ডুবন্ত ট্রলারে ১০ লাশ: হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা জেলেদের

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৩ মে ২০২৩ ০৩:৫৮; আপডেট: ১২ মে ২০২৫ ০৬:০৭

ছবি: সংগৃহীত

‘ডাকাতি করায় ১০ জনকে পিটিয়ে হত্যা করে সাগরে ট্রলার ডুবিয়ে দিয়েছে সাধারণ জেলেরা’ কক্সবাজারে ডুবন্ত ট্রলারে অর্ধগলিত ১০ লাশ উদ্ধারের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্তদের আদালতে ১৬৪ ধারায় এমনটাই জবানবন্দি দিয়েছেন। খবর দৈনিক ইত্তেফাকের।

তারা তিনজনই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয় দাবি করে রোববার ও সোমবার পৃথকভাবে কক্সবাজার সদর আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক দূর্জয় বিশ্বাস।

১০ জনের লাশ উদ্ধার মামলার প্রধান অভিযুক্ত কামাল হোসেন ওরফে বাইট্যা কামাল ঘটনার সময় কক্সবাজার শহরে অবস্থান করছিলেন দাবি করে সোমবার সন্ধ্যায় কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আখতার জাবেদের আদালতে বলেছেন, ‘আমি শহরে অবস্থান করলেও ঘটনার আগে ও পরে কয়েকজন জেলের সঙ্গে কথা বলা নিশ্চিত হয়েছি ১০ জনের ট্রলারটি সাগরে ডাকাতি করতে নেমেছিল।

ডাকাতির একপর্যায়ে কয়েকটি ট্রলারের সাধারণ জেলেরা ১০ জেলেকে ধাওয়া করে ধরে প্রথমে গণপিটুনি দেন। এরপর লাশগুলো বরফ রাখার কক্ষে আটকে রেখে ছোট ট্রলারটি এক পাশে ফুটো করে (ডুবন্ত ট্রলার) সাগরে ডুবিয়ে দেন।

মামলার তদন্তের সঙ্গে জড়িত পুলিশ কয়েকটি সূত্র, আসামিদের স্বজন, সাধারণ জেলে ও আদালত থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে কামাল হোসেনের একটি ভাসা জালের ট্রলার আছে। ৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় তিনি জানতে পারেন সমুদ্রে তার ভাই আনোয়ারের (মামলার পলাতক আসামি) ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। এরপর মাতারবাড়ীর আবদুল গফুর, সাগরে থাকা দুই ট্রলারের জেলে বেলাল ও আক্কাসের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলে নিশ্চিত হন আনোয়ারের ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। ১০ এপ্রিল সকালে আক্কাসের সঙ্গে তার দ্বিতীয় দফায় আরও ১৫ মিনিট কথা হয়। আক্কাস তখন ঘটনাস্থলে ট্রলারে ছিলেন।

কামাল হোসেন জবানবন্দিতে বলেছেন, ৯ এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে আনোয়ারের ট্রলার সাগরে জাল ফেলে। হঠাৎ এই ট্রলারের (আনোয়ারের) পাশে আসে আরেকটি ছোট ট্রলার। তখন আনোয়ারের ট্রলারের জেলে ফোরকান টর্চলাইট মেরে কাছে ভেড়ার কারণ জানতে চান। তখন কিছু বুঝতে না দিয়ে ছোট ট্রলারের (ডাকাতদের বোট) লোকজন দা, কিরিচ, রড ও বন্দুক নিয়ে আনোয়ারের ট্রলারে উঠে পড়ে এবং আনোয়ারের ট্রলারের জেলেদের এলোপাতাড়ি মারতে থাকে। একপর্যায়ে কায়সার ও জয়নাল মাঝি ছাড়া অবশিষ্ট জেলেদের জাল রাখার কক্ষে ঢুকিয়ে রাখে। এরপর ডাকাতেরা কায়সারকে (আনোয়ারের ট্রলারের চালক) ট্রলারের ইঞ্জিন চালু করতে বাধ্য করে। জয়নাল মাঝিকে ট্রলার চালাতে বাধ্য করে ডাকাতেরা।

ট্রলারটি পূর্ব-উত্তরে কিছু দূর যাওয়ার পর ডাকাতেরা জয়নাল ও কায়সারকে রেখে ট্রলারের অবশিষ্ট জেলেদের সাগরে ফেলে (নিক্ষেপ) দেয়। তারপর ডাকাতেরা আনোয়ারের ট্রলার অন্য একটি ট্রলারের সঙ্গে ভেড়াতে বলেন। তাতে দেরি হওয়ায় ওই ট্রলারটি দ্রুত সরে পড়ে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ডাকাতেরা জয়নাল ও কায়সারকেও মারধর করে সাগরে নিক্ষেপ করে। এ সময় আনোয়ারের ট্রলারে ডাকাত ছাড়া অন্য কেউ ছিল না। এরপর ডাকাতেরা আনোয়ারের ট্রলারের সঙ্গে তাদের (ডাকাতের) ছোট ট্রলারটি বেঁধে উত্তর-পূর্ব দিকে যাচ্ছিল। তখন সামনে পড়ে আফসার মাঝি ও বাবুল মাঝির দুই ট্রলার। দুই মাঝি আনোয়ারের ট্রলার চিনতে পেরে কাছে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। তাতে বাধা দেয় ডাকাতেরা। সন্দেহ হলে আনোয়ারের ট্রলারের জেলে জয়নাল, কায়সার ও মালিক আনোয়ারকে নাম ধরে ডাকতে থাকেন। তাতেও সাড়াশব্দ না পেলে আফসার ও বাবুল মাঝির সন্দেহ হয়। এরপর বাবুল মাঝির ট্রলারটি ভেড়ানোর চেষ্টা করলে ডাকাতেরা গুলি ছুড়তে থাকে। উপায় না দেখে বাবুল মাঝি ও আফসার মাঝি বাঁশের মাথায় কাপড় বেঁধে ট্রলারে তুলে দেয়। এটি একধরনের বিপদ সংকেত। এর ২০-৩০ মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ১০-১২টি ট্রলার। পরে তারা ডাকাতের ট্রলারটি চারদিক থেকে ঘিরে ফেললে ডাকাতেরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে একপর্যায়ে ডাকাতেরা আনোয়ারের ট্রলারের বাঁধা নিজেদের ছোট ট্রলারটি রশি কেটে দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরপর আনোয়ারের ট্রলার নিয়ে ডাকাতেরা পালাতে থাকে। তখন অন্যান্য ট্রলারের জেলেরা ডাকাতদের ধাওয়া করে। একপর্যায়ে ডাকাতদের ট্রলারের জ্বালানি তেল শেষ হয়। তখন চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও কুতুবদিয়ার দুটি ট্রলার দুই পাশ থেকে ঘিরে ডাকাতের ট্রলারটি (আনোয়ারের) আটকায় এবং ডাকাতদের হাত-পা রশি দিয়ে বেঁধে ফেলে। এরপর বাঁশখালী ও কুতুবদিয়ার দুটি ট্রলারের সঙ্গে বাবুল মাঝি, আফসার মাঝি, আমান উল্লাহ ও আনোয়ারের ট্রলারের জেলেরা (সাগরে নিক্ষেপের পর অন্য ট্রলার কর্তৃক উদ্ধার) ডাকাতদের চারদিক ঘিরে ধরে বাঁশ, বরফ ভাঙার মুগুর, লাকড়ি দিয়ে গণপিটুনি দেন। এই পিটুনিতে ডাকাতদের মৃত্যু হয়।

এরপর আফসার মাঝি, বাবুল মাঝি, আমান উল্লাহ মাঝি, আনোয়ার মাঝি ও অন্যান্য ট্রলারের জেলেরা (অন্তত ৬০ জন) সাগরে ভাসমান ডাকাতদের ছোট ট্রলারটি খুঁজে নেন। তারপর ডাকাতের লাশগুলো ছোট ট্রলারের মাছ রাখার কক্ষে ঢুকিয়ে ঢাকনা দিয়ে মুখ বন্ধ করেন। তারপর লাশ গুম করার উদ্দেশ্যে ট্রলারটি সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

এছাড়া ওই মামলার অপর দুই আসামি (ট্রলারের মাঝি) আবু তৈয়ূব ও ফজল কাদের ঘটনার সঙ্গে তারা জড়িত না হলেও ঘটনাটি তাঁরা স্বচক্ষে দেখেছেন বলে দাবি করে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীজ্ঞান তঞ্চঙ্গ্যার আদালতে রোববার সন্ধ্যায় ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেছেন।

জবানবন্দিতে আবু তৈয়ূব বলেছেন, ১১ রোজার দিন ট্রলারে ১৮ জন জেলে নিয়ে তৈয়ব বাঁশখালী থেকে সাগরে রওনা দেন। সাত থেকে আট ঘণ্টা চালানোর পর ট্রলারটি মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপকূলের মাঝামাঝি ৮ বিআর লাইন নামক স্থানে পৌঁছায়। তিন দিন পর ওই এলাকায় দেখা হয় ফজল (ফজল কাদের) মাঝির ট্রলারের। ১৭ রোজার দিন (৯ এপ্রিল) ভোর পাঁচটার দিকে তারা সমুদ্রে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান।

প্রথমে তারা ধারণা করেন, নৌ বাহিনীর প্রশিক্ষণ চলছে। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ফজল মাঝি জানান, খুটা জাইল্যাদের (ছোট মাছ ধরার জেলে) একটা ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। খুটা জাইল্যাদের ট্রলারটি ফ্ল্যাগ (নিশানা) তুলে পূর্ব দিকে চলে গেছে। এরপর তৈয়ব ও ফজল মাঝির ট্রলার দুটি পূর্ব দিকে যেতে থাকে। কাছাকাছি গিয়ে তারা দেখতে পান, খুটা জাইল্যাদের পাঁচটি ট্রলার আরেকটি ট্রলারকে ঘিরে রেখে ট্রলারটির লোকজনকে লাঠি দিয়ে মারধর করছে। দূর থেকে মারপিটের এই দৃশ্য দেখতে থাকেন আরও কিছু জেলে।

আবু তৈয়ব বলেন, হঠাৎ দেখতে পান, একজন লোক টাঙ্কিতে (প্লাস্টিক গ্যালন) ভেসে তার ট্রলারের কাছে আসছেন। লোকটিকে তারা ট্রলারে তুলে নেন। লোকটির বয়স আনুমানিক ৫০ বছর, মুখে সাদা দাঁড়ি। লোকটি ট্রলারে উঠে তাকে জানান, ডাকাতেরা তাকে মাছ ধরার কথা বলে সাগরে নিয়ে এসেছে। লোকটি বারবার তাকে বাঁচানোর জন্য বলছিলেন। চার থেকে পাঁচ মিনিট পর খুটা জাইল্যাদের একটি ট্রলার এসে তার (তৈয়ূব) ট্রলারে আশ্রয় নেওয়া লোকটিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় এবং আশ্রয় দেওয়ার কারণে তাকে গালমন্দ করে।

জবানবন্দিতে তৈয়ূব বলেন, কিছুক্ষণ পর তিনি দেখতে পান, খুটা জাইল্যারা ডাকাত বলে ঘিরে রাখা ট্রলারের লোকগুলোকে বাঁশ, বরফ ভাঙার মুগুর ও লাঠি দিয়ে বেদম পিটুনি দিচ্ছেন। মারের চোটে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। সেটা দূর থেকে আন্দাজ করা যাচ্ছিল। ভয়াবহতা দেখে তৈয়ব ও ফজল মাঝি তাদের ট্রলার নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে পশ্চিম দিকে চলে যান। ২৫ রোজা পর্যন্ত সাগরে ছিলেন তৈয়ব। এরপর ট্রলার নিয়ে বাঁশখালীতে পৌঁছে লোকজনকে ঘটনার কথা খুলে বলেন। পৃথক জবানবন্দিতে ফজল কাদেরও একই রকম জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কক্সবাজার সদর থানার পরিদর্শক দূর্জয় বিশ্বাস বলেন, এ পর্যন্ত এ মামলায় তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবাবন্দি দিয়েছেন। তারা কেউ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার না করলেও তাদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে ঘটনার অনেক কিছুই।

কক্সবাজার সদর থানার ওসি মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ১০ লাশ উদ্ধারের মামলায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন এজাহার নামী এবং বাকিরা সন্দিগ্ধ আসামি। এদের মধ্যে ৫ জনকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। ৪ জনের রিমান্ড শেষ হয়েছে। তিনজন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া এ মামলার অপর দুই এজাহারনামীয় আসামি আনোয়ার হোসেন ও বাবুল মাঝিকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশের অভিযান চলমান রয়েছে।



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top