স্বল্প বেতনে জীবনযুদ্ধ শিক্ষকদের

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৫ অক্টোবর ২০২২ ২৩:০৭; আপডেট: ১১ মে ২০২৪ ১৩:২৭

ছবি: সংগৃহিত

এই যেন নিত্যদিনের সংগ্রাম। একদিকে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি অন্যদিকে স্বল্প বেতন৷ এভাবেই বেঁচে থাকার লড়াইয়ে নেমেছেন সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। খবর টিবিএসের।

সরকারি মজুরি বোর্ডের গ্রেড-১৩-এর অধীনে একজন সহকারী শিক্ষক মাসে বেতন পান মাত্র ১৭ হাজার ৫০০ টাকা; অন্যদিকে, একজন প্রধান শিক্ষক পান মাত্র ১৯ হাজার টাকা।

যদিও উভয় পদের জন্যই একজনকে তিন বছর মেয়াদী ডিগ্রী সম্পন্ন করতে হবে অথবা একটি অনার্স সার্টিফিকেট থাকতে হবে। অথচ কেবল হাই স্কুলের সার্টিফিকেট নিয়েও অন্যান্য পেশার বিভিন্ন পদের প্রারম্ভিক বেতন একই বা এরচেয়েও বেশি।

বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা মাসের সাড়ে ১২ হাজার টাকা বেতন পান, এই টাকার আবার ১০ শতাংশ কেটে নেওয়া হয় অবসরকালীন সুবিধা জন্য।

সরকার অবশ্য সর্বশেষ ২০২০ সালে বেতন বাড়িয়েছিল; তবে সেখানে ইনক্রিমেন্ট ছিল মোটামুটি ১ হাজার টাকার মতো।

এমপিও (মান্থলি পে অর্ডার) তালিকাভুক্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শহিদুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন পিয়নদের বেতনের তুলনায়ও কম।

তিনি বলেন, "আমরা এখনও দেশে তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী। আমাদের সামাজিক মর্যাদা পর্যন্ত নেই। আমরা স্বচ্ছল নই। আমরা ক্ষুধার্ত থেকে কীভাবে মানসম্মত শিক্ষা দেবো? সরকারের উচিত আমাদের প্রথম শ্রেণীর চাকরিজীবীদের মর্যাদা দেওয়া।"

বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি নজরুল ইসলাম রনি টিবিএসকে জানান, সংগঠনটি বেতন বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে আসছে বহুদিন, কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখনও এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।

"শিক্ষকরা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলে। শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা না দেখিয়ে আমরা কীভাবে মানসম্মত শিক্ষা আশা করতে পারি?," বলেন নজরুল।

বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সদস্য সচিব মোহাম্মদ শামসুদ্দিন মাসুদ বলেন, সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেতন বৃদ্ধিসহ ৭ দফা দাবি আদায়ে আন্দোলনে নেমেছেন।

কিন্তু দাবিগুলো এখনও আলোর মুখ দেখেনি, এই বছর অন্তত সেই সম্ভাবনাও নেই।

এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি টিবিএসকে বলেন, এই মুহূর্তে বেতন বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। তবে ৩০০ টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়েছে এবং এই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ আমিনুল ইসলাম খান টিবিএসকে জানান, মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১৪ থেকে ১৩ তে উন্নীত করেছে এবং এ বছর আর বেতন বৃদ্ধি হবে না।

এমনকি আঞ্চলিক তুলনার ক্ষেত্রেও, বাংলাদেশের তুলনায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে শিক্ষকদের বেতন অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ, ভারতে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক শুরুতে প্রায় ৩৬ হাজার টাকা বেতন পান।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ বলেন, সরকারকে শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে, তা না হলে শিক্ষার মান ব্যাহত হবে।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেতন-ভাতার জন্য ঐতিহাসিকভাবে সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেতন ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ছিল মাসে ১৩৫ টাকা; জাতীয়করণের পর তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২৩০ টাকা।

এরপর, ১৯৮৫ সালে ৪৩০ টাকায় উন্নীত হয় শিক্ষকদের বেতন।

২০০৫ সালে প্রধান শিক্ষকরা ১৩তম গ্রেড এবং সহকারী শিক্ষকরা ১৫ম গ্রেডের অধীনে বেতন পেতে শুরু করেন।

তবে ২০১৬ সালে প্রধান শিক্ষকদের ১২তম গ্রেডের অধীনে আনা হলেও সহকারী শিক্ষকদের গ্রেডে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।

