বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড

মুঈনুদ্দীন-আশরাফের হত্যার শিকার ১৮ বুদ্ধিজীবী

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ২৩:২৮; আপডেট: ৩ মে ২০২৪ ০০:৪৬

ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর সকালে হাতিরপুলের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাসার সামনে থেকে আলবদর বাহিনী তুলে নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী শল্যচিকিৎসক ডা. আজহারুল হককে। একই সঙ্গে শিক্ষানবিশ চিকিৎসক ডা. হুমায়ুন কবীরকেও তুলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী। পরদিন ১৬ নভেম্বর সকালে তাদের মরদেহ পাওয়া যায় নটর ডেম কলেজের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায় কালভার্টের নিচে। উদ্ধারের সময় তাদের হাত, পা ও চোখ বাঁধা ছিল। শরীরে ছিল আঘাতের চিহ্ন।

এই দুই চিকিৎসককে হত্যার মধ্য দিয়েই মূলত সূচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশার বাস্তবায়ন। ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর শুরু হওয়া বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড একাধারে চলে ১৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত। সুপরিকল্পিত এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম দুই হোতা আলবদর বাহিনীর নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। স্বাধীনতার চার দশকের বেশি সময় পর ২০১৩ সালে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের ফাঁসির রায় দেন আদালত। তবে তারা পলাতক থাকায় রায় ঘোষণার ১০ বছর পরও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি।

মুঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে মামলায় একাত্তরে ১৮ বুদ্ধিজীবীকে হত্যাসহ ১১টি অভিযোগ আনা হয়েছিল, যার সবকয়টি প্রমাণিত হয়েছে। যেসব বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের শিকার হন তারা হলেন দৈনিক ইত্তেফাকের কার্যনির্বাহী সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেন, পিপিআইয়ের (পাকিস্তান প্রেস ইন্টারন্যাশনাল) প্রধান প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হক, দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদক এ এন এম গোলাম মোস্তফা, বিবিসির সাংবাদিক নিজাম উদ্দিন আহমেদ, শিলালিপির সম্পাদক সেলিনা পারভীন, দৈনিক সংবাদের যুগ্ম সম্পাদক শহীদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক সিরাজুল হক খান, ড. মো. মুর্তজা,

ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ক্লিনিক্যাল মেডিসিন ও কার্ডিওলজির অধ্যাপক ফজলে রাব্বী ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আলীম চৌধুরী। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর দিবাগত রাত থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজনের মরদেহ পরে পাওয়া যায় রায়েরবাজার ও মিরপুর বধ্যভূমিতে। এছাড়া কয়েকজনের মরদেহের খোঁজ মেলেনি এখনো।

রায়ে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিবরণ

ট্রাইব্যুনাল বলেছেন, চূড়ান্ত বিজয়ের আগমুহূর্তে সুপরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বুদ্ধিজীবীদের তাদের বাসা থেকে অপহরণ করে আলবদর বাহিনী। বুদ্ধিজীবী নিধনের নেতৃত্ব দেওয়া মুঈনুদ্দীন একাত্তরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এজন্যই অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীকে অপহরণের সময় তিনি মুঈনুদ্দীনকে চিনতে পেরেছিলেন।

বুদ্ধিজীবী নিধনের ‘অপারেশন ইনচার্জ’ হিসেবে মুঈনুদ্দীন শুধু নিধনে নেতৃত্বই দেননি, নিজেও অংশ নিয়েছেন। বন্দুকের নলের মুখে বাসা থেকে অপহরণ করে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে যাওয়া হতো মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা কলেজে স্থাপিত আলবদরের সদর দপ্তরে। সেখানে তাদের চরম নির্যাতনের পর হত্যা করা হতো রায়েরবাজার বা মিরপুর বধ্যভূমিতে নিয়ে।

রায়ে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর আশরাফুজ্জামানের একটি ডায়েরি পাওয়া যায়, যা তাদের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অন্যতম প্রমাণ। ডায়েরিতে ১৯ জন বুদ্ধিজীবীর নাম ও ঠিকানা লেখা ছিল। পাকিস্তানি গবেষক সেলিম মনসুর খালিদের লেখা আলবদর গ্রন্থ অনুসারে, ওই বইয়ের লেখকের কাছে আশরাফুজ্জামান ডায়েরি লেখার বিষয়টি স্বীকারও করেছেন।

ডা. আলীম চৌধুরী হত্যাকাণ্ড নিয়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, আলীম চৌধুরীকে অপহরণের সঙ্গে মাওলানা আবদুল মান্নান জড়িত ছিলেন। একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বর মান্নানকে রমনা থানায় সোপর্দ করা হলেও পরে অজ্ঞাত কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। জাতির জন্য লজ্জা, মাওলানা মান্নান পরে স্বৈরশাসক এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হন।

বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের নিয়ে এখন আর কোনো কথা বলতে চাই না। আসামিদের ফিরিয়ে আনতে সরকার কোনো ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে না। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের মতো তাদেরও ফিরিয়ে আনতে পারছে না। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে।

রায়ে বলা হয়, কেন বিজয়ের অব্যাবহিত পরে মুঈনুদ্দীন পালিয়ে গেলেন এবং আজও বিদেশে রয়েছেন? রায়ের বছর আল-জাজিরা টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুঈনুদ্দীন মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ ও অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। একজন অপরাধী সাধারণত তার অপরাধ স্বীকার করেন না। স্বাধীনতার পরপরই পালিয়ে যাওয়াটা তার অপরাধী মানসিকতার স্পষ্ট উদাহরণ। রায়ের সময় মুঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যের লন্ডনের টটেনহামে বসবাস করতেন। আশরাফুজ্জামান বসবাস করতেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের জ্যামাইকায়। তারা দুজনই কানাডায় যাওয়া-আসা করেন, কারণ সেখানে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ। এমনটি জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের অন্যতম প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাসগুপ্ত।




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top