হাসপাতালের ‘এত ওষুধ যায় কোথায়?’

রাজ টাইমস | প্রকাশিত: ১০ জানুয়ারী ২০২২ ২০:১৪; আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ০৩:১০

ছবি: প্রতীকী

হাসপাতালে প্রতিটি চিকিৎসকের কক্ষে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অবাধ বিচরণ। অভিযোগ রয়েছে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে রোগীদের প্রেসক্রিপশনে ওষুধ লিখছেন ডাক্তাররা। আর ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা নজরও রাখছেন রোগীদের প্রেসক্রিপশনে। শুধু তাই নয়, হাসপাতালে ডাক্তার, স্বাস্থ্যকর্মী আর দালালদের মধ্যে সিন্ডিকেট করে রোগীদের পকেট কাটা হচ্ছে। প্রতিটি রোগীকে হাসপাতালের সরকারি ওষুধ দেয়ার কথা থাকলেও রোগীদের বেশির ভাগ ওষুধ কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকেই। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিত্যদিনের চিত্র এটি। এ নিয়ে রোগীদের অভিযোগের শেষ নেই। কিন্তু রোগীরা কোনো প্রতিকার পান না। অনেক রোগী চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে ভিটে-জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন।

‘আমরা গরিব মানুষ। অসুস্থ হয়ে চিকিৎসার জন্য সরকারি হাসপাতালে এসেছি। আশা ছিল হাসপাতালে ভালো ডাক্তার দেখাব, সরকারি ওষুধও পাব। অনেক দূর থেকে, অনেক কষ্ট করে হাসপাতালে এসেছি। কিন্তু লাভ কিছুই হয়নি। সকাল ১০টা থেকে আধা ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে তারপর টিকিট পেয়েছি। ডাক্তারের কক্ষের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেছি আরো এক ঘণ্টা। ডাক্তার দেখে অনেক ওষুধ লিখেছেন। সবগুলো ওষুধই কিনতে হবে বাইরের ফার্মেসি থেকে। হাসপাতাল থেকে দিয়েছে শুধুমাত্র ব্যথা আর গ্যাসের ট্যাবলেট। যদি সব ওষুধ বাইরের ফার্মেসি থেকেই কিনতে হয়, তাহলে হাসপাতালের ওষুধ কোথায় যায়?’ শনিবার চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের ওষুধ কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলছিলেন দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা গ্রামের নাসির হোসেন। এভাবে নিজেদের আক্ষেপের কথা বলছিলেন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনেরা।

হাসপাতালের মহিলা মেডিসিন বিভাগে চিকিৎসাধীন রোগী মঞ্জুরা বেগমের ছেলে শিপলুর রহমান বলেন, চার দিন ধরে মাকে নিয়ে হাসপাতালে রয়েছি। তিনি এক সাথে দুটি রোগে ভুগছেন। চার দিনে আমাদের ওষুধ কিনতে হয়েছে আড়াই হাজার টাকার। শুধুমাত্র একটি অ্যান্টিবায়োটিক ও একটি করে গ্যাসের ওষুধ হাসপাতাল থেকে দিচ্ছে। প্রেসক্রিপশনে আরো অনেক ওষুধের উল্লেখ আছে, যা আমাদেরকে হাসপাতাল থেকে দেয়া হচ্ছে না। সরকার যে কোটি কোটি টাকার ওষুধ হাসপাতালে পাঠাচ্ছে, রোগীরা যদি সে ওষুধ নাই পাবে, তাহলে ওষুধগুলো কী হচ্ছে-এমন প্রশ্ন তারও।

সদর হাসপাতালের পুরুষ সার্জারি বিভাগে চিকিৎসাধীন বিউল হক নামের এক রোগীর স্ত্রী রোকেয়া খাতুন বলেন, প্রেসক্রিপশনের দুই পাতায় শুধু ওষুধ লেখা। ডাক্তাররা প্রেসক্রিপশন ভর্তি করে ওষুধ লিখছেন। কিন্তু হাসপাতাল থেকে দিনে একটি করে স্যালাইন ও দু’টি মাত্র ওষুধ পাচ্ছি। বাকি সব ওষুধ ফার্মেসি থেকে কিনে আনতে হচ্ছে। যদি সব ওষুধ বাইরে থেকেই কিনতে হয়, তাহলে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি থেকে লাভ কী? বাড়িতে থেকেই বাইরের ওষুধ কিনে খাওয়াতে পারতাম। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দাবি, রোগীদের প্রয়োজনের ৯০ শতাংশ ওষুধই হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীদের ১০০ শতাংশ ওষুধই হাসপাতাল থেকেই দেয়া হয়।

এ বিষয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা: এ এস এম ফাতেহ আকরাম বলেন, রোগীরা ওষুধ পাচ্ছেন না এমন হওয়ার কথা নয়। হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহ রয়েছে। চিকিৎসকদের হাসপাতালের ওষুধই লেখার কথা। তবে প্রয়োজনে দুই একটা ওষুধ বাইরের লিখতেই পারেন। এ বিষয়ে হাসপাতালের সব কনসালট্যান্টদের বলা রয়েছে, ওষুধ সরবরাহ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা হাসপাতালের ওষুধই যেন লেখেন। সেই সাথে রোগীদের ছুটি পরবর্তী প্রেসক্রিপশনেও হাসপাতালের ওষুধই যেন দেয়া হয়।

হাসপাতালের মধ্যে ও চিকিৎসকের কক্ষের বাইরে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অবস্থানের বিষয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা সপ্তাহের দুই দিন শুধুমাত্র রোববার ও বুধবার বেলা ১টা থেকে ২টা পর্যন্ত চিকিৎসকদের সাথে সাক্ষাৎ করতে পারবেন। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের জন্য হাসপাতালের দুই ভবনের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসকদের সাথে সাক্ষাতের দিন ও সময় নির্ধারণ করে লেখাও আছে।’

উল্লেখ্য, ২০২১ সালের নভেম্বরের ২২ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. শাহাদৎ হোসেন মাহমুদ উপস্থাপিত এক গবেষণায় জানা যায়, দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে মাত্র ৩ শতাংশ রোগী ওষুধ এবং ১৪.৯ শতাংশ রোগী পরীক্ষা-নিরীক্ষা পেয়ে থাকেন। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতাল থেকে সেবাগ্রহণকারী ৯৭ শতাংশ রোগীকে টাকা খরচ করে ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনতে এবং ডায়াগনস্টিক ল্যাব থেকে সেবা নিতে হয়। ফলে রোগীর ব্যয় বেড়ে যায় এবং রোগীরা আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top