11980

04/30/2025 দুই বছরে রাবির সাত শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা: নেপথ্যের কারণ

দুই বছরে রাবির সাত শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা: নেপথ্যের কারণ

রাবি প্রতিনিধি:

১১ নভেম্বর ২০২২ ০৮:০৪

গত ২ বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) সাত শিক্ষার্থীকে আত্মহত্যা করতে দেখা গেছে। শুধু রাবিতে নয় আত্মহত্যার এমন চিত্র বাংলাদেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। কিন্তু স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও তারা কেন বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথ?

গত ২৬ সেপ্টেম্বর বিয়ের তিন মাসের মাথায় সুইসাইড নোট লিখে স্বামীর বাসায় গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ছন্দা রায়। চুরাবালির মতো ডিপ্রেশন, বেড়েই যাচ্ছে, মুক্তির পথ নেই, গ্রাস করে নিচ্ছে জীবন, মেনে নিতে পারছি না।’ মৃত্যুর আগে এভাবেই নিজের হতাশার কথা লিখে যান রাবির ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী সাদিয়া তাবাসসুম। গত ১৩ মে দুপুরে নিজ ঘরে বাঁশের আড়ার সঙ্গে ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি।

৬ জুন স্বামীর সাথে অভিমান করে গলায় ফাঁস দিয়ে জান্নাতুল মাওয়া দিশা নামে নাট্যকলা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের আরো এক শিক্ষার্থী বেছে নেন আত্মহননের পথ। একই পথে হেঁটেছেন রাবির প্রাচ্যকলা ডিসিপ্লিনের সাবেক শিক্ষার্থী সোহাগ খন্দকার। ৯ এপ্রিল রাত সাড়ে ৩টায় গলায় গামছা পেঁচিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এই শিক্ষার্থী। তিনিও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। স্ট্যাটাসে লেখা ছিল, 'ভালো থাকুক সেসব মানুষ, যারা শুধু নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। যার কাছে অন্যের গুরুত্ব নাই বললেই চলে। জীবনের কাছে হার মেনে গেলাম। আমি আর পারলাম না। একটা মানুষ জীবনের কাছে যখন হেরে যায়, তখন আর করার কিছু থাকে না।’

প্রেমের সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ইশতিয়াক নামের রাবির আরো এক শিক্ষার্থী। ১৭ ফেব্রুয়ারি ভোর ৬টার পর নিজ বাসায় বিষপান করেন তিনি। ফেসবুকে লিখে যান আত্মহননের দীর্ঘসূত্রিতার একটি স্ট্যাটাস। জানা যায় প্রেমে ব্যর্থ হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। গেল বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ইমরুল কায়েস ও ১৯ ডিসেম্বর নৃবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী দেবজ্যোতি বসাক পার্থও বেছে নেন আত্মহত্যার মত ঘৃণ্য পথ। মায়ের সাথে অভিমান করে আত্মহত্যা করেন ইমরুল।

অলাভজনক সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত বছর অন্তত ১০১ জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ৬২ জন বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সংস্থাটি বলছে, এক বছরে এতো শিক্ষার্থী আগে কখনো আত্মহত্যা করেননি। ২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৯ জন। এর আগে, ২০১৮ ও ২০১৭ সালে আত্মহত্যা করা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১১ জন ও ১৯ জন। ২০২২ এর সংখ্যা খুবই হতাশাজনক।

স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েও তারা কেন বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার মতো জঘন্য পথ? এমন প্রশ্নের উত্তরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) কাউন্সিলিং সেন্টারের আহ্বায়ক ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নূর মোহাম্মদ বলেন, জীবনকে বাঁচিয়ে রাখা ও ধ্বংস করা এই দুই ধরনের সত্তা প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে। মানুষের অবস্থা যখন মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে যায় তখন সে নিজেকে আর বাঁচিয়ে রাখতে চায় না। তখন ধ্বংসকারী সত্তা জেগে ওঠে। ফলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক এই তিনটির যেকোনো একটি কারণে মানুষ আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকে যায়। তবে মানসিক কারণটা আত্মহত্যাকারীর মধ্যে প্রকট থাকে।

তিনি আরো বলেন, মানসিক বিষয়গুলোর উপরে বেশি ফোকাস করতে হবে। কেউ রাগী কেউবা আবেগী। যে যেমন তার সাথে তেমন ব্যবহার করতে হবে। এর জন্য পরিবারের মা-বাবা ভাই-বোন ও বন্ধুবান্ধবদের সজাগ থেকে তাদেরকে মানসিক সাপোর্ট দিয়ে যেতে হবে। জন্মের পর থেকে জীবনধারনের দক্ষতা চর্চার বিষয় পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা উচিত৷ যোগব্যায়াম, মননশীলতার অনুশীলন, চাপ ব্যবস্থাপনা, রাগ ব্যবস্থাপনা, সহানুভূতি, নিজের যত্ন নেওয়ার মতো বিষয়গুলো থাকা উচিত৷ মানসিক বেকারগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের বন্ধু-বান্ধবের সহায়তায় তাকে মানসিক সেন্টারে কাউন্সিলিং করার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) চিকিৎসা মনোবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি সহকারী অধ্যাপক ড. শরিফুল ইসলাম বলেন, পারিবারিক কলহ, প্রেমঘটিত জটিলতা, বেকারত্ব, নিঃসঙ্গতা, মানসিক চাপ, তীব্র বিষণ্নতা থেকে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারা আত্মহত্যার অন্যতম বড় কারণ। আবার আর্থিক সংকট আত্মহত্যার আরো একটা বড় কারণ সমাজে যখন প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়, মানুষের মনে চাপ বাড়ে, জীবন ধারণের চাপ বাড়ে, ফলে আত্মহননের পথ বেছে নেয়।

এটা থেকে উত্তরণের পরামর্শে তিনি বলেন, আত্মহত্যা এক ধরনের অপরাধ৷ কারণ একটা জীবনকে শেষ করে দেওয়া আমাদের দেশের সমাজ ও আইন সেটাকে বৈধতা দেয়নি৷ এটা থেকে উত্তরণের জন্য আত্মহত্যার উপর গবেষণা করে আত্মহত্যার নিখুঁত কারণগুলো বের করতে হবে। সব থেকে ভালো হয় যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে একটি প্রজেক্ট করা হয়। প্রজেক্টের কাজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের মধ্যে গবেষণা চালিয়ে কে কী সমস্যায় ভুগছে তা খুঁজে বের করে সেগুলো সমাধানের জন্য কাউন্সেলিং করা, সাইকোথেরাপি দেয়া ও মানসিক সাপোর্ট দেয়া।

#এনএ

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]