৩০ বছর ফেরার ছিলেন যে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’, অভিনয় করেছেন ২৮টি চলচ্চিত্রে

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৯ আগস্ট ২০২২ ০৬:১৭; আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪ ০২:৪৬

ছবি : সংগৃহীত

ওম প্রকাশ—পাশা নামেও পরিচিত। তার নামটা পাওয়া যাবে ভারতের হরিয়ানা রাজ্য পুলিশের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' অপরাধীদের তালিকায়।

ডাকাতি ও খুনের অভিযোগে গত ৩০ বছরে ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক এই সদস্যকে খুঁজছিল পুলিশ। অথচ এই তিন দশক সবার চোখের সামনে পার্শ্ববর্তী উত্তর প্রদেশেই লুকিয়ে ছিলেন—কেউ কিছু ধরতেই পারেনি।

উত্তর প্রদেশে তিনি সরকারি কাগজপত্র নিয়ে সম্পূর্ণ নতুন জীবন শুরু করেছেন। বিয়ে করেছেন সেখানকার স্থানীয় এক নারীকে। তিনটি সন্তানও আছে তাদের সংসারে।

কিন্তু অবশেষে এই সপ্তাহের গোড়ার দিকে তার ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন ভাগ্যদেবী। গাজিয়াবাদ শহরের এক বস্তি থেকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে ৬৫ বছর বয়সি এই অভিযুক্তকে।

উত্তর প্রদেশে ওম প্রকাশ একটা ট্রাক নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন আর ধর্মীয় উৎসবে নিজের দলবল নিয়ে ভক্তিগীতি গাইতেন। একেক সময়ে তার মাথায় থাকত একেক ধরনের হ্যাট। কম বাজেটের ২৮টি স্থানীয় চলচ্চিত্রে অভিনয়ও করেছেন তিনি!

ওম প্রকাশ এখন পুলিশি হেফাজতে আছে। নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। তবে তাকে গ্রেপ্তার করা পুলিশ টিমের সদস্য, হরিয়ানার স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের (এসটিএফ) সাব-ইন্সপেক্টর বিবেক কুমার বিবিসিকে জানিয়েছেন, ১৯৯২ সালে সংঘটিত এক খুনে ওম প্রকাশের জড়িত থাকার যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি সেটিকে মিথ্যা দাবি করছেন।

ওম প্রকাশের স্ত্রী রাজকুমারী। তাদের তিন সন্তান। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছেলের বয়স ২১, আরেক মেয়ের বয়স ১৪। বিবিসি সম্প্রতি কথা বলে তাদের সঙ্গে।

রাজকুমারী জানান, তার স্বামীর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো শুনে তারা যে ধাক্কা খেয়েছেন, তা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। ওম প্রকাশের কথিত 'অতীত অপরাধ' সম্পর্কে তারা কিছুই জানতেন না। তাই এসব নতুন খবর হজম করতে তাদের কষ্ট হচ্ছে।

তবে ওম প্রকাশের পরিবারও তার পক্ষে ভালো কিছু বলেননি। তার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ আনলেন তারাও। রাজকুমারী বলেন, 'তাকে আমি ১৯৯৭ সালে বিয়ে করি। ও যে আগেই বিবাহিত এবং হরিয়ানায় তার যে পরিবার আছে, এ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না।'

কে এই ওম প্রকাশ? তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ?
বিবেক কুমার জানান, হরিয়ানার পানিপাত জেলার নারায়না গ্রামের বাসিন্দা ওম প্রকাশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কর্পসে ১২ বছর ট্রাক ড্রাইভারের চাকরি করেছেন। এরপর ১৯৮৮ সালে চার বছর কার্যক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকার জন্যে চাকরি থেকে বরখাস্ত হন।

ওই হত্যাকাণ্ডের আগেও ওম প্রকাশের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার আইনভঙ্গের অভিযোগ ওঠে। ১৯৮৬ সালে একটি গাড়ি এবং এর চার বছর পর একটি মোটরবাইক, সেলাই মেশিন ও স্কুটার চুরির অভিযোগ আসে তার বিরুদ্ধে। চুরিগুলো হয় বিভিন্ন জেলায়। এসব চুরির কয়েকটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। পরে তিনি জামিনে বেরিয়ে আসেন।

বিবেক কুমার বিবিসিকে বলেন, ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে একজন সঙ্গী নিয়ে ওম প্রকাশ বাইকে ভ্রমণকারী এক লোকের কাছ থেকে ডাকাতির চেষ্টা করেন।

'লোকটি বাধা দিলে তারা তাকে ছুরিকাঘাত করেন। এরপর একদল গ্রামবাসীকে ছুটে আসতে দেখে তারা নিজেদের স্কুটার ফেলে পালায়,' বিবিসিকে বলেন বিবেক কুমার।

ওম প্রকাশের সঙ্গী ধরা পড়েন বলে জানান বিবেক কুমার। সাত বছর জেল খাটার পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। অন্যদিকে পুলিশ ওম প্রকাশকে 'ঘোষিত অপরাধী' ঘোষণা করে। এরপর তার ফাইলে ধুলোর আস্তর জমতে থাকে।

পুলিশ বলছে, ওম প্রকাশ তাদের জানিয়েছেন যে ওই হত্যাকাণ্ডের পর প্রথম বছর তিনি দক্ষিণ ভারতের দুই রাজ্য তামিলনাড়ু ও অন্ধ্র প্রদেশের বিভিন্ন মন্দিরে থেকেছেন।

এক বছর পর ওম প্রকাশ উত্তর ভারতে ফেরেন। কিন্তু বাড়িতে না গিয়ে তিনি ১৮০ কিলোমিটার দূরের গাজিয়াবাদে আবাস গাড়েন। সেখানে ট্রাক চালানোর কাজ শুরু করেন।

রাজকুমারী জানিয়েছেন, গাজিয়াবাদে তার স্বামী বজরং বলি বা বজরঙ্গী নামে পরিচিত। ১৯৯০-এর দশকে ওম প্রকাশ চলচ্চিত্রের ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ডার (ভিসিআর) বিক্রি ও ধার দেয়ার দোকান চালাতেন। সেনাবাহিনীতে কাজ করার সুবাদে অনেকে তাকে 'ফৌজি তাউ', অর্থাৎ সৈনিক চাচা বলেও ডাকত।

২০০৭ সাল থেকে তিনি স্থানীয় হিন্দি ভাষার চলচ্চিত্রে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করছেন। গ্রামপ্রধান, খলনায়ক, এমনকি পুলিশ কনস্টেবলের চরিত্রেও অভিনয় করেছেন তিনি। তার একটি মুভি—তাকরভ—ইউটিউবে ৭.৬ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে। ফিল্মটির বিভিন্ন ক্লিপ আরও কয়েক মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে।

বিবেক কুমার জানান, 'তিনি সম্পূর্ণ নতুন সরকারি নথি, যেমন ভোটার কার্ড ও আধার কার্ড জোগাড় করেছেন।'

কিন্তু ওম প্রকাশ একটা মারাত্মক ভুল করে ফেলেন। নতুন নথিতে তিনি নিজের ও বাবার আসল নামই রেখে দেন। এতেই ধরা পড়েন তিনি।

রাজকুমারীর গল্প
পুলিশ একমত যে, ওম প্রকাশের নতুন পরিবার কিংবা তার প্রতিবেশী—কেউই তার 'অতীত অপরাধ' সম্পর্কে কিছু জানত না।

রাজকুমারী বলেন, বিয়ের পরই তিনি টের পেয়েছিলেন, ওম প্রকাশ কিছু একটা লুকাচ্ছেন।

ওম প্রকাশ তাকে নারায়না গ্রামে নিয়ে গিয়ে নিজের ভাই ও পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। রাজকুমারীকে বলেন, পরিবারের ওই সদস্যরা তার বন্ধু।

এর কয়েক বছর পরই ওম প্রকাশের প্রথম স্ত্রী গাজিয়াবাদে এসে তাদের বাড়ির সামনে হইহল্লা শুরু করেন। তখনই রাজকুমারী তার স্বামীর আগের বিয়ে সম্পর্কে জানতে পারেন।

'ওই সময় আমি আর আমাদের প্রতিবেশীরা জানতে পারলাম, ওর আরেকটা জীবন আছে। আছে একজন স্ত্রী আর এক ছেলে। এই সবকিছুই ও আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিল। আমাদের বলা হচ্ছিল, ও আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।'

রাজকুমারী জানান, দাম্পত্য জীবনে ওম প্রকাশ প্রায়ই দীর্ঘ দিনের জন্য উধাও হয়ে যেতেন। তিনি ভেবেছিলেন, স্বামী যেহেতু দূরপাল্লার ট্রাক চালক হিসেবে কাজ করে, তাই এতদিন বাইরে থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন তিনি নিশ্চিত, ওম প্রকাশ ওই সময় তার প্রথম পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যেতেন।

এক পর্যায়ে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। নিয়মিত ঝগড়া হতে থাকে এ দম্পতির মাঝে। এরপর ২০০৮ সালে ফের উধাও হয়ে যান ওম প্রকাশ।

রাজকুমারী বলেন, 'আমি এতই বিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম যে ওর সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করি। একটি স্থানীয় সরকারি অফিসে গিয়ে লিখিতভাবে অঙ্গীকারনামা দিই যে ওর সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু সাত বছর পর ও ফিরে আসে; বারবার দেখা করতে থাকে।'

ওম প্রকাশের ১৪ বছর বয়সি মেয়ে বিবিসিকে বলে, 'উনি আমাদের গালাগাল করতেন। তবে যখনই আসতেন, তাকে আমরা করুণা করে খেতে দিতাম। কারণ উনি আমাদের বাবা এবং বয়স্ক মানুষ।'

রাজকুমারী জানান, এর আগে একবার হরিয়ানা পুলিশ একটি চুরির মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে ওম প্রকাশকে আটক করেছিল।

'ও তখন ছয়-সাত মাস জেল খাটে। কিন্তু ফিরে এসে আমাদের বলে যে ও সমস্ত অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছে,' বলেন তিনি।

হরিয়ানায় একবার গ্রেপ্তার হওয়া সত্ত্বেও ওম প্রকাশের নাম হত্যা মামলায় পলাতকদের তালিকাতেই থেকে যায়। কারণ একে তো পুলিশের অধিকাংশ রেকর্ডই ডিজিটাইজড নয়, তার ওপর এক জেলার পুলিশ সাধারণত অন্য জেলার পুলিশের সঙ্গে কথা বলে না বা তথ্যও ভাগাভাগি করে না।

কীভাবে সন্ধান মিলল?
২০১৯ সালে মূলত সংঘবদ্ধ অপরাধ, মাদকদ্রব্য আটক, সন্ত্রাস ও রাজ্যের সীমানা পাড়ি দেওয়া-সংক্রান্ত বিষয়গুলো তদারকির জন্য হরিয়ানায় স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) গঠন করা হয়। এর এক বছর পর ওম প্রকাশের ফাইলটি আবার খোলা হয়।

ওম প্রকাশকে এসটিএফের 'মোস্ট ওয়ান্টেড' তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তাকে ধরতে যেকোনো তথ্যের জন্য ২৫ হাজার রুপি পুরস্কার ঘোষণা করে এসটিএফ।

অতীতেও বহু বছর ধরে ফেরার অপরাধীদের গ্রেপ্তার করার ঘটনা ঘটতে দেখা গেছে। তবে গাজিয়াবাদে অপরাধ-কাহিনির সন্ধানে বহু বছর কাটানো ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর সিনিয়র সাংবাদিক আমিল ভাটনগর বলেন, 'পুলিশ সাধারণত তখনই ঝিমিয়ে পড়া মামলাগুলো পুনরায় চালু করে যখন সেগুলো সন্ত্রাসবাদ বা সিরিয়াল খুনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে বা যদি তারা কোনো গোপন তথ্য পায়।' এসটিএফ কেন এই মামলাটি পুনরায় তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নিইয়েছিল, তা পুরোপুরি স্পষ্ট নয়।

তবে দুমাস আগে পুলিশ নারায়না গ্রামে গিয়ে ৫০ ও ৬০-এর কোঠায় যাদের বয়স তাদের সঙ্গে কথা বলে। উদ্দেশ্য, তাদের কাছ থেকে ওম প্রকাশের ব্যাপারে তথ্য উদ্ধার।

ওই গ্রামেই পুলিশ প্রথম সূত্র পেয়ে যায়। জানতে পারে, ওম প্রকাশ প্রায় দুই দশক আগে একবার গ্রামে এসেছিলেন এবং তিনি উত্তরপ্রদেশের কোথাও থাকতে পারেন।

নারায়না গ্রামে দ্বিতীয় সফরে ওম প্রকাশের নামে নিবন্ধিত একটি ফোন নম্বর খুঁজে পায় পুলিশ। তার সূত্র ধরেই অবশেষে তার নতুন ঠিকানা খুঁজে পায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

বিবেক কুমার জানান, পুলিশ পুরো এক সপ্তাহ রেকি করে ওম প্রকাশের বাড়ি খুঁজে বের করে। আর তাদের কাছে ওম প্রকাশের একমাত্র যে ছবিটি ছিল, সেটিও ৩০ বছরের পুরোনো। এই তিন দশকে মধ্যে তার চেহারা অনেক বদলে গেছে। তাই তাকে শনাক্ত করতে বেগ পেতে হয়েছে।

বিবেক কুমার বলেন, 'অপারেশনটি অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে পরিচালনা করা হয়, কারণ আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম যে মাত্র একটা ভুল পদক্ষেপেই আরেকবার তিনি ৩০ বছরের জন্য উধাও হয়ে যাবেন।'

এবার কী?
এতদিন ধরে পলাতক এক আসামিকে গ্রেপ্তার করাটাকে এসটিএফের বিজয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে আমিল ভাটনগর বলছেন, পুলিশের কঠিন লড়াই এখন শুরু হবে।

'পুলিশকে আদালতে প্রমাণ করতে হবে যে তারা আসল মানুষটাকেই ধরেছে। আর আদালতকেও নিবিড়ভাবে পরীক্ষা করতে হবে যে তিনিই আসল ব্যক্তি কি না এবং তার বিরুদ্ধে যেসব অপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে সেসব তিনি করেছেন কি না,' বলেন তিনি।

আমিল ভাটনগর আরও বলেন, অপরাধটি যেহেতু কয়েক দশক আগে সংঘটিত হয়েছে, তাই প্রমাণের গুণমানের উপরও আলাদা মনোযোগ দেওয়া হবে।

পুলিশ ও প্রসিকিউশনের জন্য নিরেট কেস দাঁড় করানো কঠিন কাজ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

রাজকুমারীকে বিবিসি প্রশ্ন করেছিল, ওম প্রকাশ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার সঙ্গে তারা দেখা করার চেষ্টা করেছেন কি না।

রাজকুমারী বলেন, 'পুলিশ বলছে তার সঙ্গে দেখা করতে হলে আমাদের পরিচয়পত্র জমা দিতে হবে। কিন্তু আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই না। কী লাভ হবে দেখা করে?'



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top