11395

03/28/2024 আরব অঞ্চলের সাথে প্রাচীন বাংলার সম্পর্ক

আরব অঞ্চলের সাথে প্রাচীন বাংলার সম্পর্ক

মহিব্বুল আরেফিন

১৬ অক্টোবর ২০২২ ০২:৪২

প্রথম পর্ব

আরব অঞ্চলের সাথে প্রাচীন বাংলার সম্পর্ক হাজার বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে বলে ধারণা করা হয়। আরব অঞ্চলের সাথে প্রাচীন বাংলার বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠার পেছনে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে কাজ করেছে বিস্তীর্ণ সমুদ্র পথ। এই পথ ধরেই উভয় দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সুদৃঢ় হয়।

ডক্টর মাহমুদুল হাসান ‘বাংলাদেশ ইসলামি দাওয়াহ এর সমস্যা ও সমাধান’ শিরোনামে এক গবেষণাপত্রে ঐতিহাসিক জেমস টেইলর এর মত উল্লেখ করে বলেন, ‘হজরত ঈসা (আ.) এঁর জন্মের কয়েক হাজার বছর আগে থেকে দক্ষিণ আরবের সাবা কওমের লোকেরা এ উপমহাদেশের পূর্ব-উত্তর এলাকায় পালতোলা জাহাজে করে আসতো। এর নিদর্শন তাদের প্রতিষ্ঠিত সাভার বন্দরের নামে রয়েছে। ‘সাবা’দের ‘উর’ বা নগর থেকে সাবাউর এবং তারই অপভ্রংশ হিসেবে পরবর্তীকালে এ বন্দর ‘সাভার’ নামে পরিচিত হয়েছে।’ ব্রহ্মপুত্র নদের পশ্চিম তীরের যে ‘তওক বন্দর’ শহর নসিরাবাদ-মুমিনশাহীর ১০/১৫ মাইল দক্ষিণ দিকে অবস্থিত, এখন এটিকে ‘টোক বন্দর’ বলা হয়। এটাও আরবদের দেয়া নাম। ধারণা করা হয় বন্দরটি তাদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত। কারণ ইদ্রীসী, সুলায়মান প্রমুখ আরব ভৌগলিকগণ ‘তওক’ বলে এর উল্লেখ করেছেন। আরবিতে গলার হারকে ‘তওক’ বলা হয়। লক্ষণ সেনের ভাওয়াল তাম্রশাসন বানহার নদী এখন বানার নামে পরিচিত। এ স্থলেই ‘হার বা তওকের’ মত বেঁকে গিয়ে ব্রহ্মপুত্রের কণ্ঠলগ্ন হয়েছে বলে আরবদের দ্বারা তখনকার এ পোতাশ্রয়টি তওক নামে প্রসিদ্ধ হয়।.

মানচিত্রে ইসলামের বিস্তার, ৬৩২ (খয়েরি অঞ্চল), ৬৬১ (কমলা) এবং ৭৫০ (হলুদ)

পঞ্চম শতকের শেষভাগে মক্কার কুরাইশ বণিকরাও নৌপথে বর্হিবাণিজ্যের সাথে সাথে ভারতীয় উপমহাদেশের উপকূল অঞ্চলে অবস্থিত প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোর আশপাশে তাদের স্থায়ী উপনিবেশ গড়ে তুলেন। দক্ষিণ-ভারতের মালাবার, কালিকট, চেরর এবং বাংলার চট্টগ্রাম ও আরাকান উপকূলে আরব জনগণের বসতি ইসলামপূর্ব কয়েক শতক আগে থেকেই গড়ে উঠে বলে অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। মাওলানা সৈয়দ সুলায়মান নদভী ‘আরব ও হিন্দকে তা‘আলুকাত’ নামক তাঁর গবেষণাগ্রন্থে বলেন, আরব দেশ থেকে বছরে অন্ততঃ দু’বার নৌবহর এসে নোঙর করত। ফলে বাণিজ্য-পণ্যের যেমন আদান-প্রদান হতো, তেমনি তথ্যেরও আদান প্রদান চলতো। ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন সিরাজ উত্তর বাংলা বুঝাতে ‘র্বরিহিন্দ’ লিখেছেন।

গবেষক মুফাখ্খারুল ইসলাম এর মতে, আরবরা জাহাজে করে বিশাল সাগরে মহাসাগরে ভাসতে ভাসতে দূর থেকে উত্তরবঙ্গের লালমাটি-ভূখণ্ড দেখে চিৎকার করে উঠতো ‘র্বারি হিন্দ’ বলে। ‘বার’ অর্থ স্থলভাগ। র্বারি হিন্দ অর্থ ‘হিন্দুস্থানের মাটি’। সেই থেকে এই অঞ্চল বররিন্দ বা বরিন্দ নামে পরিচিত হয়েছে। ঢাকা-টাঙ্গাইলের স্থল ভাগকে এখনো ‘ভর’ বলে। এই ‘ভর’ আরবি র্র্ব শব্দেরই একরূপ। বাংলার অন্যতম নদী বন্দর ভৈরবের নামও আরবদের দেয়া ‘বহর-ই-আব’। আরবিতে বাহর শব্দের অর্থ হলো সাগর বা নদী। আর আব মানে পানি। সুতরাং বহর-ই-আব মানে পানির সাগর। ‘বাংগালী যুগে যুগে’ গ্রন্থের লেখক নাজির আহমদ ‘কামরুত’ নামটি ‘কাওম-ই-হারুত’ থেকে উদ্ভূত বলে উল্লেখ করেন।’

