দেশের ৩২১টি প্রকল্পে সূক্ষ্ম প্রতারণা

রাজটাইমস ডেস্কজগ | প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০২২ ২২:৩৪; আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ০৭:০৯

ফাইল ছবি

দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে চলছে দীর্ঘসূত্রিতা। নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে না পারায় বাড়ছে নানা খরচও। ২০২১-২২ অর্থবছরে ব্যয় ছাড়া মেয়াদ বৃদ্ধি সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ বাড়ানোর নামে চলছে এক ধরনের সূক্ষ্ম প্রতারণা। খবর যুগান্তরের।

এসব ক্ষেত্রে প্রকল্পের মোট ব্যয় না বাড়লেও থেমে থাকে না আনুষঙ্গিক নানা খরচ। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ প্রায় ২২ ধরনের ভাতা বহাল থাকে। সেই সঙ্গে মেরামত, সংস্কার, গাড়ি ভাড়া, জ্বালানি ও অফিস ভাড়াসহ নানা খরচ হতেই থাকে। তারপরও সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয় ‘ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ বৃদ্ধি’।

আপাতদৃষ্টিতে এটাকে দোষণীয় মনে না করে অনুমোদনের সুপারিশ দিয়ে যাচ্ছে পরিকল্পনা কমিশন। ২০২১-২২ অর্থবছরে এরকম ৩২১টি প্রকল্প ব্যয় ছাড়াই মেয়াদ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ৬ মাস থেকে শুরু করে ৩ বছর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এটাকে প্রকল্প সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদনের একটা কৌশল বলা যায়। এমন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে প্রতারণা করা হয়ে থাকে। কেননা মেয়াদ একবার বাড়ালে পরবর্তীকালে আবার ব্যয় বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়। ব্যয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালানের সময় পান প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। কোনো কোনো সময় মেয়াদ বাড়ানোর পর ব্যয় বৃদ্ধিতে বাধ্যও করা হয়ে থাকে। তবে মৌলিক প্রশ্ন হচ্ছে, প্রকল্পের মেয়াদ এত বাড়াতে হবে কেন? কোনো ক্ষেত্রে যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে। তাই বলে এত প্রকল্প কেন?

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ঢালাও ভাবে প্রতারণা বলা যাবে না। কোনো কোনো প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে। তবে ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়াদ বাড়লেও খরচ কিন্তু থেমে থাকে না। এক্ষেত্রে যদি বলা হয় খরচ বৃদ্ধি ছাড়াই মেয়াদ বৃদ্ধি তাহলে তো কেউ প্রকল্প চালাবেই না। এক্ষেত্রে প্রকল্পের থোক বরাদ্দ কিংবা অন্য কোনোভাবে বেঁচে যাওয়া অর্থ চলমান কার্যক্রমগুলোতে ব্যয় করা হয়। পরিকল্পনা কমিশন ও আইএমইডির উচিত বিষয়টি আরও ভালোভাবে দেখে তারপরও সুপারিশ দেওয়া।

সম্প্রতি আইএমইডির প্রকাশিত এক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত অর্থবছরে ৩২১টি প্রকল্পে ব্যয় না বাড়িয়ে মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯১টি ছিল সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা স্থানীয় সরকার বিভাগের ছিল ৫১টি প্রকল্প। তৃতীয় স্থানে রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের ৩০টি। এছাড়া অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আছে ২১টি করে প্রকল্প। গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১৫টি, নৌ-পরিবহণ মন্ত্রণালয়ের ১১টি, শিক্ষা ও তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের ছয়টি করে এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের আছে পাঁচটি প্রকল্প। এছাড়া শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাতটি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পাঁচটি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের চারটি এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের চারটি প্রকল্প। আরও আছে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তিনটি প্রকল্প। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের চারটি, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের তিনটি, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের তিনটি এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের তিনটি প্রকল্প। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তিনটি, কৃষি মন্ত্রণালয়ের তিনটি এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তিনটি প্রকল্প। দুটি করে প্রকল্প রয়েছে সুরক্ষা ও সেবা বিভাগ, সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। একটি করে রয়েছে পাঁচ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের।

সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, টাকা চাইতে গেলে তো সেটি সরকার দেবে না। সেই সঙ্গে থাকে নানা ফ্যাকড়া। সেজন্যই শুধু মেয়াদ বাড়ানোটা সহজ হয়। পরে কন্টিজেন্সি খাতের টাকাসহ অন্য কম্পোনেন্ট থেকে কাটছাঁট করে জরুরি ব্যয় মেটানো হয়। এটা এক ধরনের সংসারের মতোই। এদিক-ওদিক থেকে টানাটানি করে খরচ করতে হয়। তিনি জানান সড়কের প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাস্তবতার মধ্যে ব্যাপক ফারাক থাকে। পরামর্শক যারা প্রকল্প তৈরি করেন তারা নানা ধরনের ভুল করে থাকেন। এজন্য পরে মাঠে কাজ করতে গেলে সংশোধনের বিকল্প থাকে না।

সূত্র জানায়, যে কোনো উন্নয়ন প্রকল্পে সম্পৃক্ত থাকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। তাদের নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা ও বেতন-ভাতার জন্য ব্যয় করতে হয় মোটা অঙ্কের অর্থ। সাধারণত একটি প্রকল্পে রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের বাইরেও থাকে প্রায় ২২ ধরনের ভাতা। এগুলো হলো বাড়ি ভাড়া ভাতা, শ্রান্তি ও বিনোদন ভাতা, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, টিফিন ভাতা, যাতায়াত ভাতা, শিক্ষা ভাতা, মোবাইল/সেলফোন ভাতা, অন্যান্য ভাতা এবং ভ্রমণ ভাতা। আরও থাকে আবাসিক টেলিফোন ভাতা, অধিকাল ভাতা, সম্মানি ভাতা, বাংলা নববর্ষ ভাতা, কোয়ালিফিকেশন পে, নিযুক্তি বেতন, উচ্চায়ন বেতন, এসএসজি পে, বিবাহ পে, পোশাক ভাতা, ক্ষতিপূরণ ভাতা, ব্যাটম্যান ভাতাসহ নানা ভাতা। সেইসঙ্গে আনুষঙ্গিক বিভিন্ন খরচের মধ্যে থাকে অফিস ভাড়া, টেলিফোন বিল, গাড়ি পরিচালনা, ড্রাইভারের বেতন, গ্যাস ও জ্বালানি বিল, বিদ্যুৎ বিল, পেট্রোল-ওয়েল ও লুব্রিকেন্ট বিল এবং অফিস ব্যয়সহ নানামুখী ব্যয়। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লে এ ধরনের ব্যয় চলমান থাকে। কিন্তু প্রকল্পের সংশোধনী প্রস্তাবের সময় সেটি আমলে নেওয়া হচ্ছে না।

আইএমইডির সচিব আবু হেনা মোর্শেদ জামান যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি সে রকম নয়। অনেক প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর ক্ষেত্রে যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে। তবে অনেক প্রকল্প রয়েছে সেগুলোতে নানা ত্রুটি, সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা ও অদক্ষতাও থাকে। সেক্ষেত্রে প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেরি হলে যথাসময়ে সুফল বঞ্চিত হয় ওই সংশ্লিষ্ট জনগণ।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রকল্পের অনুমোদিত মোট ব্যয় কখনওই তারা বর্ধিত সময়ে বাড়িয়ে খরচ করতে পারবে না। ওই ব্যয়ের ভেতরেই যেসব ব্যয় চলমান না রাখলে হয় না সেগুলো করে থাকে। এটাকে প্রতারণা বলা যায় না। আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই সুপারিশ দিয়ে থাকি।

আইএমইডি সূত্র জানায়, শুধ গত অর্থবছরই নয়, ২০২০-২১ অর্থবছরেও ব্যয় ছাড়া মেয়াদ বেড়েছে ৩৩৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের। এগুলোরও ৬ মাস থেকে সাড়ে ৩ বছর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২৮৪টি প্রকল্পে। প্রত্যেক বছরই এই ধারা অব্যাহত আছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়া মেয়দ বাড়ানো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হচ্ছে-দেশব্যাপী গ্রামীণ বাজার অবকাঠামো উন্নয়ন (প্রথম সংশোধিত) প্রকল্পে বেড়েছে ৩ বছর। চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার সম্প্রসারণ প্রকল্পে বেড়েছে ২ বছর। এছাড়া পূর্বাঞ্চলীয় গ্রিড নেটওয়ার্কের পরিবর্ধন এবং ক্ষমতাবর্ধন প্রকল্পে আড়াই বছর।

আমিন বাজার-মাওয়া-মোংলা ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্পে দেড় বছর। বাংলাদেশ টেলিভিশনের ৬টি পূর্ণাঙ্গ টিভিকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পে দুই বছর। নরসিংদী জেলা কারাগার নির্মাণ প্রকল্পে দুই বছর। চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স স্থাপন প্রকল্পের দুই বছর। ব্যয় ছাড়া মেয়াদে বেড়েছে হাওড় অঞ্চলের বন্যা ব্যবস্থাপনা ও জীবনমান উন্নয়ন (এলজিইডি অংশ) প্রকল্প। এছাড়া রূপগঞ্জের জলসিঁড়ি আবাসন সংযোগককারী অবকাঠামো উন্নয়ন।

বৃহত্তর পটুয়াখালী জেলার গুরুত্বপূর্ণ গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন। চট্টগ্রাম মহানগরীরর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা (১ম পর্যায়) প্রকল্প। রংপুর বিভাগীয় অবকাঠামো উন্নয়ন (২য় পর্যায়) প্রকল্প। কুমিল্লা কারাগার পুনর্নির্মাণ। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিপ মডেল টেস্টিং সেন্টার (টোয়িং ট্যাংক) স্থাপন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত সুবিধাদি ও গবেষণা সক্ষমতা শক্তিশালীকরণ প্রকল্প।

নিউজের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top