৩৪ বিলিয়ন ডলারের অনিষ্পন্ন আমদানি দায়, অর্থনীতিতে বড় চাপ

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ২২ আগস্ট ২০২২ ২০:৫৯; আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪ ১৪:৩৬

ছবি: সংগৃহিত

বৈদেশিক বানিজ্য নাজুক পরিস্থিতি সহসায় কমছে না বাংলাদেশের। নানা সমস্যায় জর্জরিত অবস্থা থেকে উত্তরণে বেগ হতে হচ্ছে। সহজেই স্বস্তি আসছে না এ খাতে। উন্নতি হচ্ছে না সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতিতেও। এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে গত অর্থবছরে খোলা রেকর্ড আমদানি ঋণপত্র (এলসি)। খবর বণিক বার্তার।

নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিলম্বিত হওয়া এলসি দায়ও বৈদেশিক বাণিজ্যে অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষ হয়েছে প্রায় ৩৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি অনিষ্পন্ন রেখে। রেকর্ড এসব অনিষ্পন্ন এলসি দেশের অর্থনীতির জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনিষ্পন্ন থাকা এলসির দায় দুই বছরের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে। একই সঙ্গে পরিশোধ করতে হবে নতুন করে খোলা এলসির দায়ও। এ অবস্থায় দেশের বাজারে চলমান ডলার সংকট সহসা কাটবে, এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং আগামী দিনগুলোয় অনিষ্পন্ন এলসির দায় খেলাপি হয়ে বিদেশে বাংলাদেশের ঋণমান অবনমনের ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ব্যাংকগুলোয় ৯২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন বা ৯ হাজার ২২৩ কোটি ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। একই সময়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৮৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি। চলতি বছরের ৩০ জুন অনিষ্পন্ন এলসির স্থিতি ছিল ৩৩ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২০-২১ অর্থবছর শেষ হয়েছিল ২৬ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার এলসি অনিষ্পন্ন রেখে। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে অনিষ্পন্ন এলসির স্থিতি ৭ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ তিন বছর মেয়াদি এলসি খোলা যায়। তবে বিশেষ বিবেচনায় মূলধনি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মূলধনি যন্ত্রপাতির বাইরে অন্য সব ধরনের এলসির সর্বোচ্চ মেয়াদ ৩৬০ দিন। ২০২০ সালের মার্চে দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। ওই সময় নীতিসহায়তা হিসেবে সব ধরনের এলসি দায় পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে গত দুই বছরে দেশের ব্যাংক খাতে বিপুল অংকের ডেফার্ড এলসি বা বিলম্বিত ঋণপত্র দায় তৈরি হয়েছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, যে ৩৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণপত্র অনিষ্পন্ন রয়েছে, তার অন্তত অর্ধেকই বিলম্বিত ঋণপত্র। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিসহায়তা হিসেবে ব্যবসায়ীরা যথাসময়ে ওইসব ঋণপত্রের দায় পরিশোধ করেননি। এখন বর্ধিত মেয়াদ শেষ হয়ে এলেও অনেক ব্যবসায়ী ঋণপত্রের দায় পরিশোধ করছেন না। আবার ডলারের বিনিময় হার অনেক বেড়ে যাওয়ায় অনেকে বর্তমান বাজারদরে ঋণপত্র পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করছেন। এ কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে দেশের অনেক ব্যাংকই খেলাপি হয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

