4556

05/15/2024 হুইপপুত্রের গোপন ব্যবসার বলি তরুণ ব্যাংকার

হুইপপুত্রের গোপন ব্যবসার বলি তরুণ ব্যাংকার

রাজটাইমস ডেক্স

১৪ এপ্রিল ২০২১ ১৬:৫১

এদিকে আসামিদের বিরুদ্ধে নিজের ও তাঁর স্বামী-সন্তানের পাসপোর্ট আটকে রাখার অভিযোগ করেছেন ইশরাত জাহান। তাঁর অফিস ও বাড়িতে দফায় দফায় হামলা, মামলা ও অপহরণের হুমকির অভিযোগ এনেছেন অসহায় এই নারী।

ঘটনার পরম্পরা : ২০১৯ সালের ২৯ মে চিটাগাং চেম্বারের সাবেক দুই পরিচালক হুইপপুত্র শারুণ চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে দুটি গাড়িতে করে ১০-১২ জন যুবক ব্যাংকার মোর্শেদের বাসায় আসেন। পারভেজ ইকবাল দলের অন্যদের নিয়ে লিফটে করে ওপরে উঠে বাসার দরজা ধাক্কাতে থাকেন। এ সময় দরজা খুলতে না চাইলে লাথি মারতে থাকেন তাঁরা। নিজের ও শিশুকন্যার নিরাপত্তার জন্য দরজা খুলতে না চাইলেও দরজার অন্য প্রান্ত থেকে হুমকি দিয়ে পারভেজ ইকবাল দরজা খুলতে চাপ দিতে থাকেন। উত্তেজিত পারভেজ ব্যাংকারের স্ত্রীর উদ্দেশে বলতে থাকেন, ‘আমরা আপনাকে আটকে রেখে ওকে (মোর্শেদ) আনব।’ এ সময় ভবনটির নিচে নাম্বার প্লেটবিহীন গাড়িতে হুইপপুত্র শারুন চৌধুরী ও সাবেক ছাত্রনেতা আরশেদুল আলম বাচ্চু বসা ছিলেন বলেও জানান তিনি। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ব্যাংকার মোর্শেদ তাঁর স্ত্রী-সন্তানসহ পালিয়ে নিকটাত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। সহযোগিতা চান পুলিশের কাছে। থানায় জিডিও করেন, কিন্তু শেষরক্ষা পাননি মোর্শেদ। পরিবারটি এখনো নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে।

ইশরাত বলেন, ‘২০১৮ সালের মে মাসে আমার স্বামীকে পাঁচলাইশের এমএম টাওয়ারে নিয়ে যায় সৈয়দ সাকিন সাঈম উদ্দীন। সেখানে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে শারীরিক নির্যাতন, আমাকে বেঁধে ১২ কোটি টাকা অতিরিক্ত দাবি করে জোরপূর্বক স্ট্যাম্পে সই নেওয়া হয়েছিল। আমার ও মেয়ের পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়। ২০১৯ সালে বাসায় হামলার ব্যাপারে মামলা করা হয়। বাসায় আক্রমণ, মেয়েকে অপহরণ, আমার স্বামীকে খুন করবে বলে অনেকবার প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হয়। আপস ও আলোচনার কথা বলে গত ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর সাকিব অস্ত্রের মুখে ৮৪টি চেকে জোরপূর্বক সই নিয়ে নেন। আমাদের ছয়টি অলিখিত ও স্বাক্ষরিত নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প রয়েছে তাদের কাছে।’

ইশরাত বলেন, ‘হুমকিদাতাদের অর্থবিত্ত ও রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে আমরা চরম অসহায়। আমি নিজের ও মেয়ের জীবন, মান-ইজ্জত নিয়ে চরম শঙ্কিত।’ তিনি আরো বলেন, ‘মিথ্যে পাওনার দাবিতে সাকিব আমার ও আমার স্বামীর বিরুদ্ধে আটটি মামলা করেছিল। অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় সব কটি মামলায় আমি খালাস পেয়েছি। আমার স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগও খালাসের প্রক্রিয়ায় ছিল।’

