অকাল বৃষ্টি, উৎপাদন ব্যয় ও দরপতনে বিপাকে চাষিরা
রাজশাহীতে আমনের বাম্পার ফলনেও লোকসানের শঙ্কা
শাহ্ সুফি মহিব্বুল আরেফিন | প্রকাশিত: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:৩৩; আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:৪৪
রাজশাহী অঞ্চলের কৃষি আবাদে আমন মৌসুম মানেই স্বস্তি আর আশার বার্তা। এবার বরেন্দ্র অঞ্চলখ্যাত রাজশাহীতে আষাঢ় মাসের পর্যাপ্ত বৃষ্টিতে সেচ খরচ ছাড়াই রোপা আমন চাষ, উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির ফলে এবার অনেক এলাকায় আমনের বাম্পার ফলনের চিত্র দেখা গেছে। কিন্তু মৌসুমের শেষ প্রান্তে এসে সেই আশায় ভর করেছে শঙ্কা। নভেম্বরের শুরুতে অকাল ভারী বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাজারে আমন ধানের দরপতনে উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা পড়েছেন দ্বিমুখী সংকটে। আর কৃষকদের বোঝার উপর শাকের আঁটি হিসেবে যোগ হয়েছে নির্বাচনী বছর।
রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একদিকে ফলনের ক্ষতি, অন্যদিকে কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হওয়ায় কৃষকেরা আর্থিকভাবে বড় চাপে পড়েছেন। অনেক কৃষক বলছেন, এবছর আমন মৌসুম তাদের জন্য ‘লাভের’ নয়, বরং ‘ঋণের বোঝা’ বাড়ানোর মৌসুম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর রাজশাহী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহীর ৯টি উপজেলাতেই চাষ হয়। আর জেলায় ৮৪ হাজার ২৫৫ হেক্টর জমিতে রোপা আমন রোপণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে রাজশাহী মহানগর এলাকার মতিহার থানায় ২৮ হেক্টর, বোয়ালিয়া থানায় ১২ হেক্টর, পবা উপজেলায় ৯ হাজার ১৮৫ হেক্টর, তানোর উপজেলায় ২২ হাজার ৫৮০ হেক্টর, মোহনপুর উপজেলায় ৪ হাজার ৬৫ হেক্টর, বাগমারা উপজেলায় ৩ হাজার ৭০০ হেক্টর, দুর্গাপুর উপজেলায় ৫ হাজার ৬২০ হেক্টর, পুঠিয়া উপজেলায় ৭ হাজার ৫৯৫ হেক্টর, গোদাগাড়ী উপজেলায় ২৩ হাজার ৭৫০ হেক্টর, চারঘাট উপজেলায় ৫ হাজার ৪৫৫ হেক্টর ও বাঘা উপজেলায় ২ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে আমন রোপণ করা হয়।
অকাল বৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে টানা দুই দিনের ভারী বৃষ্টিপাতে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ১৯ হাজার ৫৬৮ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে আনুমানিক ১৩১ দশমিক ৩১ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত জমির মধ্যে ১ হাজার ৬৪৯ হেক্টর জমির ফসল সম্পূর্ণ ধ্বংস আর ১৩ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমির ফসল আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে আমন ধানে। হিসেব অনুযায়ী, ৫৮৫ হেক্টর জমির আমন ধান পুরোপুরি নষ্ট এবং ১২ হাজার ৫০১ হেক্টর জমির আমন ধান আংশিক ক্ষতির মুখে পড়ে। কৃষকদের ভাষ্য, যেসব জমিতে ধান পাকতে শুরু করেছিল, সেগুলো দীর্ঘ সময় পানির নিচে থাকায় শীষ কালচে হয়ে ও অনেক জায়গায় ধান গজিয়ে নষ্ট হয়ে যায়। এতে ফলন যেমন কমেছে, তেমনি ধানের মানও নষ্ট হয়েছে। এর পরেও ফলন হয়েছে সন্তোশ জনক। এদিকে ফসলের ক্ষতির কারণে কৃষকদের প্রত্যাশা ছিল বাজারে ধানের সরবরাহ কমবে, ফলে দাম কিছুটা বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো। বাজারে ধানের সরবরাহ তুলনামূলক বেশি থাকায় এবং ব্যবসায়ীদের মজুতদারির কারণে আমন ধানের দাম নেমে গেছে।
রাজশাহীর স্থানীয় বাজারগুলোতে সবচেয়ে বেশি চাষযোগ্য মোটা আমন ধান ওজনের তারতম্য হিসেবে প্রতি মণ ১ হাজার ৫০ টাকা এবং শুকনো ধান ১২১০ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। উন্নত ও সুগন্ধি জাতের কাটারিভোগ ধান বিক্রি হয়েছে ২ হাজার থেকে ২১ টাকা দরে বিক্রী হচ্ছে। কৃষকরা জানিয়েছেন, গত বছর একই সময়ে তারা প্রতি মণে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেশি দাম পেয়েছিলেন। অথচ এবছর উৎপাদন ব্যয় আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে।
