরি পণ্য নয়, কিন্তু বিদেশে কাঁচামাল থেকে পণ্যের একটি মধ্যম রূপ দেওয়া হয়েছে। এগুলো দিয়ে দেশে পণ্য উৎপাদন করা হয়। এমন মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানি হয়েছে ৫৩৫ কোটি ডলারের। যা মোট আমদানির ৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ। এর মধ্যে কয়লা ৫১ কোটি ডলার, সিমেন্ট ১৬ কোটি ডলার, ক্লিংকার ও স্টোন ৭৯ কোটি ডলার, বিপি শিট ৯৫ কোটি ডলার, টিন প্লেট ৯১ লাখ ডলার, পুরনো জাহাজ ৯৮ কোটি ডলার, লোহা ও স্টিল স্ক্র্যাপ ১৪২ কোটি ডলার, বিভিন্ন মেটাল ২৭ কোটি ডলার, পেপার ও পেপার বোর্ড ২৪ কোটি ডলার, অন্যান্য কাঁচামাল ৮৭ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে।

শিল্পের কাঁচামালের মধ্যে রপ্তানি শিল্পের কাঁচামাল আমদানি হয় ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায়। গত মার্চ পর্যন্ত ৮৬৪ কোটি ডলার পণ্য আমদানি হয়েছে। যা মোট আমদানির ১৪ দশমিক ২৬ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা বেড়েছে ৬০ শতাংশ।

নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হয়। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়েছে ৩৮১ কোটি ডলারের। যা মোট আমদানির ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এর মধ্যে টেক্সটাইল যন্ত্রপাতি ৪২ কোটি ডলার, ট্যানারির যন্ত্রপাতি ১ কোটি ডলার, পাট খাতের ১ কোটি ডলার, গার্মেন্ট ৪৫ কোটি ডলার, ওষুধ ১৪ কোটি ডলার, প্যাকেজিং ৮০ লাখ ডলার ও অন্যান্য শিল্পের ৩০৫ কোটি ডলারের যন্ত্রপাতি আমদানি হয়েছে।

ওই সময়ে বিবিধ খাতের শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৩১১ কোটি ডলার। যা মোট আমদানির ৫ দশমিক ১৩ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য মেশিনারিজ ৮ কোটি ডলার, ডিজেল ইঞ্জিন ১৭ লাখ ডলার, কম্পিউটার ও যন্ত্রপাতি ৪৩ কোটি ডলার, মোটরসাইকেলের যন্ত্রপাতি ১৯ কোটি ডলার, বাইসাইকেলের পার্টস ১১ কোটি ডলার, লোহা ও স্টিল পণ্য ১৯ কোটি ডলার, মোটরসাইকেল ৫২ কোটি ডলার, অন্যান্য ইলেকট্রনিক সামগ্রী ১০ কোটি ডলার, ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলার ৪ কোটি ডলারের আমদানি হয়েছে।

বিলাসবহুল পণ্য আমদানি বেড়েই চলেছে। এর মধ্যে গাড়ির যন্ত্রাংশ ১৮ কোটি ডলার, নতুন গাড়ি ৫২ কোটি ডলার, ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী ১০ কোটি ডলার, অন্যান্য বাণিজ্যিক পণ্য ৩১০ কোটি ডলার ও ফল ৩৯ কোটি ডলারের আমদানি হয়। বিলাসবহুল মোট পণ্য আমদানি হয় ৪২৯ কোটি ডলারের। যা মোট আমদানির ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ।

বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৬৮৭ কোটি ডলার। যা মোট আমদানি ব্যয়ের ১১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। এর মধ্যে চাল ও গম আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ২০০ কোটি ডলার। যা মোট আমদানির ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। চিনি ও লবণ আমদানিতে খরচ হয়েছে ৭৮ কোটি ডলার। যা মোট আমদানির ১ দশমিক ২৯ শতাংশ। গুঁড়োদুধ আমদানিতে খরচ হয়েছে ২৬ কোটি ডলার।

যা মোট আমদানি ব্যয়ের শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ। এছাড়া পরিশোধিত ভোজ্যতেল ১০৬ কোটি ডলার, ফল ৩৯ কোটি ডলার, ডাল ২১ কোটি ডলার, পেঁয়াজ ১৪ কোটি ডলার, মসলা ২০ কোটি ডলার, পুরনো কাপড় ২১ লাখ ডলার, ওষুধ ৫৬ কোটি ডলার, অন্যান্য খাদ্য ১৩২ কোটি ডলারের আমদানি হয়েছে।

একক পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় জ্বালানি তেল। এতে খরচও বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ায় এর আমদানি ব্যয় দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে এ খাতে ব্যয় হয়েছে ৫৫৭ কোটি ডলার।

যা মোট আমদানির ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। এর মধ্যে অপরিশোধিত তেল আমদানি হয়েছে ১০০ কোটি ডলারের। যা মোট আমদানির ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। পরিশোধিত তেল ৪৪৬ কোটি ডলারের। যা মোট আমদানির ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

অন্যান্য খাতে ওই সময়ে পণ্য আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৩০ কোটি ডলারের। যা মোট আমদানির ১৭ শতাংশ। এর মধ্যে বাণিজ্যিক পণ্য ৩১০ কোটি ডলারের। যা মোট আমদানির ৫ দশমিক ১২ শতাংশ। শিল্প খাতে ব্যবহারের পণ্য আনা হয়েছে ৭১৫ কোটি ডলারের।

এর বাইরে বৈদেশিক ঋণের আওতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ৮১ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করা হয়েছে। যা মোট আমদানির ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ওই প্রকল্পের জন্য ৭১৭ কোটি ডলার আমদানির অপেক্ষায় রয়েছে। যা মোট আমদানির ১১ দশমিক ৮০ শতাংশ।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top