04/29/2025 বাংলাদেশে ‘আয়নাঘর’, সিরিয়ায় ‘মানব কসাইখানা’
রাজটাইমস ডেস্ক
১০ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:০৬
সিরিয়ার সদ্য ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দেশটিতে দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। এর পরপরই দেশটিতে একের পর এক ভয়ঙ্কর নির্যাতনের চিত্র উঠে আসছে। বিদ্রোহীদের দমনে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনমূলক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন আসাদ, যার মধ্যে অন্যতম ‘মানব কসাইখানা’।
সেখানে বন্দীদের নির্মম নির্যাতন করা হতো। আসাদের পতনের পর দেশটির বিভিন্ন কারাগার থেকে বন্দীদের মুক্তির দৃশ্য বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মুক্তির এই মিছিলে রয়েছে নারী ও শিশুরাও।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে সিরিয়ার ‘মানব কসাইখানা’ ও সেখানে ভয়ঙ্কর নির্যাতনের নিদর্শন। এরপর থেকে এটিকে তুলনা করা হচ্ছে বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের সময়কালে গড়ে ওঠা বন্দীশালা ‘আয়নাঘরের’ সঙ্গে।
বিদ্রোহীরা জানিয়েছে, তারা সিরিয়ার ভয়ংকর কারাগারগুলোর গোপন প্রকৃতি এবং সেখানে বন্দী অবস্থায় কাটানো অসংখ্য মানুষের দুর্দশার প্রমাণ তুলে সংগ্রহ করেছে। এ পর্যন্ত শতাধিক কারাগার শনাক্ত এবং সেখান থেকে অসংখ্য বন্দীকে মুক্ত করা হয়েছে।
বাশারের ‘মানব কসাইখানা’
সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ‘মানব কসাইখানা’ নামে পরিচিত সায়দনায়া কারাগারের অবস্থান। বাশারের পতনের পর কারাগারটিতে প্রবেশ করে বন্দীদের মুক্তি দেয় বিদ্রোহীরা।
একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, বন্দীরা আনন্দে চিৎকার করছে, যখন বিদ্রোহীরা তালা ভেঙে তাদের মুক্ত করে।
অন্য একটি ভিডিওতে একটি ছোট বাচ্চাকে কারাগারের সেল থেকে বের হতে দেখা গেছে, পাশে থাকা নারীরা আনন্দে কাঁদছেন।
সায়দনায়া কারাগারে লুকানো ভূগর্ভস্থ সেলের সন্ধান পাওয়ার খবর পেয়ে উদ্ধারকারী দল সেখানে অভিযান চালায়।
হোয়াইট হেলমেটস নামে পরিচিত উদ্ধারকারী সংস্থা জানিয়েছে, তারা পাঁচটি বিশেষজ্ঞ দল মোতায়েন করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে অনুসন্ধান ও উদ্ধার ইউনিট, প্রাচীর ভাঙার বিশেষজ্ঞ, লোহার দরজা খোলার টিম, প্রশিক্ষিত কুকুর ইউনিট এবং মেডিকেল টিম। তবে, এখনো কোনো লুকানো সেলের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
‘মানব কসাইখানা’ নামে পরিচিত বাশার আল-আসাদের কারাগারগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি হলো—তাদমর ও সেদনায়া। তাদমর কারাগারটি পালমিরার মরুভূমিতে এবং সেদনায়া কারাগার দামেস্কের উপকণ্ঠে অবস্থিত। এই দুটি ছিল সিরিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর কারাগার। ২০১৪ সালে ‘সিজার’ নামে পরিচিত সরকারি কর্মচারী সিরিয়া থেকে পালিয়ে আসেন। তিনি কারাগারগুলোতে বন্দী নির্যাতনের ওপর ৫৩ হাজার ২৭৬টি নথি প্রকাশ করেন।
নথিগুলো থেকে দেখা গেছে, অন্তত ৬ হাজার ৭৮৬ বন্দী সরকারি হেফাজতে মারা গিয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৭ সালে সেদনায়া কারাগারকে ‘মানব কসাইখানা’ বলে আখ্যা দেয়। সংস্থাটি জানায়, সেখানে হাজার হাজার মানুষকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে বা নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। অনেককে খাবার, পানি ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এরপর মৃতদেহগুলো গণকবরে ফেলে দেওয়া হয়েছে।
২০১১ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১ লাখ ৫৭ হাজার ৬৩৪ জন সিরিয়ানকে গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে ৫ হাজার ২৭৪ জন শিশু এবং ১০ হাজার ২২১ জন নারী। বাশারের বাবা হাফিজ আল-আসাদের শাসনামলেও বহু মানুষকে গোপনে অপহরণ করা হয়েছিল। হাফিজ ১৯৭১ সালে ক্ষমতায় আসেন এবং তার মৃত্যুর পর ২০০০ সালে ছেলে বাশার আল-আসাদ সিরিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
কারাগারে বন্দী ১ লাখ ৩৭ হাজার
