08/01/2025 জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী ছিল?
রাজটাইমস ডেস্ক:
৩০ জুলাই ২০২৫ ১২:১০
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গতবছর পাঁচ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়ে দেড় দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়, সেসময় রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রকাশ্যে দেখা না গেলেও পরবর্তী সময়ে এর কৃতিত্বের দাবি করতে দেখা গেছে।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান টুম্পা ৩১শে জুলাই নিজ প্রতিষ্ঠানের একজনকে বাঁচাতে প্রাণপণ চেষ্টা করেন এবং পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ভাইরাল হয়েছিলেন। খবর বিবিসি বাংলার।
তিনি বলেছেন, তিনি নিজের পাশে কোনো দল বা সংগঠন দেখেননি, আশপাশে সবাইকে সাধারণ শিক্ষার্থী, জনগণ ও সহযোদ্ধা হিসেবেই দেখেছেন যাদের কোনো দলীয় ট্যাগ ছিল না।
টুম্পা বলেন, এখন যদি কোনো দল এসে একপাক্ষিকভাবে বলে যে এর মাস্টারমাইন্ড আমরা ছিলাম, আমাদের এই ক্রেডিট ছিল, এটা সম্পূর্ণ আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। কারণ সেসময় আমার যে সহযোদ্ধা ছিল আমি দেখিনি তাকে বলতে যে আমি এই দলের বা ওই সংগঠনের, আমি এই লিড (নেতৃত্ব) দিচ্ছি। তখন সবাই লিড দিচ্ছিলো।
অবশ্য ২০২৪ সালের ৩১শে জুলাই বিএনপির ইউটিউব পেজে গেলে সেদিনকার মিজ টুম্পার পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়ানোর এবং এক পর্যায়ে তাকে সরিয়ে দেয়ার ভিডিও পোস্ট দেখা যায়।
অর্থাৎ সেসময় দলীয় পরিচয়ে কেউ সামনে না আসলেও মাঠ পর্যায়ে যে রাজনৈতিক দলের কর্মীরা ছিলেন না সেটাও বলা যায় না।
তবে সে আন্দোলনে সম্পৃক্ততা বা নেতৃত্বের দাবির জায়গায় পরিষ্কারভাবে কাউকে একক কৃতিত্ব দেয়ার সুযোগ থাকা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে আন্দোলন দমনে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তখন তাদের তরফ থেকে ক্রমাগত আঙুল তোলা হচ্ছিল বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর দিকে।
গতবছর ১৭ই জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের ক্যাডার বাহিনী সহিংসতা করে সারাদেশে। বিশেষ করে ঢাকায়, পরিস্থিতি ঘোলাটে করে। তাদের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী সারা বাংলাদেশ থেকে এনে এই শহরে তারা গুপ্তহত্যা করা শুরু করেছে।
একই দিনে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদও বলেছিলেন, তারেক জিয়া বিভিন্নজনকে নির্দেশ দিচ্ছে কোটা আন্দোলনকারীদের ভেতর ঢুকে পড়ার জন্য।
অবশ্য সেদিন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আন্দোলনে বিএনপির সরাসরি জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেন এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে বিএনপির ‘নৈতিক সমর্থন’ দেওয়ার কথা বলেন।
জামায়াতে ইসলামীর দিক থেকেও সর্বাত্মক সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয় ১৮ই জুলাই।
এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে বিএনপির মহাসচিব অনেকটা বিরক্তিই প্রকাশ করেন। সেসময় প্রকাশ্য সমর্থন দেওয়া হয়নি কেন তেমন প্রশ্ন তোলাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভাজন তৈরির চেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। অবশ্য উত্তরও দেন তিনি।
আওয়ামী বিচারকদের মুখোশ উন্মোচন করাই ছিল আমার অপরাধ আওয়ামী বিচারকদের মুখোশ উন্মোচন করাই ছিল আমার অপরাধ
আমাদের দেশের কালচারে একটা প্রবলেম আছে, ছাত্ররা অনেক সময় ওউন করতে (নিজস্ব মনে করা) চায় না অন্য দলকে এবং সমর্থন দিলে এমন একটা কথা বলে দেয় যে তাদের সমর্থন আমাদের দরকার নেই। এইসব কারণে যেটাকে বলে সরাসরি সমর্থন দেওয়া... এটা আর মাঠে সমর্থন দেওয়া... আমরা তো মাঠে ছিলামই, বলেন আলমগীর।
