আ.লীগের সামনে চতুর্মুখী চ্যালেঞ্জ

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ৯ জানুয়ারী ২০২৪ ১১:১০; আপডেট: ১৮ মে ২০২৪ ১৪:৪৬

ছবি: সংগৃহীত

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে আরও এক মেয়াদের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে বহাল থাকল আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো একটি দল টানা চতুর্থবার সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। একটানা চতুর্থ এবং সব মিলিয়ে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে রেকর্ড গড়তে যাচ্ছেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা।

ধারাবাহিকভাবে চার মেয়াদে দেশের শাসনভার গ্রহণ সরকারের পক্ষে পরিকল্পিত উন্নয়ন ও প্রশাসনিক সংস্কার কাজ এগিয়ে নেওয়া সহজ হবে। তবে বড় জয়ের বড় দায় ও প্রত্যাশা মেটাতে সরকারকে অনেক চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

গত রোববার অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২৯৮টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ এককভাবেই ২২৩টিতে জয়লাভ করেছে। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে ১৪ দলের শরিক জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টির একজন করে জয়ী হয়েছেন। ফলে এবারও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশের পরই শপথ নেবে নতুন সরকার।

হেভিওয়েটদের হারানো সাইফুলের নেপথ্যে কী
বিশ্লেষকদের মতে, নতুন মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ পশ্চিমা বিশ্বের নেতিবাচক মনোভাবের পরিবর্তন ঘটানো। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ইস্যুতে অনেক দিন ধরেই তৎপরতা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ।

সরকারের ওপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টিরও চেষ্টা করেছে তারা। নির্বাচন প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য আলাদা ভিসা নীতিও ঘোষণা করে। বিএনপিকে ছাড়াই অনুষ্ঠিত নির্বাচন ও নতুন সরকার সম্পর্কে মার্কিনিদের প্রতিক্রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে, নতুন মেয়াদের শুরুতেই সরকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের ইতিবাচক মনোভাব অর্জনে তৎপর হতে হবে। একই সঙ্গে চীন, ভারত, রাশিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। ফলে সব ধরনের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা এই মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়—এই নীতিকে আরও প্রসারিত করতে হবে। এটা পরিষ্কার করতে হবে যে, পররাষ্ট্রনীতি যেহেতু উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্ক, এখানে সামরিক কোনো কাঠামোর মধ্যে ঢোকার প্রশ্ন উঠছে না। কোনো নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে আবদ্ধ হওয়ার প্রশ্ন উঠছে না। কারণ, এক নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে ঢুকলেই আরেক বলয় অসন্তুষ্ট হবে। সেক্ষেত্রে উন্নয়নও ব্যাহত হবে। তাই নিজেদের স্বার্থ বিবেচনা করে সবার সঙ্গে উন্নয়নের সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে।’

সরকারের সামনে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হলো সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা। নির্দলীয় সরকারের দাবিতে নির্বাচন বর্জন করে আন্দোলনের মাঠে আছে বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল। ভোট ঠেকানোর ঘোষণা দিয়ে টানা হরতাল-অবরোধ পালন করলেও নির্বাচনের আগ মুহূর্তে অনেকটাই নমনীয় ছিল তারা।

সাধারণ মানুষকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করার মধ্যেই সীমিত ছিল তাদের তৎপরতা। সার্বিকভাবে ভোটার উপস্থিতি তুলনামূলক কম হওয়ায় এখন নির্বাচনকে বিতর্কিত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে তারা। ভোটের হার ছাড়াও অনিয়মের নানা তথ্য, ছবি ও ভিডিও আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরার চেষ্টা করবে বিরোধীরা। সেসঙ্গে নতুন করে আন্দোলন কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে সরব হতে পারে তারা।

আগামী পাঁচ বছর সরকারের কাজের মধ্য দিয়েই নির্বাচন নিয়ে ওঠা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সরকার এবং সংসদ সদস্যদের সামগ্রিক কর্মকাণ্ডে প্রমাণ করতে হবে, আসলেই তারা এত বড় ম্যান্ডেট পাওয়ার যোগ্যতা রাখেন। বড় বিজয়ের দায়ও অনেক বড়—এই মনোভাব নিয়েই আগামী পাঁচ বছর আওয়ামী লীগকে পথ চলতে হবে।

তবে নির্বাচন ঘিরে দলের তৃণমূলে তৈরি হওয়া বিভক্তি নিরসন করতে না পারলে সেই পথচলা মসৃণ হবে না। বিএনপিসহ বেশ কিছু দল অংশ না নেওয়ায় এবার দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার পথ উন্মুক্ত করে দেয় আওয়ামী লীগ। সেই সুযোগে নৌকার প্রার্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামেন দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের পদধারী নেতারা। জয়লাভের জন্য উভয়পক্ষই ছিল মরিয়া। ফলে কোথাও কোথাও এই দ্বৈরথ সংঘাত-সংঘর্ষে রূপ নেয়। অনেকক্ষেত্রে আগে থেকেই চলে আসা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এ নির্বাচনে চরম আকার ধারণ করেছে। শেষ পর্যন্ত অর্ধশতাধিক আসনে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে হেরেছে নৌকা। অনেক জায়গায় প্রবল লড়াই করেও অল্প ভোটে হেরেছেন স্বতন্ত্ররা। জয়-পরাজয়ে ভোটের লড়াই শেষ হলেও নির্বাচনকেন্দ্রিক এই বিভক্তি সহজে নিরসন হবে না। এ অবস্থায় দলকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে কার্যকর সাংগঠনিক উদ্যোগ নিতে হবে।

এসব ছাপিয়ে সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। বৈশ্বিক মন্দাসহ নানা কারণে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে সাধারণ মানুষের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডলার সংকট, আমদানি-রপ্তানিতে শ্লথগতি, ব্যাংক খাতে নানা সমস্যা, পুঁজিবাজারে মন্দা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভসহ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা দিয়েছে শঙ্কা। এই পরিস্থিতি উত্তরণে দরকার কার্যকর নীতি এবং দক্ষ ও সক্রিয় নেতৃত্ব। নতুন মেয়াদে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে—তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ অনকে দূর এগিয়েছে। বিশেষ করে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অভাবনীয়। স্বাধীনতার পর এই প্রথম বাংলাদেশ পরিকল্পিত উন্নয়নের পথে ধাবিত হয়েছে। স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। আগামী পাঁচ বছর সরকারকে এই উন্নয়নের সুফল সর্বজনীন করার জন্য কাজ করতে হবে।

প্রবৃদ্ধি অর্জন বা মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে মধ্যম আয়ের শর্ত পূরণ হলেও, এ নিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বসে থাকলে চলেবে না। অর্থনৈতিক দিক থেকে মধ্যম আয়ের মান অর্জনের পাশাপাশি সমাজ, রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বত্রই উন্নতির এই ছোঁয়া দৃশ্যমান হতে হবে। বিশেষ করে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পুরোনো ধ্যান-ধারণার বদল ঘটিয়ে নতুন মানসিকতার প্রমাণ দিতে হবে। রাজনীতিতে সহনশীলতার সংস্কৃতি বাড়াতে হবে। ভিন্নমত গ্রহণের মানসিকতা অর্জন করতে হবে। সমালোচনাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করতে হবে। বৃহৎ শক্তি হিসেবে এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকেই অগ্রণী ভূমিকা রাখতে হবে।

বিশ্লেষকদের মতে, নতুন মেয়াদে শেখ হাসিনা সরকারের মনোযোগের অন্যতম ক্ষেত্র হবে সুশাসন। আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়নের পরও অনিয়ম এবং দুর্নীতি নিয়ে নানা সমালোচনা সইতে হচ্ছে। এবার এ ইস্যুতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদ ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘গত দেড় দশকে দেশের অর্থনৈতিক ও অন্যান্য খাতে যে উন্নয়ন ঘটেছে, তা অব্যাহত রাখার জন্য এখন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আওয়ামী লীগের এ বিজয়ের মধ্যে দিয়ে অর্থনীতিতে অর্জিত অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করে তা আরও সুসংহত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘নতুন সরকারের কর্তব্য হিসেবে অর্থনীতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়টিই সবার আগে আসবে। সবার আগে দরকার সাধারণ মানুষের জীবনে বয়ে চলা কষ্টগুলোকে আরও প্রশমিত করা। সরকারও নিশ্চয় চাইবে নতুন মেয়াদে মানুষকে আরো ভালো কিছু উপহার দিতে। সে ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন রুখতে হবে। নাজুক রিজার্ভ পরিস্থিতির উন্নয়নে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ানোর প্রতি মনোযোগী হতে হবে।

মোটাদাগে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রশ্নে বিশেষ করে ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে সুশাসনের আওতায় আনার ওপর জোর দিতে হবে। কারণ ব্যাংকে খেলাপি ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। টাকা পাচার হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে। হুন্ডি প্রবণতা বাড়ছে। কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। বৈষম্য বেড়ে যাচ্ছে। প্রত্যাশা থাকবে, সরকার সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এই চ্যালেঞ্জগুলো দক্ষ হাতে সুচারুভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হবে।’

তথ্যসূত্র : কালবেলা 




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top