হারিয়ে যাচ্ছে গরুর গাড়ি

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ২৬ জুলাই ২০২২ ০৪:৫১; আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৭:২৪

ছবি : সংগৃহীত

এক সময় পল্লী এলাকার জনপ্রিয় বাহন ছিল গরুর গাড়ি। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের জনপদে কৃষি ফসল বহন ও মানুষ বহনের নির্ভরযোগ্য বাহন ছিল দু-চাকার গরুর গাড়ি। যুগের পরিবর্তনে এই বাহন এখন হারিয়ে যাচ্ছে।

রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলা উপজেলার গ্রামবাংলার জনপ্রিয় গরুর গাড়ি এখন অধিকাংশ অঞ্চল থেকে বিলুপ্তির পথে। এখন এসব বাহন রূপকথার হয়ে স্থান পেয়েছে বইয়ের পাতায়।

মাঝেমধ্যে প্রত্যন্ত এলাকায় দু-একটি গরুর গাড়ি চোখে পড়লেও শহরাঞ্চলে একেবারেই দেখা যায় না। সে কারণে শহরের ছেলেমেয়েরা দূরের কথা, বর্তমানে গ্রামের ছেলেমেয়েরাও গরুর গাড়ির শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়।

যুগ যুগ ধরে কৃষকের কৃষি ফসল বিপণন ও বহনের গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে ব্যবহার হতো গরুর গাড়ি।

গরু গাড়ি দুই চাকাবিশিষ্ট গরু বা বলদে টানা এক প্রকার বিশেষ যান। এ যানে সাধারণত একটি মাত্র অক্ষের সাথে চাকা দুটি যুক্ত থাকে। গাড়ির সামনের দিকে একটি জোয়ালের সাথে দুটি গরু বা বলদ জুটি মিলে গাড়ি টেনে নিয়ে চলে।

সাধারণত চালক বসেন গাড়ির সামনের দিকে। আর পেছনে বসেন যাত্রীরা। বিভিন্ন মালপত্র বহন করা হয় গাড়ির পেছন দিকে। বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য ও ফসল বহনের কাজে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল ব্যাপক। গ্রাম বাংলায় ঐতিহ্যগতভাবে গরুর গাড়ি এক দশক আগেও যাতায়াত ও মালবহনের কাজে ব্যবহৃত হতো।

অনুমান করা হয়, খ্রিস্টজন্মের এক হাজার ৬০০ থেকে এক হাজার ৫০০ বছর আগেই সিন্ধু অববাহিকা ও ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে গরুর গাড়ির প্রচলন ছিল, যা সেখান থেকে ক্রমে ক্রমে দক্ষিণেও ছড়িয়ে পড়ে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন জনপ্রিয় উপন্যাসেও দক্ষিণ আফ্রিকার যাতায়াত ও মালবহনের উপায় হিসেবে গরুর গাড়ির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘এইচ রাইডার হ্যাগার্ড’-এর বিখ্যাত উপন্যাস ‘কিং সলোমনস মাইনস’ নামক উপন্যাসেও গরুর গাড়ি সম্বন্ধে বর্ণনা রয়েছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাতে রাতে বিশ্রাম নেয়ার সময় বা বিপদে পড়লে তারা প্রায় গরুর গাড়িগুলোকে গোল করে সাজিয়ে এক ধরনের দুর্গ গড়ে তুলে তার মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করত। চেঙ্গিস খানের নাতি বাতু খানের নেতৃত্বে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপে যে মোঙ্গল আক্রমণ চলে সেখানে তার প্রতিরোধে স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা গরুর গাড়ির ব্যবহার করা হয়েছিল।

দুই যুগ আগে গরুর গাড়িতে চড়ে বর-বধূ যেত। গরুর গাড়ি ছাড়া বিয়ে হতো না। বিয়ে বাড়ি বা মাল পরিবহনে গরুর গাড়ি ছিল একমাত্র পরিবহন বাহন। বরপক্ষের লোকজন বরযাত্রী ও ডুলিবিবিরা বিয়ের জন্য ১০ থেকে ১২টি গরুর গাড়ির ছাওনি (টাপর) সাজিয়ে শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ি আসা-যাওয়া করত। রাস্তাঘাটে গরুর গাড়ি থেকে পটকাও ফুটাত।

যে সব পরিবারে গরুগাড়ি ছিল, তাদের কদরের সীমা ছিল না। কৃষকরা প্রতিদিন ফজরের আজানের আগে গরুর গাড়িতে কখনো জৈব সার তথা গোবরের সার, কখনো গরুর খাবার ও লাঙ্গল-মই-জোয়াল নিয়ে যেত মাঠে। গাইত উঁচু সুরে গাইত, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, কত রবো আমি পন্থের বিধি...’।

গরুর গাড়ির চালককে বলা হয় গাড়োয়ান বা গাড়িয়াল। আর তাই চালক উদ্দেশ্য করে বলত, ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই, আস্তে বোলাও গাড়ি, আরেক নজর দেখিবার নাও মুই দয়ার বাপের বাড়িরে গাড়িয়াল’। ৫০ থেকে ৬০ কিলোমিটারের রাস্তা পাড়ি দিয়ে কৃষকেরা জমি চাষাবাদ এবং মালামাল বহনের জন্য গরুর গাড়ি বাহন হিসেবে ব্যবহার করত।

অনেক অঞ্চলে রাস্ত পাকা না থাকায় এক সময় যান্ত্রিক যানবাহন চলাচল করত না। ফলে গরুর গাড়িই ছিল একমাত্র ভরসা। তবে বর্তমানে নানা ধরনের মোটরযান চলাচলের কারণে অপেক্ষাকৃত ধীর গতির এই যানটির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে। তাই এখন আর তেমন চোখে পড়ে না।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top