বিদ্রোহীরা সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের কারাগারগুলো শনাক্ত করতে পারলেও সবাইকে এখনো মুক্ত করতে পারেনি। একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাব অনুসারে, বাশারের কারাগারে প্রায় ১ লাখ ৩৭ হাজার বন্দী ছিল। এদের মধ্যে অনেককে মুক্ত করা সম্ভব হলেও এখনো অসংখ্য মানুষ সিরিয়ার গোপন কারাগারে বন্দী। বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থা জানিয়েছে, সাবেক সৈন্য ও কারাগার রক্ষীদের কাছে গোপন দরজার পাসওয়ার্ড চেয়ে বন্দীদের মুক্ত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। অনেক বন্দী এখনো বৈদ্যুতিক দরজার পেছনে আটকে আছে বলে সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে।
সিরিয়ার মানবাধিকার সংস্থা হোয়াইট হেলমেটস বাশার আল-আসাদের গোপন কারাগারের খোঁজ দিতে উৎসাহিত করার জন্য আর্থিক পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। এটি এখনো স্পষ্ট নয় কারা কারাগারে রয়ে গেছে, তবে বিদ্রোহীরা এখন পর্যন্ত হাজার হাজার নারী, বৃদ্ধ এবং মধ্যবয়সী পুরুষকে মুক্তি দিয়েছে—যাদের মধ্যে অনেকেই জীবনের অধিকাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। এমনকি বিদ্রোহীরা ছোট ছোট শিশুদেরও খুঁজে পেয়েছে এসব কারাগারে।
বন্দীদের যেভাবে নির্যাতন করা হতো
বাশারের ‘মানব কসাইখানাগুলোতে’ বন্দীদের ওপর ভয়ঙ্কর ও অকল্পনীয় নির্যাতন চালানো হয়। তাদের চাবুক দিয়ে পেটানো, ঘুমাতে না দেওয়া, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করা, এমনকি নগ্ন করে ধর্ষণ করা হতো। পুরুষ ও নারী উভয়ের ওপরই এসব নির্যাতন চালানো হয়েছে।
এর পাশাপাশি তিনটি নির্যাতনের পদ্ধতি বিশেষভাবে কুখ্যাত ছিল, যা বন্দীদের শারীরিকভাবে ধ্বংস করে দিত। সিরিয়ার বন্দী শিবিরগুলো ছিল মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক ভয়ংকর উদাহরণ। এই অধ্যায়ের সমাপ্তি মানবতার জন্য একটি অতি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ।
কুখ্যাত তিন নির্যাতন পদ্ধতির একটিকে বলা হতো ‘জার্মান চেয়ার’। যেখানে কারারক্ষীরা বন্দীদের একটি বিশেষ ধরনের চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে চেয়ারটির পেছনের অংশকে এতটাই বাঁকিয়ে দিত যে, তাদের মেরুদণ্ড ভেঙে যেত। দ্বিতীয়টি ছিল ‘উড়ন্ত কার্পেট’। যেখানে দুই ভাগে বিভক্ত কিন্তু সংযুক্ত একটি কাঠের পাটাতনের একটি অংশে বন্দীর শরীরের ঊর্ধ্বাংশ বাঁধা হতো। অপর অংশে কোমরের নিচের অংশ বাঁধা হতো এবং এর পর নিচের অংশটি আস্তে আস্তে ওপরের দিকে তুলে আনা হতো। এই অবস্থায় বন্দীদের পা এবং বুক একপ্রকার সমান্তরালে চলে আসত এবং এর ফলে অসহ্য ব্যথা সৃষ্টি হতো। তৃতীয় পদ্ধতিতে বন্দীদের একটি মইয়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দাঁড় করিয়ে দিত কারারক্ষীরা। এরপর তারা মইটিকে ধাক্কা দিত, এর ফলে বন্দীরা পেছন দিকে পড়ে যেত। কারও কারও মেরুদণ্ড ভেঙে যেত, কেউ বা প্রচণ্ড অবর্ণনীয় ব্যথা পেতেন।
বাশারের ‘মানব কসাইখানা’ প্রসঙ্গে যা বলছে জাতিসংঘ
জাতিসংঘের সিরিয়া কমিশনের সমন্বয়ক লিনিয়া আর্ভিডসন বলেছেন, বাশার আল-আসাদের বন্দীশালার যে চিত্র পাওয়া যাচ্ছে তা ভয়ঙ্কর, তবে আশ্চর্যজনক নয়। ২০১১ সাল থেকেই জাতিসংঘের দল সিরিয়ার বন্দীশালাগুলোর বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে সাবেক বন্দীদের সঙ্গে কথা বলে। তবে এই প্রথমবার তারা সরাসরি বন্দীশালাগুলোতে প্রবেশের সুযোগ পেল। আন্ডারগ্রাউন্ড এসব বন্দীশালাগুলোতে কোনো জানালা নেই। বন্দীরা সেখানে সূর্যের আলো দেখা ছাড়াই বছরের পর বছর, দশকের পর দশক অতিবাহিত করেছে।
সাবেক বন্দীদের কাছ থেকে যে বর্ণনা পাওয়া গেছে, তার সঙ্গে বাস্তবের মিল পাওয়া গেছে বলেও জানান তিনি।
এদিকে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনে নেতৃত্ব দেওয়া সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী এইচটিএসের প্রধান জানিয়েছেন, আসাদ সরকারের আমলে যে সব কর্মকর্তা নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কর্তৃপক্ষ তাদের তালিকা করবে।
এছাড়া নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিষয়ে তথ্য দিলে পুরষ্কার দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
সূত্র: আল-জাজিরা, বিবিসি, রয়টার্স।