10621

04/26/2024 রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রঙ্গরসিকতা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রঙ্গরসিকতা

রাজটাইমস ডেস্ক

৮ আগস্ট ২০২২ ০৭:১৮

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বেশ রসিক ছিলেন। সময়-সুযোগ পেলেই তিনি পরিচিত-অপরিচিত মানুষজনের সঙ্গে রঙ্গরসিকতায় মেতে উঠতেন। গতকাল ছিল ২২ শ্রাবণ কবির মৃত্যুবার্ষিকী। কবিগুরুর স্মরণে আজ থাকছে কবির কিছু রঙ্গরসিকতা।

জোড়াসাঁকো নয়
রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন শিলাইদহে পদ্মা নদীর ওপর বজরায় বাস করেন। নদীর চরের গায়ে পাশাপাশি বাঁধা দুটি বজরা। মনোরম পরিবেশ, সাহিত্যচর্চার জন্য এর থেকে ভালো জায়গা আর কী হতে পারে। দুটি বজরার একটিতে রবীন্দ্রনাথ, অন্যটিতে শান্তিনিকেতনের অধ্যাপক অজিতকুমার চক্রবর্তী থাকেন। অসুস্থ অজিতকুমার স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায় এসেছেন এখানে।

ঔপন্যাসিক চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই সময় শিলাইদহে আমন্ত্রণ জানান কবিগুরু। গুরুদেবের আমন্ত্রণ—তাই সঙ্গে সঙ্গেই এসে গেলেন চারুচন্দ্র। তার থাকার ব্যবস্থা হলো অজিতকুমারের বজরায়। অজিতকুমারের বজরায় নিজের জিনিসপত্র রেখে চারুচন্দ্র প্রণাম করতে এলেন গুরুদেবকে। গুরুদেব তখন মন দিয়ে একটি বই পড়ছিলেন। চারুচন্দ্রকে দেখে খুশি হলেন রবীন্দ্রনাথ। গুরুদেবকে প্রণাম করে চারুচন্দ্র অজিতকুমারের বজরায় যাওয়ার জন্য পা বাড়ালেন। পাশাপাশি দুটি বজরায় যাতায়াতের জন্য এক বজরা থেকে অন্য বজরা পর্যন্ত একটা লম্বা শক্তপোক্ত তক্তা পাতা। চারুচন্দ্র অজিতকুমারের বজরায় যাওয়ার জন্য সেই তক্তায় পা দিতেই রবীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ‘চারু, তক্তার ওপর দিয়ে খুব সাবধানে যেয়ো, মনে রেখো এটা জোড়াসাঁকো নয়, এক সাঁকো।’

হিংসা প্রবৃত্তি
শান্তিনিকেতনে কবিগুরুর ঘরে একদিন অধ্যাপক বিধুশেখর শাস্ত্রী ও অন্য কয়েকজন বসে হালকা গল্পগুজব করছিলেন। কবিগুরু তাঁদের কথাবার্তা মন দিয়ে শুনছিলেন। এমন সময় আচমকা কবিগুরু বিধুশেখর শাস্ত্রীকে বলে উঠলেন, ‘শাস্ত্রীমশাই, আপনি এত দিন যে বৌদ্ধশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেন; কিন্তু আপনার প্রতিহিংসা প্রবৃত্তি গেল না কেন। ’

শাস্ত্রীমশাই এ কথা শুনে অবাক। কী এমন অন্যায় হলো যে গুরুদেব এমন কথা বললেন। আকাশপাতাল ভেবে কিছুই বুঝতে না পেরে শাস্ত্রীমশাই বললেন, ‘গুরুদেব, আমার কী অপরাধ?’

এবার মুচকি হেসে রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীমশাইয়ের কামানো দাড়ি-গোঁফের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন, ‘এই দাড়ি-গোঁফগুলোকে ছেড়ে দিন, বাড়তে দিন, আর হিংসা করবেন না।’

রবীন্দ্রনাথের মুখে এই কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন বিধুশেখর শাস্ত্রী।