ড. মোহাম্মদ হাননান ‘প্রাচীন বাংলায় মুসলিম আগমন’ গ্রন্থে উল্লেখিত ঘটনাটি ড.আ.ন.ম রইছ উদ্দিন ‘বাংলাদেশে ইসলামের আবির্ভাব, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, অক্টোবর-ডিসেম্বর: ১৯৮৭ এর সূত্র উল্লেখ করে বলেন, ইসলামের আবির্ভাবের বহুকাল পূর্ব থেকেই বাংলাদেশের সাথে আরবদের ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল। এমনকি হজরত ঈসা (আ.) এর জন্মের হাজার বছর পূর্বেও দক্ষিণ আরবের সাবা কওমের ব্যবসায়ীরা পাল তোলা জাহাজে করে এদেশে আসতো। উক্ত সাবা কওমের নামানুসারে নামকরণের শহর সাবাউর। (উর অর্থ শহর) সাবাউর অর্থাৎ সাবাদের শহর আজও ঢাকার অদূরে সাভার নামে পরিচিত হয়ে এ দেশে সাবা কওমের আগমন স্মৃতি বহন করছে।

ঈসায়ী ত্রয়োদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে.... উপমহাদেশের... প্রথম ইতিহাস লেখক মাওলানা মিনহাজুদ্দীন সিরাজ উত্তর বাংলাকে ‘র্বারি হিন্দ’ বলেছেন, যা পরে বরেন্দ্র নামে পরিচিত হয়েছে। এ অঞ্চলকে ‘র্বারি হিন্দ' বলার কারণ ছিল আরবরা বিশাল সমুদ্র, সাগর, মহাসাগর পাড়ি দিয়ে জাহাজে ভেসে ভেসে বহুদিন পর বঙ্গদেশে তদানিন্তন হিন্দের মাটি বা স্থল দেখে আনন্দে নেচে উঠে চিৎকার করে বলতো ‘র্বারি হিন্দ’ অর্থাৎ ‘হিন্দের মাটি'- যা পরবর্তীকালে ‘র্বারিহিন্দ’ বা ‘বরেন্দ্র’ নামে পরিবর্তিত হয়ে যায়।

সমুদ্র পথ নিয়ে নবি (সা.) এঁর বাণী
হজরত মুহম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাঁর পূর্ববর্তী যুগে আরব-হিন্দের যোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র মাধ্যম ছিলো সমুদ্রপথ। আর মহানবি হজরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রয়োজনে সমুদ্রপথ অতিক্রম করেও ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য সাহাবিদের নির্দেশ দান করেন। পবিত্র হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কা মুকাররমায় এক রাতে দাঁড়িয়ে তিনবার এই এরশাদ করেন, ‘হে আল্লাহ, আমি কি পৌঁছিয়ে দিয়েছি? হজরত ওমর (রা.) উঠে আরজ করলেন, জ্বি হ্যাঁ, (আমি আল্লাহ তায়ালাকে সাক্ষী রেখে বলছি যে, আপনি পৌঁছে দিয়েছেন।) আপনি লোকদের ইসলামের ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহ দিয়েছেন এবং সে বিষয়ে যথেষ্ট চেষ্টা এবং নসীহত করেছেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ইমান অবশ্যই এ পরিমাণ বিজয় লাভ করবে যে, কুফরকে তার ঠিকানায় ফিরিয়ে দেয়া হবে। আর নিঃসন্দেহে তোমরা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সমুদ্র সফরও করবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, বিদায় হজে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাফাত ময়দানে সমবেত সাহাবিদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যারা আজ এখানে উপস্থিত আছে তারা ঐ সমস্ত লোকদের কাছে পৌঁছিয়ে দেবে, যারা এখানে উপস্থিত নেই...।’ সুতুরাং নবি পাক এঁর আদেশ পালনে এবং আল্লাহ তায়ালার বাণী পৌঁছে দিতে সমুদ্রপথে সাহাবাগণ (রা.) এ উপমহাদেশে এসেছেন এটা সহজেই অনুমেয়।

 লেখক: মহিব্বুল আরেফিন, সূফী গবেষক।

সূত্র: ইসলামে সুফিবাদের ধারণা ও মধ্যযুগের ওলি-আউলিয়াদের ভূমিকা ।।

 

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]