চিকিৎসা যখন গণহত্যার হাতিয়ার

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভয়ংকর নীরব বিপর্যয়

সরদার হাসান ইলিয়াছ তানিম | প্রকাশিত: ২৭ জুন ২০২৫ ০০:৩৭; আপডেট: ২৭ জুন ২০২৫ ০৫:২৩

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে আমরা অনেকেই হয়ত অভ্যস্ত হয়ে গেছি হাসপাতালের করিডোরে কান্নার আওয়াজ শুনে, কিংবা সমাজমাধ্যমে ‘ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু’ শিরোনামে সংবাদ দেখে। কিন্তু এই প্রতিদিনের ট্র্যাজেডিগুলো কি কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি এটি একটি বৃহৎ কাঠামোগত ব্যর্থতার প্রতিফলন, যা ধীরে ধীরে এক ‘নীরব গণহত্যায়’ রূপ নিচ্ছে?

আমরা যখন বলি ‘গণহত্যা’, তখন অনেকেই চমকে উঠতে পারেন। কিন্তু জাতিসংঘের ১৯৪৮ সালের Convention on the Prevention and Punishment of the Crime of Genocide অনুসারে, একটি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধাচরণ, চেতনাগত অবহেলা কিংবা কাঠামোগত নিপীড়ন যদি তাদের জীবন বিপন্ন করে, তবে সেটিও গণহত্যার এক রূপ হতে পারে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যে রকম অব্যবস্থা, দুর্নীতি ও অমানবিকতা চলছে, তা কেবল অবহেলা নয়—এটি একটি নীতিগত, কাঠামোগত সহিংসতা, যার শিকার হয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রতিবছর অপ্রত্যক্ষভাবে মারা যাচ্ছেন।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অন্যতম ভয়াবহ দিক হলো চিকিৎসক ও ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির মধ্যে দুর্নীতিপূর্ণ সম্পর্ক। ২০২২ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB) এক গবেষণায় দেখায়, চিকিৎসকরা প্রায়ই কোম্পানির দেওয়া উপহার, বিদেশ ভ্রমণ কিংবা আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ প্রেসক্রিপশন করেন (Transparency International Bangladesh, 2022)। এতে একদিকে যেমন রোগীর ব্যয় বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে শরীরে ওষুধ প্রতিরোধী জীবাণু তৈরি হয়।

ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল (BMJ)-এ ২০২২ সালে প্রকাশিত এক জরিপ অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় চিকিৎসকদের ৭০% প্রেসক্রিপশনে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ থাকে, যার নেতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি (BMJ South Asia Prescription Audit, 2022)। WHO-এর ২০২৩ সালের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে ১ লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা যান যেসব সংক্রমণের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করে না—এটি অতিরিক্ত ও অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ ব্যবহারের সরাসরি ফল (WHO GLASS Report, 2023)।

২০২৪ সালে বাংলাদেশের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর (DGDA) প্রকাশ করে যে দেশে বাজারে থাকা প্রায় ১০% ওষুধ মানহীন বা অনুমোদনহীন (DGDA Annual Report, 2024)। একই বছর BBC বাংলার অনুসন্ধানে দেখা যায় খুলনা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলে ময়দা, রঙ ও রাসায়নিক দিয়ে তৈরি ট্যাবলেট সাধারণ ফার্মেসিতে বিক্রি হচ্ছে (BBC Bangla Investigative Report, 2023)। এসব ওষুধ অনেক সময় কিডনি বিকল, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত কিংবা স্থায়ী স্নায়বিক সমস্যা সৃষ্টি করছে।

উল্লেখযোগ্যভাবে, এসব ফার্মেসির অধিকাংশেই কাজ করছেন অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তি, যাদের ওষুধ সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক জ্ঞান নেই। অথচ প্রতিদিন হাজারো মানুষ এদের কাছ থেকে জীবনরক্ষাকারী ওষুধ সংগ্রহ করছেন। এর ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী হয়ে উঠছে সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী।