সেসময় ঢাকা থেকে বিএনপির সাড়ে তিন হাজার নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং সে আন্দোলনকে বিএনপি ওউন করে বলেও উল্লেখ করেন বিএনপি মহাসচিব।
অন্যদিকে অভ্যুত্থানের পর থেকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীরও অনেক ক্ষেত্রেই বেশ প্রভাব দেখা যাচ্ছে।
দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, এটার পেছনে যে আমরা ছিলাম এটা গোয়েন্দারা জানতো, সরকার জানতো। এজন্যই তো আমাদেরকে ব্যান করে দিয়েছে, শিবিরকে ব্যান করেছে। আর কোনো দলকে তো করে নাই।
তাহের নিজে থেকেই বলেন যে তারা খুবই সচেতন ছিলেন যেন ‘এটা যে জামায়াত-শিবিরের একটা আন্দোলন এটা যেন প্রকাশিত না হয়, আমরা চেয়েছি এটা একটা সার্বজনীন রূপ দেওয়ার জন্য’।
তার মতে যদি এটা প্রকাশিত হতো যে ছাত্রশিবিরের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামী এর পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে তাহলে জামায়াতে ইসলামীকে যারা খুব একটা পছন্দ করেন না তাদের হয়তো একটা রিজারভেশন তৈরি হতো।
এতে করে ‘সফলতার প্রশ্নটা আরও ডিফিকাল্ট হতে পারতো। সেজন্য আমরা এই কৌশলটা নিয়েছিলাম যেন সকল শ্রেণির মানুষের পার্টিসিপেশন এটা এখানে নিশ্চিত হয়, বলেন জামায়াতের নায়েবে আমির।
সেসময় বিএনপি বা জামায়াত ছাড়াও বামপন্থি ও ইসলামপন্থি দলগুলোকেও বেশ সক্রিয় দেখা গেছে।
তবে এক সাথে বিভিন্ন মতাদর্শের মানুষের একত্রে অংশগ্রহণ থাকার পেছনে একটা বড় বাস্তবতার জায়গা ছিল সেসময় যেভাবে আন্দোলন দমনে সরকার কঠোর হয়েছিল এবং প্রায় সর্বশক্তি দিয়ে বল প্রয়োগ করেছিল।কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে কৃতিত্ব দাবি নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ব্যাখ্যাও।
কৃতিত্ব দাবির ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির যা বলেছেন সেটা থেকেও বোঝা যায় যে জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে কাউকে সম্মুখ সারিতে দেখা গেলে তাতে জনগণের সম্পৃক্ততা সেভাবে নিশ্চিত করা যেতো না।
অনেকটা একই কথা বলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও। জুলাই আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার প্রশ্নে তিনি নেতৃত্ব ও তৃণমূল পর্যায়ের বিষয়ে আলাদাভাবে ব্যাখ্যা করেন।
‘রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আমাদের সরাসরি কোনো সম্পর্ক ছিল না। আন্দোলনের আসলে কোনো পর্যায়েই ছিল না। কিন্তু রাজনৈতিক দলের যারা তৃণমূলের নেতাকর্মী রয়েছে তারা এই অভ্যুত্থানে, আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছে, জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, যে রাজনৈতিক দলের লোকের অংশগ্রহণ থাকলেও তারা তাদের দলীয় পরিচয়ে আসেনি, কারণ দল হিসেবে সামনে আসলে তারা সেভাবে জনসমর্থন পেতেন না।
এর পেছনে অবশ্য এক ধরনের প্রেক্ষাপটও রয়েছে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো বিভিন্ন সময়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন করলেও সেভাবে সফল হয়নি। বরং হামলা-মামলা অনেক কিছু মিলে অনেকটা পর্যুদস্ত হয়ে গেছেন। অনেক ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের আটক হতে বা পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে, দুর্বল হয়ে পড়েছে তাদের কর্মসূচি।
পাঁচই অগাস্টের আগে যেভাবে আন্দোলনে বহু পক্ষ এক হয়েছিল, এক বছর পর এসে একই সময়ের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার বয়ান তৈরি হয়েছে।