পুলিশ সব কিছুই জানত : ইশরাত জাহান চৌধুরী বলেন, সব কিছুই পুলিশ জানত। ডিসি অফিসে সমঝোতা বৈঠক ও চুক্তি হয়। বাচ্চুসহ উপস্থিত থেকেই চুক্তি হয়।

এ ব্যাপারে সিএমপির ডিসি বিজয় বসাক বলেন, ব্যাংক কর্মকর্তা মোর্শেদ ও তাঁর স্ত্রী তাঁদের বাসায় হামলার ঘটনায় জিডি করার পরেই উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহযোগিতার জন্য এসেছিলেন। বাসায় হামলার ঘটনাটির পরই বৈঠক হয়। উভয় পক্ষের হয়ে সমঝোতার মধ্যস্থতাকারী নিকটাত্মীয় ব্যবসায়ী আজম খান, মোর্শেদ ও তাঁর বড় ভাই আশরাফ একাধিক সমঝোতা বৈঠকে বসেন। পারভেজ ইকবালরা পাওনার জন্য মামলা করে মোর্শেদের ব্যাংকের চাকরিচ্যুতি এবং তাঁর স্ত্রীকে চাকরিতে যেতে বাধা দেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘মামলা করলে চাকরির ক্ষেত্রে সমস্যা হবে—এমনটি জানিয়ে মোর্শেদ সহযোগিতা চাইলে দুই পক্ষে সমঝোতার চেষ্টা করি। দুই পক্ষের সমঝোতার কাগজ অনুযায়ী দেনা পরিশোধ প্রক্রিয়া হচ্ছিল।’

যুবনেতার হুমকি : এ ঘটনার প্রায় দুই বছর পরেও দফায় দফায় আসল ও সুদ পরিশোধের পরেও অতিরিক্ত টাকার জন্য যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল টেলিফোনে চাপ দিতে থাকেন বলে অভিযোগ করেন ব্যাংকার মোর্শেদের স্ত্রী ইশরাত। পারভেজ ও জাবেদের হয়ে টেলিফোনে রাসেলের হুমকির এক দিন পরই ব্যাংক কর্মকর্তা মোর্শেদ আত্মহত্যা করেন। তাই মামলায় রাসেলকে অভিযুক্ত করা হয় বলে জানান ইশরাত। এসংক্রান্ত অডিও রেকর্ডে রাসেলকে বলতে শোনা যায়, ‘বিজয় (পুলিশের ডিসি বিজয় বসাক) পুলিশে চাকরি করে। আজ এখানে আছে তো কাল চলে যাবে। আমি কিন্তু চট্টগ্রামে থাকব। আমার সাথে এগুলো করলে বিপদ হয়ে যাবে।’ টেলিফোনে হুমকির প্রসঙ্গে যুবনেতা রাসেল জানান, তাঁর ছোটবেলার বন্ধু জাবেদ ইকবালের অনুরোধে দুই পক্ষের অঙ্গীকারনামা দেখে তিনি মধ্যস্থতা করতে রাজি হন।

ব্যবসা নিয়ে ধোঁয়াশা : মুঠোফোন আলাপচারিতায় প্রতিশ্রুত সময়ের মধ্যেই দেনা পরিশোধের ব্যাপারে বারবার আশ্বস্ত করতে গিয়ে মোর্শেদ এই যুবনেতাকে বলতে থাকেন এক কাস্টমারের কথা। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কে সেই কাস্টমার? এত কোটি টাকা বিনিয়োগ কোন ব্যবসায় করা হয়েছিল, তা কি জানতেন? এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি যুবলীগ নেতা রাসেল।