আহারে অভ্যাসবিরোধিতা
রবীন্দ্রনাথ কিভাবে খেতেন? তার থালার পাশে বাটিতে করে বিভিন্ন পদ সাজিয়ে দেওয়া হতো। খেতে বসে তিনি এটা থেকে কিছুটা, ওটা থেকে কিছুটা তুলে খেতেন। তার খাওয়া দেখে অনেকেই অবাক হতেন। বিশ্বভারতীর সেই সময়কার অধ্যাপক ও গ্রন্থ সম্পাদক নন্দগোপাল সেনগুপ্ত একদিন এই প্রথাগত রীতিবিরোধী খাবারের কথা তুলে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের সামনেই বলে বসলেন, ‘গুরুদেব, আপনি কি জানেন, বিদ্যাসাগর মশায়েরও আহারের ব্যাপারে আপনার মতো এই রকম অভ্যাসবিরোধিতা ছিল। তিনি আগে খেতেন দুধ, মিষ্টি, তার পর খেতেন তেতো। এ কথা জেনেছি বিহারীলাল সরকারের বই পড়ে। ’

রবীন্দ্রনাথ এ কথা শুনে রসিকতা করে বললেন, ‘নন্দ, তুমি দেখছি প্রত্নতাত্ত্বিকদের পিসেমশাই। খুঁজে খুঁজে ঠিক বারও করেছে। এত তো জানতামই না। তুমি কোনো দিন হয়তো আমার কথাও লিখে বসবে। তবে তাতে একটা সুবিধে হবে। কী সুবিধে জানো? লোকে বলবে—রবীন্দ্রনাথ আর বিদ্যাসাগরের অন্তত একটি বিষয়ে মিল আছে—আহারের সময় উভয়েরই বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পেত। ’

রবীন্দ্রনাথের এ কথা শুনে নন্দগোপাল হেসে উঠলেন। সেই সময় রবীন্দ্রনাথের খাস ভৃত্য এসে বলল, ‘গুরুদেব, আসুন, খাবার বেড়েছি—। ’

সাড়ে পাঁচটা
এক সাহিত্য সভায় যাওয়ার নিমন্ত্রণ পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, সভা শুরু হবে ঠিক সাড়ে ৫টায়। সময়কে প্রচণ্ড গুরুত্ব দিতেন গুরুদেব। কথা দেব অথচ কথা রাখব না—এটা তার পছন্দ ছিল না। উদ্যোক্তাদের তিনি জানিয়ে দেন সভার দিন যথাসময়ে পৌঁছে যাবেন। যথারীতি তিনি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে সেই সভায় উপস্থিত হলেন। কিন্তু এ কী কাণ্ড। দর্শকরা উপস্থিত, উদ্যোক্তারা কোথায়? তাদের কারোর দেখা নেই! রবীন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেন। কিন্তু তখনো উদ্যোক্তাদের কাউকে আসতে না দেখে অসন্তুষ্ট হয়ে তিনি একটি চিঠি লিখে রেখে ফিরে গেলেন। চিঠিতে লেখা ছিল—

‘এসেছিলেম, বসেছিলেম।

দেখলেম কেউ নেই।

আমার সাড়ে পাঁচটা জেনো।

পাঁচটা তিরিশেই। ’

কিছু পরে উদ্যোক্তারা এসে যখন চিঠিটি পড়লেন, তাদের চক্ষু চড়কগাছ!

 

সাঁওতাল মেয়ে
একদিন রবীন্দ্রনাথ উত্তরায়ণের বারান্দার এক কোণে চেয়ার-টেবিলে বসে মগ্ন হয়ে কবিতা লিখছিলেন। বাগানে একটি সাঁওতাল মেয়ে সেই সময় ঘাস পরিষ্কার করছিল। কাজ শেষ হলে বিকেলে মেয়েটি রবীন্দ্রনাথের পাশটিতে গিয়ে দাঁড়াল। মেয়েটিকে দেখে রবীন্দ্রনাথ লেখা থামিয়ে বললেন, ‘কী রে, কিছু বলবি?’

মেয়েটি এবার বলল, ‘হ্যাঁরে, তুর কি কুন কাজ নাই? সুকালবেলা যখন কাজে এলম, দেখলম তুই এখানে বসে কী করছিস! দুপুরেও দেখলম, এখানে বসে আছিস! এখন আবার সনঝেবেলা আমাদের ঘরকে যাবার সময় হয়েছে—এখনো তুই এখানে বসে আছিস! আচ্ছা, তুকে কি কেউ কুন কাজ দেয় নাই?’