শিক্ষকবিহীন শ্রেণিকক্ষ

শিক্ষকরা জানান, এই মন্দার মধ্যে তাদের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। এমনকি, অনেকে পরিবারের মৌলিক চাহিদাও মেটাতে ব্যর্থ হচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতির কারণে শিক্ষকতায় আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে মানুষ। অনেকেই আবার শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছে।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের তথ্যমতে, করোনা মহামারি চলাকালীন প্রায় ৪০ শতাংশ শিক্ষক পেশা ত্যাগ করেছিলেন; পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ আবারও ফিরে এসেছেন।

বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের সভাপতি ইকবাল বাহার চৌধুরী পেশা বদল করা শিক্ষকদের বিষয়ে বলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই এখন ভালো অবস্থানে আছেন।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সরকার ৩৪তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষার মাধ্যমে ৮৯৮ জন এবং ৩৬তম বিসিএসের মাধ্যমে ৩৫০ জন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। তারা সবাই নন-ক্যাডার, 'ক্লাস টু' সরকারি কর্মচারী।

উল্লেখযোগ্যভাবে, তাদের মধ্যে অন্তত ৬০ শতাংশ প্রধান শিক্ষকের চাকরি ছেড়ে অন্য সরকারি চাকরি নিয়েছেন। কেউ কেউ একই গ্রেডের অন্য পদেও যোগ দিয়েছেন বলে জানায় সূত্র।

এমন একজন হলেন শেখ আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে শিল্প মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেছেন।

মামুন বলেন, "আমি দেখেছি, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের তুলনায় দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা অন্যান্য সরকারি সেক্টরে বেশি সুযোগ-সুবিধা ও মর্যাদা ভোগ করেন। তাই আমি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়েছি।"

মেধাবী শিক্ষকরা বিদায় নিতে শুরু করায় ব্রেইন ড্রেন দেশের শিক্ষা খাতকে অনেকটা বিপদের মুখে ফেলেছে।

ওয়ার্ল্ডওয়াইড এডুকেটিং ফর দ্য ফিউচার ইনডেক্স ২০১৯ অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন দক্ষতা-ভিত্তিক শিক্ষার ক্ষেত্রে কেবল কেনিয়া, নাইজেরিয়া এবং ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর থেকে এগিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, পুরো বিশ্ব থেকে বাংলাদেশ কতটা পিছিয়ে।

দেশে নার্সারি স্কুলসহ প্রায় ৫৫ হাজার বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেখানে প্রায় ৮ লাখ শিক্ষক নিয়োজিত আছেন।

সারা দেশে মোট ১ লাখ ৩৩ হাজার ৯০১টি সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে, যেখানে শিক্ষক নিযুক্ত রয়েছেন ৬ লাখ ২৩ হাজার ৯৬৪ জন ।

এই বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৬৫ হাজার সরকারি বিদ্যালয়, যেখানে ৩ লাখ ৭০ হাজার ১২৯ জন শিক্ষক নিযুক্ত আছেন।

'শিক্ষকদের দিয়েই শিক্ষার রূপান্তর শুরু' (দ্য ট্রান্সফরমেশন অফ এডুকেশন বিগিন্স উইথ টিচার্স)- এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এ বছর বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপিত হবে।

অবসরের পরও নেই অবকাশ

প্রায় ৫৩ হাজার অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী এখনও তাদের অবসরকালীন সুবিধা পাননি।

বেসরকারী কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ডের (এনজিইআরবিবি) কাছে মোট ৩১ হাজার আবেদন এখনো জমা পড়ে আছে। এসব আবেদনকারীদের অর্থ প্রদানের জন্য অবসর বোর্ডের কমপক্ষে ৩ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন।

অবসর বেনিফিট বোর্ডের কর্মকর্তা মারুফ হোসেন বলেন, "অবসরকালীন সুবিধার চেক প্রক্রিয়া করতে প্রায় তিন মাস সময় লাগার কথা। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, এখন এতে সময় লাগছে প্রায় তিন বছর।"

বেসরকারি শিক্ষক ও কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্টের (এনজিটিইডব্লিউটি) সূত্র জানিয়েছে, অবসর সুবিধা পেতে তাদের কাছে প্রায় ২২ হাজার আবেদন মুলতুবি রয়েছে। এগুলো মেটাতে অন্তত ২ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন।

কল্যাণ বোর্ডের সদস্য সচিব মোঃ শাহজাহান আলম সাজু টিবিএসকে বলেন, "বোর্ড একটি বিশেষ তহবিলের জন্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে। আমরা এ সংকট সমাধানের চেষ্টা করছি।"

নিউজের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top