TIB-এর ২০২২ সালের প্রতিবেদনে জানা যায়, একটি গড় পরিবার তার বার্ষিক আয়ের ৩০% পর্যন্ত চিকিৎসায় ব্যয় করে, যার বড় একটি অংশ ঘুষ, কমিশন ও অকারণ খরচ (Transparency International Bangladesh, 2022)। ৪৫% পরিবার চিকিৎসা খরচ মেটাতে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে। এর ফলে শুধু একজন রোগী নয়, পুরো পরিবার মানসিক ও আর্থিকভাবে ধসে পড়ে।

স্বাস্থ্যখাতে এই দুর্নীতিকে কেউ জবাবদিহির আওতায় আনে না, তদন্ত হয় না, শাস্তি হয় না। ফলে এই প্রাতিষ্ঠানিক অব্যবস্থা ও দণ্ডমুক্তির সংস্কৃতি ক্রমেই স্থায়ী রূপ নিচ্ছে।

WHO এবং United Nations Development Programme (UNDP) বারবার সতর্ক করে বলেছে, বাংলাদেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা underfunded, unregulated and poorly monitored। উন্নত বিশ্বের FDA (যুক্তরাষ্ট্র) বা EMA (ইউরোপীয় ইউনিয়ন) একটি ওষুধ বাজারে ছাড়ার আগে গড়ে ৪-৫ বছর গবেষণা করে। বাংলাদেশে এই প্রক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই একটি সুপারিশ বা রাজনৈতিক প্রভাবের উপর ভিত্তি করে সম্পন্ন হয়।

বাংলাদেশে এখনো অনেক ফার্মেসিতে কাজ করছে অপ্রশিক্ষিত লোকজন, চিকিৎসকদের কেউ কেউ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির "বিক্রয় প্রতিনিধি"র ভূমিকা পালন করছেন, আর হাসপাতালগুলোতে প্রতিনিয়ত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা, ভর্তি ও অস্ত্রোপচারের পেছনে রোগীদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২৩ সালের অভ্যন্তরীণ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বছরে গড়ে প্রায় ৭৫,০০০ মানুষ মারা যায় ভুল চিকিৎসা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, কিংবা চিকিৎসা অব্যবস্থাপনার কারণে (DGDA Annual Report, 2024)। এই সংখ্যাটি আফগানিস্তান, ইয়েমেনের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তুলনাতেও বেশি, অথচ বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে না—চলছে একটি নীতিগত ও নৈতিক অব্যবস্থা।

সমাধানের জন্য DGDA-এর ক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানো, ফার্মেসিতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষিত পেশাজীবী নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ প্রেসক্রিপশন পর্যবেক্ষণ কমিটি গঠন, চিকিৎসা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি, রোগী অধিকার রক্ষা আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ এবং জাতীয়ভাবে স্বাস্থ্যবিষয়ক জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশে এই অধিকার আজ মৃত্যুর ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু ‘ব্যর্থতা’ নয়—এটি একটি ভয়াবহ, কাঠামোগত, এবং পরিকল্পিত নিপীড়ন, যা আজ লক্ষ লক্ষ মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এটিকে কেবল অবহেলা বা দুর্নীতি বলে পার পাওয়া যাবে না—এটি একটি ভয়ংকর নীরব গণহত্যা (United Nations Genocide Convention, 1948)।

আমরা যদি আজও চুপ থাকি, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যাবো এমন এক বাংলাদেশ—যেখানে অসুস্থতা মানে কেবল রোগ নয়, বরং মৃত্যুর পথে যাত্রা।

---
আইনি বিবৃতি (Legal Disclaimer):
এই নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত, তথ্য ও বিশ্লেষণ সম্পূর্ণভাবে লেখকের নিজস্ব, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশিত তথ্যসূত্র, গবেষণা এবং সংস্থার প্রতিবেদন থেকে সংগৃহীত। এখানে কারো ব্যক্তিগত মানহানি, অপমান বা ক্ষতি করার কোনো উদ্দেশ্য নেই। উল্লিখিত তথ্যসমূহ জনস্বার্থে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই উপস্থাপিত। এই লেখাটি কোনো ব্যক্তি, চিকিৎসক, প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিকে লক্ষ্য করে নয়, বরং একটি কাঠামোগত অব্যবস্থা তুলে ধরার প্রচেষ্টা।

লেখক: সরদার হাসান ইলিয়াছ তানিম সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী সদস্য, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল কমিউনিটি, ফ্রান্স।



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top