মেয়েটির মুখে এই কথা শুনে রবীন্দ্রনাথ হেসে ফেললেন।

ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই গল্পটা শুনিয়ে বলতেন, ‘দ্যাখো, সাঁওতাল মেয়েটার কী বুদ্ধি দ্যাখো! আমার স্বরূপটা ও ঠিক ধরে ফেলেছে!’

পোকার উত্পাত
শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠার পর রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছাত্রদের পড়াতেন। একদিন ইংরেজি ক্লাসে তিনি বিখ্যাত ইংরেজ কবি শেলীর কবিতা পড়াচ্ছেন। শান্তিনিকেতনে গাছের তলায় মনোরম পরিবেশে পড়াশোনা হয়। গুরুদেব বসেছেন মাঝখানে। তার চারপাশে ছাত্রদল। সেই সময় হঠাত্ কিছু পোকার উত্পাত শুরু হলো। গুরুদেবের পরনে গা পর্যন্ত ঝোলা জোব্বা। তার গায়ে পোকা কাটতে পারছে না। কিন্তু অল্পবয়স্ক ছাত্রদের গায়ে পোকা কামড়াতে লাগল। স্বভাবতই তারা পোকার জ্বালায় অস্থির! পড়ায় মন লাগছে না, শুধু তারা গা-হাত-পা চুলকাতে লাগল! রবীন্দ্রনাথ কিছুই বুঝতে পারেন না কেন ছাত্রদল ও রকম করছে। তিনি জানতে চাইলেন, ‘কী হলো? আজ তোমরা এত অস্থির কেন?’

ছাত্রদলের মধ্য থেকে প্রমথনাথ বিশী উঠে বললেন, ‘গুরুদেব, যদি অভয় দেন তো বলি, কেন আমরা অস্থির!’

রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো বলো। ’

তখন প্রমথনাথ বললেন, ‘গুরুদেব, আপনি আমাদের শেলীর কবিতা পড়াচ্ছেন; কিন্তু এদিকে কিটস আমাদের বড়ই বিরক্ত করছেন!’

রবীন্দ্রনাথ সব বুঝে হেসে ফেললেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ একবার ক্ষিতিমোহন সেনসহ কয়েকজন ছাত্রকে ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের কবিতা পড়াচ্ছিলেন, সেদিনও পোকা-বিভ্রাট হয়েছিল!

বাঘ শিকারের গল্প
রবীন্দ্রনাথের কাছে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের মানুষ আসতেন। একদিন সন্ধ্যভবেলায় বিখ্যাত শিকারি কুমুদনাথ চৌধুরী এসেছেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। হাতে শিকারের বন্দুক। এসেই তিনি গুরুদেবের কাছে সগর্বে নিজের বাঘ শিকারের গল্প করতে লাগলেন। গল্পের মাঝে তিনি রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গুরুদেব, আপনি কখনো বাঘ শিকার করেছেন?’

গম্ভীর মুখে রবীন্দ্রনাথ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘বাঘ শিকার? তা এক-আধটা নয় ভাই, বোধ হয় গুনে শেষ করা যাবে না!’

এ কথা শুনে কুমুদনাথসহ অন্যরা অবাক। রবীন্দ্রনাথকে তারা কবি হিসাবেই জানেন। কিন্তু উনি যে একজন দক্ষ শিকারি, তার ওপর অনেক বাঘ মেরেছেন, তা তো কখনো শোনা যায়নি! রবীন্দ্রনাথের মুখে বাঘ শিকারের কথা শুনে একেবারে চুপসে গেলেন কুমুদনাথ। তিনি ভেবেছিলেন, নিজের বাঘ শিকারের কথা বলে একেবারে মাত করে দেবেন। কিন্তু এ কী হলো। তখন একজন নিচু স্বরে রবীন্দ্রনাথকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গুরুদেব, সত্যি সত্যিই আপনি বাঘ মেরেছেন?’

এবার রবীন্দ্রনাথ মুচকি হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি Bug বা ছারপোকার কথাই বলছি। না, কুমুদের মতো টাইগার আমি কখনো মারিনি।

এবারে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কুমুদনাথ এবং শুরু করলেন আরো নতুন নতুন বাঘ শিকারের গল্প।

সূত্র : বঙ্গ মনীষীদের রঙ্গরসিকতা, অংশুমান চক্রবর্তী।

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]