ওমিক্রনের ধাক্কায় ফের ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটনশিল্প

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২১:৫৯; আপডেট: ৫ মে ২০২৪ ২০:১০

সাজেক ভ্যালী, রাঙ্গামাটি। ছবি: সংগৃহীত

করোনা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পর্যটন শিল্পের। এ ক্ষতি পূরণে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ১ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনার ঘোষণা করা হয়। কিন্তু নানা শর্তের জটিলতায় কোনো উদ্যোক্তাই পাননি এ প্রণোদনার ঋণ।

অথচ পর্যটন কেন্দ্রগুলো চালু হওয়ার পর বেশির ভাগ উদ্যোক্তাই অর্থের অভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন-ভাতা দিতে পারছেন না। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলছেন। এরই মধ্যে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রনের ধাক্কায় ফের পর্যটন কেন্দ্রগুলো পর্যটকশূন্য হয়ে পড়তে শুরু করেছে। ফলে আবারও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন পর্যটন উদ্যোক্তারা।

প্রণোদনার ঋণের পরিপত্রে ট্যুর অপারেটর, ট্যুর গাইডসহ পর্যটনের অনেক খাত, উপ খাতের উল্লেখ না থাকায় ব্যাংকগুলো এসব খাতে ঋণ দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। গত ২০২০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জারি হওয়া প্রজ্ঞাপনে প্রণোদনা-সংক্রান্ত ঋণের নির্দেশনা অবিলম্বে কার্যকর করার কথা বলা হয়। কিন্তু ঋণ নেওয়ার জন্য আগের ঋণ পরিশোধের প্রত্যয়ন, ফিন্যান্সিয়াল স্টেটমেন্ট, ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল অ্যাসেসমেন্ট, জমির পর্চা, মিউটেশন অর্ডার শিট, মূল ও বায়া দলিল, হাল খাজনা, হাল আয়কর ও তল্লাশি প্রত্যয়ন, ইঞ্জিনিয়ার ভ্যালুয়েশনসহ অনেক ডকুমেন্ট দিতে হচ্ছে। অথচ ট্যুর অপারেটর, গাইডসহ অনেক খাতে এসব ডকুমেন্ট দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যাংকগুলো নিয়মনীতি মেনেই প্রণোদনার ঋণ দেবে। দেওয়া শর্তগুলো পূরণ করা বেশির ভাগ উদ্যোক্তার জন্য অনেক কঠিন। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক জানিয়েছে, পর্যটন খাতে কেউ আবেদন করার পরও ঋণ না পেয়ে জানালে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ব্যাংকের কোন শর্ত কঠিন, সেটা যদি তারা জানায় তাহলে পর্যালোচনা করে দেখা হবে, সেটি আসলে কঠিন কি না। কোনো শর্ত বাদ বা সংশোধন করতে হলে সেটাও করা হবে। কারণ, প্রয়োজন আছে বলেই এ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার।

ট্যুর অপারেটরদের ঋণ দেওয়ার প্রজ্ঞাপনে বলা আছে, সেবা খাতে এ ঋণ দেওয়া হবে। ট্যুর অপারেটররা তো সেবা দিচ্ছে, অব্যশই তারা এ ঋণ পাবে। যদি প্রজ্ঞাপনের কথা বলে কোনো ব্যাংক ঋণ দিতে না চায়, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংকে অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরিপত্রে নাম উল্লেখ না থাকায় ট্যুর অপারেটরদের ঋণ দিচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এজন্য ট্যুরিজম বোর্ড ও মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করা হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। এসএমই ফাউন্ডেশনও কোনো সহযোগিতা করেনি। ট্যুর অপারেটররা কোনো সুবিধা পায়নি সেখান থেকেও।

করোনা ভাইরাসের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবিলায় ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে শিল্প ও সেবা খাতের প্রণোদনা প্যাকেজটিই ছিল সবচেয়ে বড়। করোনার শুরু থেকে সবচেয়ে বেশি সময় বন্ধ ছিল পর্যটন শিল্প। এ খাতে লোকসান হয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। চাকরি হারিয়েছে কয়েক লাখ মানুষ। বিনা বেতনেও কাজ করেছে হাজার হাজার কর্মচারী। অথচ সরকারের কম সুদে ঋণ সুবিধা পর্যন্ত পায়নি পর্যটনের এই সেবা খাত।

এদিকে থিম বা অ্যামিউজমেন্ট পার্কের মালিকরা বলছেন, দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকায় তাদের অনেক মেশিনারিজ নষ্ট হয়েছে। মেশিনারিজগুলো মেরামত করতে না পেরে বেশির ভাগ মালিক পার্ক ভালোভাবে চালাতে পারছেন না। মেশিনারিজ ঠিক থাকলে এবং পর্যটনকেন্দ্র চালু রাখা গেলে তারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সহজেই দিতে পারবেন।

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, এ ঋণ শুধু কর্মচারীদের বেতন-ভাতার জন্য। আবার এক বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে না পারলে ঋণখেলাপি হয়ে যাবে। অথচ পর্যটন খাত কবে ঘুরে দাঁড়াবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কঠিন শর্তের কারণে তারকা হোটেলের কেউ এ ঋণ পায়নি। এ খাতে ঋণের মোট সুদের হার হবে ৮ শতাংশ। এর মধ্যে উদ্যোক্তাকে দিতে হবে ৪ শতাংশ। সরকার ভর্তুকি হিসেবে দেবে ৪ শতাংশ। ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন হলে বাড়ানো যাবে। সে ক্ষেত্রে সুদের হার ৮ শতাংশ দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা ভোগ করতে হলে ঋণ বিতরণের ১৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে। শুধু বাংলাদেশেই নয় সারা বিশ্বেই একই অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। করোনা শুরুর পর গত প্রায় দেড় বছরে পর্যটনের ১১৫টি উপখাতের মধ্যে মাত্র দুটিতেই ক্ষতি হয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকা। এই বিশাল অঙ্কের ক্ষতি কাটিয়ে কবে এখাত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে—সে বিষয়ে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন পর্যটন খাত সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠানগুলো।

এভিয়েশন খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাদের ক্ষতির পরিমাণ হাজার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। দেশের পর্যটনশিল্পে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, ট্যুর অপারেটর, বিনোদনকেন্দ্র, এভিয়েশন, ক্রুজ শিপসহ প্রায় ১১৫টি উপখাত রয়েছে। এসব খাত মিলিয়ে করোনা মহামারির কারণে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক হাজার কোটি টাকা। এমনিতেই নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আমাদের পর্যটনশিল্পকে পথ চলতে হচ্ছে। করোনা শুরুর আগে থেকেই বিভিন্ন কারণে পর্যটনশিল্প পিছিয়ে ছিল। তার পরও যতটুকু ব্যবসা ছিল তাতেও টিকে থাকতে তেমন সমস্যা হয়নি। কিন্তু করোনা শুরুর পর তাতে ধস নেমেছে। লকডাউনের বিভিন্ন বিধি-নিষেধের আওতায় দেশের সব পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ছিল দীর্ঘসময় ধরে। বারবার হোঁচট খেতে খেতে আমাদের পর্যটনশিল্প বিপর্যয়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ খাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কেবলই বাড়ছে।

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের পর পর্যটনশিল্প হতে পারে রাজস্ব আদায়ের বিরাট সম্ভাবনাময় খাত। আর সেই সম্ভাবনার বিষয়টি বিবেচনায় রেখেই সরকার পর্যটন খাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। পর্যটনশিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে এদেশের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। অনেক প্রতিকূলতা, সীমাবদ্ধতা, সমস্যা, সংকট, ত্রুটি-বিচ্যুতি, পশ্চাত্পদতা সত্ত্বেও পর্যটন খাত থেকে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ উপার্জন করছে বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ পর্যটনের উল্লেখযোগ্য প্রসার ঘটেছে বাংলাদেশে। পর্যটন ব্যবসায় নিয়োজিত উদ্যোক্তা, বিনিয়োকারী, ব্যবসায়ী, ট্যুর অপারেটরদের দাবি, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত পর্যটনশিল্পকে পুনরায় উজ্জীবিত করতে এ খাতে সরকারের পক্ষ থেকে আরও সুযোগসুবিধা দিতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

লাভজনক এবং পরিবেশবান্ধব এই শিল্পে বিনিয়োগের অনেক সুযোগ থাকলেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর এ খাতে অংশগ্রহণ এখনো উল্লেখ করার মতো অবস্থায় পৌঁছায়নি। দেশের পর্যটন খাত নিয়ে গর্ব করার যাত্রা শুরু হলেও গতানুগতিক সাধারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থায় এমনিতেই পর্যটন খাতকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে এ খাতে আর্থিক বিনিয়োগ সব সময়েই সংকুচিত করে রাখা হয়। ফলে পর্যটন খাতে ব্যাংক কর্তৃক বিনিয়োগের মাত্রা সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। দেশীয় অর্থনীতিতে পর্যটনের অবদান প্রায় ৫ শতাংশ। যার মুখ্য অংশ অভ্যন্তরীণ পর্যটন থেকে আসে। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পকে পুনরায় উজ্জীবিত করতে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বড় অংকের প্রণোদনা প্যাকেজসহ সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে জরুরি হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে পর্যটনশিল্পে প্রয়োজনীয় পুঁজির জোগান নিশ্চিত করতে হবে।

সূত্র: ইত্তেফাক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top