অপপ্রচার মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলো কী করছে?
রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ২৯ আগস্ট ২০২৩ ১৪:২৪; আপডেট: ১০ মে ২০২৫ ১৩:৩৫
-2023-08-29-08-24-15.jpg)
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া অনেক ভুয়া তথ্যে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ ব্যবহারকারীরা।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র কয়েক মাস বাকি। সময় যতই ঘনিয়ে আসছে রাজনৈতিক উত্তেজনা ততই বাড়ছে। এমন অবস্থায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রোপাগান্ডা ও বানোয়াট সংবাদ ছড়াচ্ছে।
অনেক ক্ষেত্রে এমনভাবে সংবাদ তৈরি করা হচ্ছে যা দেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সাধারণ ব্যবহারকারীরা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তারা বুঝতেই পারছেন না এটি আসল না ভুয়া খবর।
সর্বশেষ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে একটি খবর ছড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ৫০ লাখ টাকা অনুদান নিয়েছেন বলে ছড়িয়ে দেওয়া সেই খবরে বলা হয়েছে। পরে এটিকে বানোয়াট বলে জানান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন বিএনপি মহাসচিব।
বিশ্লেষকদের আশঙ্কা জাতীয় নির্বাচন ঘিরে এই প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। এমন অবস্থায় প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এই বিষয়টি কতটা নজরে রেখেছে?
আমরা তো এরকম প্রোপাগান্ডায় অভ্যস্ত না। কিন্তু আমাদের মিডিয়া সেল আছে, সেখানে আমাদের লোকজন কাজ করছে। কিন্তু এ নিয়ে আমরা বেশি চিন্তিত না, এগুলো খুব বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ মানুষ তো এগুলো বিশ্বাস করে না। আমার মনে হয় না, এতে কোনো নেতিবাচক সমস্যা তৈরি হবে।
মির্জা ফখরুল, বিএনপি মহাসচিব কয়েকদিন আগে সামাজিক মাধ্যমগুলোয় একটি চেকের ছবি ছড়িয়ে পড়ে। যেখানে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নামে ৫০ লাখ টাকার একটি চেক ইস্যু করা হয়েছে। সেখানে মির্জা ফখরুল এবং তার স্ত্রীর ছবি দিয়ে দাবি করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে চিকিৎসা সহায়তা নিয়ে তিনি বিদেশে গিয়েছেন।
সিঙ্গাপুর থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এটা আওয়ামী লীগের পরিকল্পিত প্রোপাগান্ডা। দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য, নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য পরিকল্পিতভাবে তারা এসব করছে। তাদের কাজই মানুষের চরিত্র হনন করা। দেশের মানুষও সেটা জানে, তাদের কোনো প্রোপাগান্ডাই মানুষ বিশ্বাস করে না।
কিন্তু নিঃসন্দেহে পুরো বিষয়টি খুবই বিব্রতকর। এটা দেশের গণতন্ত্র ও সংস্কৃতির জন্য হতাশাজনক। কিন্তু এতে মানুষ বিভ্রান্ত হবে না। কারণ মানুষ তাদের নেতাদের ভালো করে চেনে। তাতে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামে কোন ক্ষতি হবে না।’
ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে মির্জা ফখরুল অভিযোগ তুললেও আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ বলেছেন, এই চেকের ছবির ঘটনার সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সম্পর্ক নেই।
একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা অন্য দলকে, দলের নেতাদের লক্ষ্য করে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা তথ্য তৈরি করে ছড়িয়ে দেন। যারা এসব দলের অনুসারী, তারাও সেগুলো বেশি বেশি করে শেয়ার করার কারণে দ্রুত এসব বানোয়াট তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়।
কোনো দেশের জাতীয় নির্বাচন বা বিশেষ পরিস্থিতিতে সামাজিক মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর উদাহরণ নতুন নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এবং ভারতের ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় সামাজিক মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে ব্যাপকহারে বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং ভুয়া তথ্য ছড়াতে দেখা গেছে। সেইসময় এ ধরনের মিথ্যা তথ্য ঠেকাতে টুইটার এবং ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ কিছু কড়াকড়ি এবং যাচাই বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজব এবং মিথ্যা তথ্য শনাক্তে কাজ করে থাকে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের সেন্টার ফর ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড কোয়ালিটেটিভ স্টাডিজের ফ্যাক্ট ওয়াচ প্রজেক্ট।
ওই বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক সুমন রহমান আশঙ্কা করছেন, নির্বাচনের সামনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা আরও বাড়তে পারে। তিনি বলেন, ‘শুধু নির্বাচন নয়, যেকোনো ক্রাইসিস ইভেন্টে গুজব বাড়তে থাকে এবং সেটা এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
কারণ যারা এসব গুজব ছড়িয়ে থাকে,তারা অনেক বেশি প্রযুক্তি এবং কৌশলে দক্ষ হয়ে থাকে। নির্বাচন ঘিরে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা সারাবিশ্বেই একটা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। আমাদের ধারণা, নির্বাচন যতো এগিয়ে আসবে, এ ধরনের গুজব, মিথ্যা তথ্য বা ভুল তথ্য অনেক বেশি ছড়াতে থাকবে।’
গুজব শনাক্ত করতে কাজ করে, রিউমার স্ক্যানার নামে এমন একটি সংগঠনের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এক বছরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও সংবাদ মাধ্যম মিলে প্রায় দেড় হাজার গুজব ছড়ানো হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যারা এরকম গুজব ছড়িয়ে থাকে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে তাদের রাজনৈতিক একটা মতাদর্শ রয়েছে। তারা সেই আদর্শ থেকে গুজব ছড়াতে শুরু করেন।
এজন্য একটি রাজনৈতিক দলের অনুসারীরা অন্য দলকে, দলের নেতাদের লক্ষ্য করে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর বা মিথ্যা তথ্য তৈরি করে ছড়িয়ে দেন। যারা এসব দলের অনুসারী, তারাও সেগুলো বেশি বেশি করে শেয়ার করার কারণে দ্রুত এসব বানোয়াট তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়।
প্রোপাগান্ডা মোকাবিলায় দলগুলো কী করছে?
বাংলাদেশে যেভাবে পরস্পরবিরোধী মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তাতে ধারণা করা যেতে পারে, দলগুলোর সমর্থকরা পরস্পরকে পাল্টা আক্রমণের পথ বেছে নিয়েছে। যদিও আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয় দলই কোনরকম ভুয়া তথ্যে ছড়ানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকার কথা জানিয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, ’আমরা তো এরকম প্রোপাগান্ডায় অভ্যস্ত না। কিন্তু আমাদের মিডিয়া সেল আছে, সেখানে আমাদের লোকজন কাজ করছে। কিন্তু এ নিয়ে আমরা বেশি চিন্তিত না, এগুলো খুব বেশি ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ মানুষ তো এগুলো বিশ্বাস করে না। আমার মনে হয় না, এতে কোনো নেতিবাচক সমস্যা তৈরি হবে।’
কোনো গুজব বিএনপি ছড়ায় না বলে দাবি করে ফখরুল বলেন, সবারই এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা দাবি করেছেন, বহু বছর ধরে আওয়ামী লীগই নানারকম প্রোপাগান্ডা ও ভুয়া তথ্যের শিকার হচ্ছে। তাদের কথা - বিশেষ করে কিছু মানুষ বিদেশে অবস্থান করে আওয়ামী লীগের সরকারের বিরুদ্ধে নানারকম মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে।
ভোটের আগে ভুয়া তথ্য আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ বলেন, ’আমাদের বিরুদ্ধে দেশে-বিদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গত কয়েক বছর ধরেই প্রোপাগান্ডা হচ্ছে। বিদেশে কিছু সংঘবদ্ধ ব্যক্তি নানারকম ক্যাম্পেইন করে যাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে। দল হিসেবে এবং আমাদের বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা দায়িত্বরত আছেন, তারা কাজ করছেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে যে, এগুলো মিথ্যা প্রোপাগান্ডা। মানুষ এগুলো বিশ্বাস করে না, গুরুত্বও দেয় না।
মির্জা ফখরুলের চেক বা বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর সঙ্গে আওয়ামী লীগের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই বলে জানান সেলিম মাহমুদ।
দেশের বড় দল দুটির নেতারা জানান, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো নজরদারি করার জন্য উভয়দলেই বিশেষ সেল তৈরি করা হয়েছে। তারা এসব তথ্য পর্যবেক্ষণ করা, রিপোর্ট করার মতো কাজগুলো করে থাকে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, সামনের দিনগুলোয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ধরনের প্রোপাগান্ডা বা বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর প্রবণতা আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের সেন্টার ফর ক্রিটিক্যাল অ্যান্ড কোয়ালিটেটিভ স্টাডিজের ফ্যাক্ট ওয়াচ প্রজেক্টের পরিচালক অধ্যাপক সুমন রহমান বলছেন, ’আমার ধারণা এসব গুজব রটনাকারীরা এখন ওয়ার্মআপ পিরিয়ডে রয়েছে, তারা সবাই যার যার অস্ত্রগুলো পরীক্ষা করে দেখছে যে, এগুলো কতটা কাজ করে। এখন বরং অনেক মডারেট পর্যায়ে আছে। কিন্তু যতই নির্বাচন এগিয়ে আসবে, সেটা আরও বাড়বে।
ফলে সামাজিক মাধ্যমে যেকোনো তথ্য দেখলেই সেটা বিশ্বাস করা বা শেয়ার করার আগে ব্যবহারকারীদের ভালোভাবে যাচাই করার পরামর্শ দেন তিনি।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা ।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: