4696

04/19/2024 হত্যার দায় চাপানো হচ্ছে শ্রমিকদের ওপরই

হত্যার দায় চাপানো হচ্ছে শ্রমিকদের ওপরই

রাজটাইমস ডেক্স

২৩ এপ্রিল ২০২১ ১৬:৫৯

চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণাধীন কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিক্ষোভে গুলিতে মৃত্যুর দায় শ্রমিকদের ওপরই চাপানো হচ্ছে। পুলিশের করা হত্যা মামলায় বলা হয়েছে, শ্রমিকদের গুলিতে শ্রমিকেরা মারা যান, তাঁদের হাতেও ছিল অস্ত্র। অথচ ঘটনার দিন পুলিশ নিজেই বলেছিল, আত্মরক্ষার্থে গুলি ছোড়া হয়। আবার মালিকপক্ষের করা লুটের মামলায় শ্রমিকদের প্ররোচনায় বহিরাগতরা হামলা করেছে বলে উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে গুলিবিদ্ধ শ্রমিকদের ভাষ্য, পুলিশ বিক্ষোভে গুলি চালিয়েছে। শ্রমিকদের হাতে অস্ত্র ছিল না।

বাঁশখালীতে নিহতদের একজন মোহাম্মদ রেজা। তার লাশ নি‌য়ে মা‌য়ের আহাজা‌রি
বাঁশখালীতে নিহতদের একজন মোহাম্মদ রেজা। তার লাশ নি‌য়ে মা‌য়ের আহাজা‌রিফাইল ছবি
১৭ এপ্রিল বাঁশখালীর গন্ডামারায় সংঘর্ষের সময় এ নিয়ে গুলিবিদ্ধ সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ঘটনার দিন নিহত হন পাঁচজন। এরপর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গল ও বুধবার মারা যান আরও দুজন। গুলিবিদ্ধ ১২ জন এখনো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। মাসের ৫ তারিখের মধ্যে বেতন পরিশোধ, পবিত্র রমজানে কর্মঘণ্টা কমানোসহ নানা দাবিতে বিক্ষোভ করেন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজের শ্রমিকেরা।

বাঁশখালী সদর থেকে ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে শিল্প গ্রুপ এস আলমের মালিকানায় এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট নামে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মিত হচ্ছে। চীনা প্রতিষ্ঠান সেফকো থ্রি পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড এখানে অর্থায়ন করেছে।


সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, সংঘর্ষ হয়েছে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের। হতাহত হয়েছেন শ্রমিকেরা। পুলিশ কিংবা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কেউ গুলিতে আহত হননি। পুলিশ নিজের দোষ ঢাকার জন্য শ্রমিকদের ওপর দায় চাপিয়ে দিচ্ছে। বিচার বিভাগীয় সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে এই ঘটনার যথাযথ তদন্ত হওয়া উচিত।


হত্যা মামলার এজাহারে যা রয়েছে
বাঁশখালীর গন্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই রাশেদুজ্জামান বেগ বাদী হয়ে অগ্নিসংযোগ ও শ্রমিক হত্যার মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার শ্রমিক ও স্থানীয় বহিরাগতদের আসামি করেন। এজাহারে বলা হয়, ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে হামলা চালান শ্রমিকেরা। চায়না শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সবার জানমাল রক্ষার্থে পুলিশ সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। বিক্ষোভে শ্রমিক ও বহিরাগতদের গুলিতেই অন্য শ্রমিকেরা নিহত হন।

অথচ ঘটনার দিন বিকেলে বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রত্যক্ষদর্শী অন্তত ১২ জন শ্রমিক ও গুলিতে আহত ৭ জন শ্রমিকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানিয়েছেন, পুলিশ প্রথমে কয়েকটি ফাঁকা গুলি ছুড়লেও এরপর সরাসরি গুলি করে। তাদের সঙ্গে বহিরাগতরা ছিলেন। গুলি করার পর উত্তেজিত শ্রমিকেরা মিকশ্চার মেশিন, মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন।

হত্যায় অন্য শ্রমিকদের দায়ী করা হচ্ছে শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেন বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক মো. ইমন। তিনি বলেন, ‘দাবি আদায়ের জন্য বিক্ষোভে ছিলাম। পুলিশ সরাসরি গুলি করা শুরু করলে দৌড়ে পালাতে গিয়ে আমার পিঠে গুলি লাগে। শ্রমিকদের কারও কাছে অস্ত্র ছিল না।’

শ্রমিকদের আসামি করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মামলার বাদী গন্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ রাশেদুজ্জামান বেগ বলেন, শ্রমিক ও বহিরাগতদের হাতে অস্ত্র ছিল। তারা পুলিশ লক্ষ্য করে গুলি করে। তবে গুলিতে তিনি নিজে ও কোনো পুলিশ সদস্য আহত হননি বলে স্বীকার করেন।

মালিকপক্ষের এজাহারে যা রয়েছে
বিদ্যুৎকেন্দ্রের চিফ কো-অর্ডিনেটর ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে ২২ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় ১ হাজার ৫০ জনকে আসামি করে লুটের মামলা করেন। এতে বলা হয়, শ্রমিকদের প্ররোচনায় বহিরাগতদের হামলায় ১৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মামলার ২১ নম্বর আসামি আলী হায়দার। তিনি স্থানীয় ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের শ্রমিক। বাকি ২১ জন বিদ্যুৎকেন্দ্রের আশপাশের বাসিন্দা। কেউ দোকানদার, কেউ সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক। তাঁরা সবাই বিএনপি ও জামায়াতের কর্মী হিসেবে এলাকায় পরিচিত।

এস আলম গ্রুপের ভূসম্পত্তি বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ মোস্তান বিল্লাহ বলেন, স্থানীয় কিছু মানুষের ইন্ধনে শ্রমিকেরা উত্তেজিত হয়ে কর্মরত চীনা নাগরিকদের ওপর হামলার চেষ্টা চালান। মামলায় শ্রমিকদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও তদন্তে পুলিশ জড়িতদের শনাক্তের চেষ্টা করছে।

দুটি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাঁশখালী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আজিজুল ইসলাম বলেন, তদন্তাধীন বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাবে না।

ঘটনা তদন্তে গঠিত পুলিশ ও জেলা প্রশাসনের দুই কমিটি কাজ করছে। পুলিশের করা তদন্ত কমিটির প্রধান, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) জাকির হোসেন খান গতকাল বৃহস্পতিবার বলেন, গুলিতে শ্রমিকেরা মারা গেছেন। এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তবে কার গুলিতে, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। পুলিশ সদস্যরা আহত হয়েছেন ইটপাটকেলে।

শঙ্কামুক্ত নন আহত ৪ শ্রমিক
গুলিতে আহত চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১২ শ্রমিকের মধ্যে ৪ জন এখনো শঙ্কামুক্ত নন। হাসপাতালের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন শ্রমিক আমিনুল হককে এখনো রক্ত দিতে হচ্ছে। গতকাল দুপুরে হাসপাতালে দেখা যায়, কথা বলার শক্তি নেই তাঁর। চোখ বুজে থাকছেন সারাক্ষণ।

তাঁর বড় ভাই মোমিনুল হক বলেন, ‘ভাইয়ের অবস্থা ভালো না। সকাল থেকে দুই ব্যাগ রক্তের জন্য দৌড়াচ্ছি। বিকেলে এক ব্যাগ জোগাড় হয়েছে।’ রাতের মধ্যে আরেক ব্যাগ লাগবে। আমিনুলের মতো অবস্থা রাহাত, ইমন ও বিল্লালেরও।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের প্রধান আনোয়ারুল হক গতকাল বলেন, তিন থেকে চারজন শ্রমিক এখনো শঙ্কামুক্ত নন। কয়েকজনকে এখনো রক্ত দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের আরও তিন থেকে চার সপ্তাহ হাসপাতালে থাকতে হবে।

আর্টিকেল নাইনটিনের নিন্দা
বাঁশখালীতে বিক্ষোভরত শ্রমিকদের ওপর পুলিশের গুলি চালানোর ঘটনায় গতকাল তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন। সংগঠনটির বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেছেন, আর্টিকেল নাইনটিন লক্ষ করছে, সাম্প্রতিককালে আয়োজিত অনেকগুলো মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ পুলিশের বাধায় পণ্ড হয়েছে।

সরকারকে সংবিধান স্বীকৃত নাগরিকের সভা-সমাবেশ করার অধিকার নিশ্চিত করা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জনগণের নাগরিক-রাজনৈতিক অধিকার চর্চায় বাধা দেওয়া থেকে বিরত রাখতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।

বিচারিক অনুসন্ধান চেয়ে রিট
শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় ভুক্তভোগীদের তালিকা তৈরিসহ প্রকৃত ঘটনা উদ্‌ঘাটনে বিচারিক অনুসন্ধান কমিটি গঠনের নির্দেশনা চেয়ে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে গতকাল রিট দায়ের করা হয়। প্রত্যেক নিহত শ্রমিকের পরিবারকে তিন কোটি এবং আহত শ্রমিকদের দুই কোটি টাকা করে যৌথভাবে ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না—এ বিষয়েও রুল চাওয়া হয়েছে রিটে।

বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সরদার মো. রাশেদ জাহাঙ্গীরের সমন্বয়ে গঠিত ভার্চ্যুয়াল হাইকোর্ট বেঞ্চে রিটটি ২৫ এপ্রিল উপস্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন আসকের আইনজীবী সৈয়দা নাসরিন।

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]