কিভাবে যুক্ত হলেন হুইপপুত্র : কী ব্যবসা ছিল তাঁদের? এটি কি সুদের লগ্নির ব্যবসা? যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে এখানে হুইপপুত্র কিংবা অন্যদের কার মূলধন বা লভ্যাংশ আসলে কত ছিল? প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এসব নিয়ে। হুইপপুত্র শারুন চৌধুরী কিভাবে এই ব্যবসা বা লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত হলেন, তা অনুসন্ধানকালে উঠে এসেছে নানা তথ্য। মোর্শেদের স্ত্রী ইশরাত বলেন, ‘শারুনের সঙ্গে সরাসরি আমার স্বামীর কোনো লেনদেন ছিল না। মোর্শেদের সঙ্গে সরাসরি লেনদেন না থাকলেও শারুন চৌধুরী, বাচ্চু ও রাসেল কেন এ রকম টর্চার করল, তার জবাব মিলছে না।’ ইশরাত বলেন, শারুন চৌধুরী কেন উপর্যুপরি সক্রিয় হলেন, এই নিয়ে জানতে মোর্শেদই একদিন প্রশ্ন করেছিলেন। সেই প্রশ্নে শারুণ তখন জবাব দিয়েছিলেন, ‘সরাসরি লেনদেন আমি করিনি। পারভেজের মাধ্যমে বিনিয়োগ করেছি।’

আরেক এমপির মধ্যস্থতা : ইশরাত বলেন, ‘দলবল নিয়ে বাসায় হামলার পরে আমরা নিকটাত্মীয় ব্যবসায়ী আজম খানের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। তিনি মধ্যস্থতায় এগিয়ে আসেন। এক পর্যায়ে সীতাকুণ্ডের এমপি দিদারুল আলমও ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসেবে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন।’ এমপি দিদারুল আলম জানান, তাঁর কন্যার শ্বশুরবাড়িতেও একবার জাবেদ ইকবাল অনুরোধ করেন সমঝোতার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাবেদ ইকবালের ভাই পারভেজের অনাগ্রহে এমপি দিদারের সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায় বলে জানান মোর্শেদের স্ত্রী।

শারুন চৌধুরী এই প্রক্রিয়ায় কিভাবে যুক্ত হলেন জানতে চাইলে এসপি বিজয় বসাক জানান, জামানত বাবদ চেক গ্রহণের বিপরীতে ব্যবসায় পারভেজের মাধ্যমে শারুন বিনিয়োগ করেন এবং পারভেজকে তাঁর পাওনা টাকার জন্য চাপ দেন। যেহেতু মোর্শেদের কাছে সরাসরি পাওনাদার নয়, সেহেতু সমঝোতা বৈঠকে শারুনকে আসতে দেওয়া হয়নি বলে জানান ডিসি।

পারভেজের দাবি মেনে নেন মোর্শেদ : আজম খান বলেন, মৃত্যুর আগে ৭ এপ্রিল এক দফায় দুই কোটি টাকা লেনদেনের কথা হয়েছিল। এই টাকা ব্যাংকে ট্রান্সফার দেওয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করেছিলেন মোর্শেদ, বলেন আজম খান। তিনি আরো বলেন, এর পর থেকে পারভেজ ও জাবেদদের ফোন করেও আর পাওয়া যায়নি।

আজম বলেন, ‘আমি মধ্যস্থতা করার পর থেকে সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা সুদসহ পেমেন্ট হয়েছে। এরপর সাত কোটি টাকা দাবি করছিলেন পারভেজ। মোর্শেদ অ্যাগ্রিও করেছিল।’ এমপি দিদারুল আলম বলেন, ‘২০১৩-১৪ সাল থেকেই এই লেনদেন হয়ে আসছিল বলে জেনেছি।’

শারুন-বাচ্চুর সম্পৃক্ততা : ব্যাংকার মোরশেদ চৌধুরীর সঙ্গে এই বিনিয়োগ, বাসায় হামলা, টাকা উদ্ধার প্রক্রিয়ায় শারুনের সঙ্গে বাচ্চুর নাম উঠে এসেছে। একাধিক মুঠোফোন আলাপ ও পুলিশের ডিসির কক্ষে অনুষ্ঠিত সমঝোতা বৈঠকে বাচ্চুর উপস্থিত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। শারুন ও বাচ্চু এক সমঝোতা বৈঠকে বসার কথা স্বীকার করেন আজম খান।

কেন আসামি নন শারুন ও বাচ্চু? : তবে কেন এই মামলায় হুইপপুত্র শারুন চৌধুরী কিংবা সাবেক ছাত্রনেতা আরশাদ বাচ্চুকে আসামি করা হলো না? এই প্রশ্নের জবাবে মোর্শেদের স্ত্রী ইশরাত জাহান চৌধুরী জানান, শারুন চৌধুরী ও বাচ্চু ২০১৯ সালে বাসায় হামলার ঘটনায় উপস্থিত থাকলেও এদের সঙ্গে সরাসরি মোর্শেদের টাকার লেনদেনের কোনো প্রমাণ নেই। অডিও ভয়েস কিংবা অন্য কোনো সম্পৃক্ততার প্রমাণ আছে কি না, তা পরবর্তী সময়ে হয়তো পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসতে পারে। ইশরাত বলেন, ‘আমি সাক্ষ্য-প্রমাণ হাতে নিয়েই কাউকে অভিযুক্ত করতে চাই। তা ছাড়া বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করে বের করে আনলেই যথার্থ হয়।’

সুইসাইড নোট : ইশরাত জাহান চৌধুরী অভিযোগ করেন, ‘আমার স্বামী মোর্শেদ ব্যবসার জন্য বিভিন্ন দফায় ২৫ কোটি টাকা ধার নেন। বিপরীতে তাদের কাছে লাভসহ ৩৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু তারা বেশি লভ্যাংশের দাবিতে স্বামীর ওপর মানসিক চাপ, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। অনৈতিক মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে মোর্শেদ আত্মহত্যা করে। সুইসাইড নোটে সে সব ঘটনা বলে গেছে।’

সুইসাইড নোটে মোর্শেদ উল্লেখ করেন, ‘আর পারছি না। সত্যি আর নিতে পারছি না। প্রতিদিন একবার করে মরছি। কিছু লোকের অমানুষিক প্রেসার আমি আর নিতে পারছি না। প্লিজ, সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আমার জুমকে (মেয়ে) সবাই দেখে রেখো। আল্লাহ হাফেজ।’

শারুনের বক্তব্য : ২০১৯ সালে মোর্শেদ চৌধুরীর বাসায় সদলবলে গিয়েছিলেন কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে হুইপপুত্র নাজমুল হক চৌধুরী শারুন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি মোর্শেদ চৌধুরীর বাসায় যাইনি। যে গাড়িতে আমি ছিলাম বলে দাবি করা হচ্ছে সেই গাড়ি আমার নয়। যে ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে সেটি ২০২০ সালে ধারণ করা। আর ঘটনার সময় বলা হচ্ছে ২০১৯ সাল।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার সঙ্গে মোর্শেদ চৌধুরীর একবার মাত্র ১০ মিনিটের জন্য দেখা হয়েছিল পাঁচলাইশ এলাকার আজম সাহেবের বাসায়। পারভেজ ইকবাল ও আমাদের বাসা হালিশহর এলাকায়। একই এলাকায় বাস করার সুবাদে আমার পূর্বপরিচয় আছে। সেই কারণেই আজম সাহেবের বাসায় গিয়েছিলাম। এর মধ্যে মোর্শেদ চৌধুরীর সঙ্গে আজম সাহেবের বাসায় দেখা হয়। সেখানে পারভেজের সঙ্গে ব্যাবসায়িক লেনদেন নিয়ে কথা হচ্ছিল। তা শুনে আমি আর বাচ্চু ভাই চলে এসেছি। এরপর আর কখনোই দেখা হয়নি। আমাদের রাজনৈতিক ও পারিবারিক অবস্থান ক্ষুণ্ন করতেই এমন অভিযোগ করা হচ্ছে।’

সূত্র: কালের কন্ঠ

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]