4945

04/25/2024 অনিয়মের শাস্তি হয় না, উপাচার্যরাও ‘বেপরোয়া’

অনিয়মের শাস্তি হয় না, উপাচার্যরাও ‘বেপরোয়া’

রাজটাইমস ডেক্স

৮ মে ২০২১ ১৬:০২

সাড়ে ছয় মাস আগেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) তদন্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়ে বলেছিল, শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা উদ্দেশ্যমূলকভাবে পরিবর্তন করে যোগ্যতা কমিয়ে দিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী উপাচার্য এম আবদুস সোবহান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। এর মাধ্যমে কম যোগ্যতায় বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক হন উপাচার্যের কন্যা ও জামাতা। এভাবে যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্য ৩৪ জনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

অথচ আগের নীতিমালা অনুযায়ী, তাঁদের আবেদন করারই যোগ্যতা ছিল না। এ জন্য এসব নিয়োগ বাতিল এবং উপাচার্যের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও উপাচার্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ওই সব নিয়োগও বাতিল হয়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রায় পাঁচ মাস আগে কয়েকটি কারণ দর্শানোর নোটিশ দিলেও এরপর কার্যত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি আটকে যায়। আর এই সুযোগে মেয়াদের শেষ কর্মদিবসে ১৪১ জনকে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়ে অনিয়মের নজির সৃষ্টি করে বিদায় নিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য।


রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে বেশির ভাগ সময় উপস্থিত না থাকাসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে আন্দোলন করে আসছিলেন শিক্ষকেরা। উপাচার্যসহ এই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো দুটি কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করেছে ইউজিসি। এর মধ্যে জমা দেওয়া একটি তদন্ত কমিটি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে উপাচার্যসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অনিয়মের সত্যতা পেয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কিন্তু এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো উপাচার্য সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলেন, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে তাঁর বিরুদ্ধে এসব করা হচ্ছে। আগামী মাসে শেষ হবে তাঁর মেয়াদ।

শুধু এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। এসব অভিযোগের তদন্ত হলেও উদাহরণ সৃষ্টি করার মতো কখনো ব্যবস্থা হয় না। কখনো কখনো কোনো উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া হলেও অনিয়মের শাস্তি হয় না।

ইউজিসির কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্তের ভিত্তিতে যদি কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হতো, তাহলে উপাচার্যরা এত অনিয়ম করতে পারতেন না। এমনিতে অধিকাংশ উপাচার্য নিয়োগ পান দলীয় বিবেচনায়। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে তাঁরা রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করেন। তার ওপর কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় তাঁরা আরও ‘বেপরোয়া’ হয়ে ওঠেন। এ জন্য অনিয়ম করলে অপরাধের কঠোর বিচার হওয়া দরকার। কিন্তু ইউজিসি সুপারিশ করা ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। বর্তমানে দেশে ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। এগুলোতে প্রায় ৮ লাখ শিক্ষার্থী ও ১৫ হাজারের মতো শিক্ষক রয়েছেন।

ইউজিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে এক ডজনের বেশি স্বায়ত্তশাসিত এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করছে ইউজিসি বা করার প্রক্রিয়া চলছে। এর মধ্যে ১০ জন বর্তমান ও সাবেক উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। কিছু তদন্ত শেষ হয়েছে। দু-একটির জমা পড়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আছে—বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

ইউজিসির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তাঁর সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘প্রথম ভাইস চ্যান্সেলরের ট্রাস্ট ভবন’ নির্মাণে অনিয়ম হয়েছে। এ ভবন নির্মাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় ১৪ শতাংশ জমি কেনা হয় এবং ১ কোটি ৩১ লাখ ৫২ হাজার টাকায় ভবন নির্মাণ করা হয়। তবে উপাচার্যের দাবি ছিল, ভবন নির্মাণে তাঁর ব্যক্তিগত টাকাও ব্যয় করা হয়েছে।

তদন্ত করে ইউজিসির কমিটি বলেছে, ট্রাস্ট ভবন নির্মাণে কারও ব্যক্তিগত টাকা ব্যয় হয়নি। ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজে সভাপতি থাকার সময়েও ওই উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। কয়েক দিন আগে তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য করা হয়েছে।

খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য শহীদুর রহমান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি নিজের ছেলেকে ‘অ্যাডহক’ ভিত্তিতে সেকশন অফিসার হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নিজের মেয়েকে নিয়োগ দিয়েছেন শিক্ষক হিসেবে। এরপর উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত স্ত্রীকে অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টায় নামেন তিনি। যদিও এ নিয়োগ স্থগিত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ১৫টি অভিযোগ তদন্ত করছে ইউজিসির তদন্ত কমিটি।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেছেন, অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সুশাসনের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান দিনে দিনে নিচে নামছে। কিন্তু ব্যবস্থা না হওয়ায় অনিয়ম থামছে না। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তিনি নিজের ছেলেকে নীতিমালা শিথিল করে নিয়োগ দেন। তবে এ নিয়ে কোনো ব্যবস্থা হয়নি। তিনি পুরো মেয়াদ শেষ করেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা নিজের সন্তানকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। অবশ্য সমালোচনার মুখে সেখানে শিক্ষকতা করেননি ওই উপাচার্যের সন্তান।

গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য খোন্দকার নাসির উদ্দিনের অনিয়মের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁর অনিয়মের জন্য এখনো কোনো শাস্তি হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একমাত্র রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এক উপাচার্যকে মেয়াদ শেষ হওয়ার এক দিন আগে অপসারণ করা হয়েছিল। পরে তাঁকে দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলায় জেলে যেতে হয়েছিল। এ ছাড়া উদাহরণ সৃষ্টি করার মতো কখনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।

ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, দুর্ভাগ্যজনক হলো, অনেক তদন্ত হয়, কিন্তু ব্যবস্থা হয় না। এটা সুশাসনের জন্য ভালো নয়।
সূত্র: প্রথম আলো

প্রকাশক ও সম্পাদক : মহিব্বুল আরেফিন
যোগাযোগ: ২৬৮, পূবালী মার্কেট, শিরোইল, ঘোড়ামারা, রাজশাহী-৬০০০
মোবাইল: ০৯৬৩৮ ১৭ ৩৩ ৮১; ০১৭২৮ ২২ ৩৩ ২৮
ইমেইল: [email protected]; [email protected]