যথাসময়ে এলসি দায় পরিশোধে ব্যর্থ হলে বিদেশের ব্যাংকগুলোর কাছে বাংলাদেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, রেকর্ড এলসি দায়ের পাশাপাশি বেসরকারি খাতে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের বিদেশী ঋণও রয়েছে। গত দুই বছর দেশের ব্যবসায়ীরা এলসি দায় সমন্বয়ের জন্য বাড়তি সময় পেয়েছেন। আবার ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রেও শিথিলতা ছিল। এখন যথাসময়ে এলসি দায় বা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতা দেশের ভাবমূর্তি সংকট তৈরি করবে। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে বাংলাদেশের ঋণমানের অবনমনও ঘটতে পারে। বিদেশী ঋণ ও বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আগামী বছরগুলোয় আরো বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি এলসি অনিষ্পন্ন রয়েছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতে। এ খাতে অনিষ্পন্ন এলসি দায়ের পরিমাণ ৩৮৪ কোটি ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অনিষ্পন্ন এলসি দায় সৃষ্টি হয়েছে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে। এ খাতে অনিষ্পন্ন এলসি দায়ের পরিমাণ প্রায় ৩৮১ কোটি ডলার। এছাড়া রাসায়নিক ও রাসায়নিক পণ্যের ১৯১ কোটি, শিল্পের ইন্টারমেডিয়েট গুডস বা মধ্যবর্তী পণ্যে ১৮৩ কোটি, কাঁচা তুলা ও কৃত্রিম তন্তুতে ১৫৫ কোটি, সুতায় ১৪৫ কোটি ও বিভিন্ন ধরনের শিল্প যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১১৮ কোটি ডলারের এলসি অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে। প্রধান খাদ্যপণ্যগুলোর মধ্যে গমে ৯৬ কোটি, চালে ১৩ কোটি, ভোজ্যতেলে ৫৩ কোটি ও চিনিতে ১৫ কোটি ডলারের এলসি অনিষ্পন্ন অবস্থায় রয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। সব মিলিয়ে ৩০ জুন পর্যন্ত দেশের অনিষ্পন্ন এলসির স্থিতি ছিল ৩ হাজার ৩৮৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই দেশের আমদানি প্রবৃদ্ধির লাগাম টেনে ধরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কঠোর বিধিনিষেধ আর ডলার সংকটে এলসি খোলা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। জুলাইয়ে ২ বিলিয়ন ডলার কমার পর চলতি আগস্টেও এলসি খোলা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। আমদানি কমলেও জুলাইয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে দেশের রফতানি খাত। ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহেও। এ অবস্থায় দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। ফলে ডলারের বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে আরো কঠোর হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই মধ্যে ছয়টি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধানকে অপসারণ করা হয়েছে। ডলারের বাজারে কৃত্রিম সংকট ও অস্বাভাবিক মুনাফা করায় ওই ছয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীকেও কারণ দর্শানোর নোটিস দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক যতই কঠোর হোক, দ্রুতই বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হবে না বলে মনে করেন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক সভাপতি আনিস এ খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই দেশে কৃত্রিম উপায়ে ডলারের বিপরীতে টাকার শক্তিশালী মান ধরে রাখা হয়েছিল। আমরা অনেক দিন ধরেই ডলারের দাম সমন্বয়ের দাবি জানিয়ে আসছিলাম। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটি আমলে নেয়নি। এখন দেখা যাচ্ছে, এক বছরের ব্যবধানে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়ন হয়েছে। তার পরও ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা ফেরেনি। যে পরিমাণ এলসি দায় অনিষ্পন্ন আছে, তাতে দ্রুতই ডলারের বাজার স্থিতিশীল হওয়ার সম্ভাবনাও কম।

রেকর্ড আমদানির ফলে ২০২১-২২ অর্থবছরে রেকর্ড বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। গত অর্থবছরে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। রফতানি আয়ের পাশাপাশি রেমিট্যান্স থেকে প্রাপ্ত ডলার দিয়ে আমদানি ব্যয় সমন্বয় করে বাংলাদেশ। তবে রেকর্ড আমদানির বছরে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ কমেছে। এ কারণে অর্থবছর শেষে সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। সব মিলিয়ে ব্যালান্স অব পেমেন্টে ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার ঘাটতি নিয়ে গত অর্থবছর শেষ হয়েছে।

বৈদেশিক বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করেছে। ২০২১ সালে রেকর্ড ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বর্তমানে ৩৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। আমদানি দায় পরিশোধ করার জন্য গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর কাছে ৭ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয়। আর চলতি আগস্টেও এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংক আরো প্রায় ৭০ কোটি ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। সংকট মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রায় প্রতিদিনই ডলার বিক্রি করা হলেও টাকার অবমূল্যায়ন থামছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষিত দর অনুযায়ী প্রতি ডলার ৯৫ টাকা হলেও খুচরা বাজারে ১২০ টাকা পর্যন্ত ডলার বিক্রি হয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর অবস্থানের কারণে সম্প্রতি তা ১১০ টাকার নিচে নেমে এসেছে।

মূল খবরের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top