উৎপাদন ব্যয়ে চাপ
কৃষকদের অভিযোগ, সার, কীটনাশক, বীজ, সেচ, পরিবহন এবং শ্রমিকের মজুরি—সবকিছুর দাম বেড়েছে। অনেক এলাকায় শ্রমিক সংকটের কারণে ধান কাটা ও মাড়াইয়ে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে। দুর্গাপুর উপজেলার কৃষক সোহাগ ইসলাম পরিস্থিতিকে ‘দ্বিগুণ আঘাত’ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “ফলন হয়েছে, তবে দামও কম। খরচ তো আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ধান বিক্রি করে উৎপাদন খরচই উঠছে না। ঋণ শোধ করব কীভাবে সেটাই বড় দুশ্চিন্তা।”
ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকেরা সবচেয়ে ঝুঁকিতে
তানোর উপজেলার পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক নূর মোহাম্মদ বলেন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। “ব্যবসায়ীরা ধান মজুত করে রাখছেন। প্রকৃত দাম দিচ্ছেন না। যেহেতু ক্ষুদ্র চাষিরা ঋণ নিয়ে চাষ করেছেন, তাই বাধ্য হয়েই কম দামে ধান বিক্রি করছেন। ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগটাই নিচ্ছেন,” বলেন তিনি। তিনি আরও জানান, সরকারের ধান ক্রয়মূল্য ৩৬ টাকা থেকে ৩৪ টাকা প্রতি কেজিতে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত কৃষকদের উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। পাশাপাশি সরকারি ক্রয়কেন্দ্রে আর্দ্রতার কঠোর শর্ত থাকায় অনেক কৃষক নতুন কাটা ধান সেখানে বিক্রি করতে পারছেন না। চারঘাট উপজেলায় আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় রোপা আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। মাঠজুড়ে পাকা ধানের সোনালি আভা, কৃষকদের ব্যস্ততা সব মিলিয়ে আশাবাদী চিত্র দেখা গেলেও বাজারদর নিয়ে শঙ্কা রয়ে গেছে। নিমপাড়া ইউনিয়নের কৃষক আকবর আলী বলেন, “এবার ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু যদি ভালো দাম না পাই, তাহলে লাভের মুখ দেখা যাবে না।”
রোপা আমনে শুরুতে ছিল আশার আলো
এ মৌসুমের শুরুতে চিত্র ছিল একেবারেই ভিন্ন। আষাঢ় মাসের শুরু থেকেই পর্যাপ্ত বৃষ্টিতে রাজশাহী জেলার ৯টি উপজেলায় পুরোদমে রোপা আমন চাষ শুরু হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় ৮৪ হাজার ২৫৫ হেক্টর জমিতে রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে তানোর, গোদাগাড়ী, পবা, দুর্গাপুর, বাগমারা ও চারঘাট উপজেলায় ব্যাপক হারে আমন রোপণ হয়। অনেক কৃষক সেচ ছাড়াই ধান রোপণ করতে পেরে খুশি ছিলেন। উন্নত জাতের বীজ ব্রি-৭৫, ব্রি-৫১, ব্রি-৮৭, স্বর্ণা, ব্রিধান-৪৯ ব্যবহারের ফলে ফলনের সম্ভাবনাও ছিল ভালো। রাজশাহী বিভাগের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শাহানা আক্তার জাহান বলেন, “বৃষ্টিজনিত কারণে কিছু এলাকায় ফলন কমেছে। তবে মৌসুমের শুরুতে বাজারে ফসল এলে দাম ওঠানামা করে। কৃষকরা যদি কিছুদিন সংরক্ষণ করতে পারেন, তাহলে ভালো দাম পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” তবে কৃষকদের দাবি, সংরক্ষণের সুযোগ সবার নেই। অধিকাংশ কৃষক ঋণের চাপে দ্রুত ধান বিক্রি করতে বাধ্য হন।
কৃষকদের আশঙ্কা, যদি দ্রুত আমন ধানের দাম না বাড়ে, তাহলে অনেকেই ঋণের গভীরে ডুবে যাবেন। এর প্রভাব পড়বে আসন্ন রবি মৌসুমে। জমি প্রস্তুত, সার ও বীজ কেনার মতো সামর্থ্য অনেক কৃষকের থাকবে না। কৃষি বিশ্লেষকদের মতে, ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারি ক্রয় কার্যক্রম আরও সহজ ও কৃষকবান্ধব করতে হবে। পাশাপাশি বাজার তদারকি জোরদার না হলে আমন মৌসুমের সম্ভাবনাময় উৎপাদনও কৃষকদের মুখে হাসি ফোটাতে পারবে না।

আপনার মূল্যবান মতামত দিন: