রাজশাহীর গ্রামে পঙ্কজের মরুর দেশের সাকুলেন্টের সমাহার

রাজ টাইমস | প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৮:০৭; আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৮:৩১

ছবি: সংগৃহীত

২৯ শতাংশ জমির পুরোটা জাল দিয়ে ঘেরা। কাগজের ছাউনির নিচে সারি সারি চৌকি বসানো। এর ওপরে বিশেষ ধরনের উদ্ভিদের সমাহার। নানা আকৃতির, নানা জাতের ও নানা রঙের এই উদ্ভিদের নাম সাকুলেন্ট। ৩০০ প্রজাতির প্রায় ৪০ হাজার সাকুলেন্ট থরে থরে সাজানো। পাশাপাশি ১৫০ প্রজাতির ১০ হাজারের মতো ক্যাকটাসের দেখাও মিলল সেখানে।

রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার শিলমাড়িয়া ইউনিয়নের সাতবাড়িয়া গ্রামে এমন উদ্ভিদের সমাহার ঘটিয়েছেন পঙ্কজ কুমার মহন্ত। পঙ্কজ রাজশাহী কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। কেবল সাকুলেন্ট বিক্রি করেই মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা আয় করেন তিনি। বাগানের নাম তিনি দিয়েছেন ‘সাকুলেন্ট প্যারাডাইস’।

ছোটবেলা থেকে গাছের সঙ্গে
স্কুলজীবন থেকেই গাছের প্রতি টান ছিল পঙ্কজ কুমারের। সেই টান থেকে কীভাবে তিনি গাছ বিক্রিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন, সে গল্প বলেছেন। পঙ্কজ বলেন, ২০১০ সালে তাঁদের গ্রামে কলেজের পাশে পৌষসংক্রান্তি মেলায় তিনি ও তাঁর এক বন্ধু ফুল গাছের চারা নিয়ে বসেন। পুঁজি হিসেবে তিনি দিয়েছিলেন ৩০০ টাকা আর বন্ধু দিয়েছিলেন ২০০ টাকা। মেলা শেষে বিক্রি হলো ৮০০ টাকা। গাছ বেঁচে গেল অর্ধেকের বেশি। সেগুলোর মধ্যে কিছু গাছ বন্ধুবান্ধবকে দিয়ে বাকিটা বাড়িতে নিয়ে গেলেন। গাছগাছালির প্রতি আকর্ষণ থাকায় ২০১১ সালে বাড়ির পাশে বাবার বন্ধুর কাছ থেকে বিনা মূল্যে ব্যবহারের জন্য একখণ্ড জমি পান। সেখানে গোলাপ, টগর, ডালিয়াসহ নানা জাতের ফুলগাছের নার্সারি গড়ে তোলেন। এর মধ্যে কলেজে পড়া শেষ হয়।

পঙ্কজ জানান, ২০১২ সালের শেষের দিকে তিনি রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন। বাড়িতে বাবা জিতেন্দ্রনাথ ও ছোট ভাই দীপক কুমার আর মাঝেমধ্যে ছুটিতে এসে পঙ্কজ নিজে নার্সারির পরিচর্যা করতেন। নার্সারি থেকে ভালোই বিক্রি হচ্ছিল। ২০১৩ সালের দিকে ওই জমিতে ভবন তোলেন মালিক। পরে ওই বাজারের আরেকটি অংশে ১০ শতক জমি ইজারা নিয়ে নার্সারি করেন পঙ্কজ। তিনি থাকতেন রাজশাহী কলেজের মহারানি হেমন্ত কুমারী হিন্দু ছাত্রাবাসে। সেখানে আশপাশ পরিষ্কার করে ফুলের বাগান করলেন। এরপর রাজশাহী শহরের নার্সারিগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকেন তিনি।

প্রথম সাকুলেন্ট কেনেন ২০০ টাকায়
রাজশাহী শহরে থাকাকালে পঙ্কজ দেখতে পান ক্যাকটাস আর সাকুলেন্ট বিক্রি হচ্ছে। ক্যাকটাস চিনলেও সাকুলেন্ট সম্পর্কে ধারণা ছিল না। দেখলেন, এগুলো অনলাইনেও বিক্রি হচ্ছে। ২০১৭ সালের দিকে এক নার্সারিতে গিয়ে শখের বশে ২০০ টাকায় একটা সাকুলেন্ট কেনেন। তারপর সেখান থেকেই সাকুলেন্ট বাড়ালেন। সে সময়েই ফেসবুকে সাকুলেন্ট ও ক্যাকটাসের ছবি দিয়ে বিক্রি শুরু করলেন।

পঙ্কজ কুমার মহন্ত বলেন, সেশনজটের কারণে তাঁর পড়াশোনা শেষ হয় ২০২০ সালে। করোনার সময় কলেজের ছাত্রাবাস বন্ধ হয়ে গেলে সাকুলেন্ট নিয়ে তিনি চলে আসেন পুঠিয়ার বাড়িতে। এরপর বাড়িতে রেখেই সাকুলেন্ট বিক্রি শুরু করেন তিনি। পাশাপাশি বাড়ির পাশের নার্সারি বন্ধ করে দেন।

বাবা জমি দিলেন ২৯ শতাংশ
করোনার সময় অনলাইনে কেনাকাটা বেড়ে যায়। সে সময় সাকুলেন্টের নার্সারি করার বিষয়ে বাবাকে বোঝান পঙ্কজ। বাবা সব শুনে ছেলের প্রতি আস্থা থেকে ২৯ শতক জমি দেন। বাবা জিতেন্দ্রনাথ বলেন, ‘করোনার সময় অনেকগুলো গাছ নিয়ে ছেলে বাড়িতে চলে এল। পরে বলল, জমি লাগবে। এই গাছগুলো বিক্রি হচ্ছিল। পরে জমি দিয়ে দিলাম। এখন নিজেও ছেলের সঙ্গে কাজ করি। আরও কয়েকজন শ্রমিকও লাগে। ছেলে যদি চাকরি না–ও পায়, এটা দিয়েই ভালো চলতে পারবে।’

জমি পাওয়ার পর পঙ্কজ পুরো জমিতে ভালো করে বেড়া দিলেন। ওপরে পলিথিন দিয়ে ছাদ করলেন। কাঠের চৌকি কিনে তাতে সাকুলেন্ট রাখা শুরু করলেন। একটার পর একটা সাকুলেন্টের নতুন চারা করলেন। সারা দেশের বিভিন্ন নার্সারিসহ ভারত থেকেও সাকুলেন্ট কিনে আনলেন। এভাবে ভরিয়ে তুললেন পুরো নার্সারি। পঙ্কজ বলেন, জমি পাওয়ার পর তিনি সাকুলেন্ট বাগানটিকে আরও ভালোভাবে সাজান। সাকুলেন্টের বিভিন্ন উন্নত জাত আর অন্যান্য সরঞ্জাম কিনতে প্রায় ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়। এই কর্মকাণ্ড দেখে আশপাশের মানুষ হাসাহাসিও করে। কিন্তু বছর না যেতেই তারাই আবার প্রশংসা শুরু করে দেয়। কারণ, বিক্রি বেড়ে যায়। এখন তাঁর বাগান দেখতে অনেকেই আসেন। এসে তাঁরা ছবি তোলেন, যাওয়ার সময় সাকুলেন্ট নিয়ে যান।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
পঙ্কজ বলেন, সাকুলেন্ট মরুর দেশের উদ্ভিদ। এটিতে সাত-আট দিন পানি না দিলেও কিছুই হয় না। বাংলাদেশে বাসাবাড়িতে সাজসজ্জার কাজে এই উদ্ভিদের ব্যবহার বাড়ছে। সামনে আরও চাহিদা বাড়বে। তাই এটি আঁকড়ে ধরেই এগিয়ে যেতে চান। এখন মাসে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা বিক্রি করেন। এটি ধীরে ধীরে আরও বাড়বে। এর বাজার দেশের বাইরেও আছে।

গত ৯ আগস্ট পুঠিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্মৃতি রানী সরকার পঙ্কজের সাকুলেন্ট নার্সারি পরিদর্শন করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, খুব অল্প পুঁজিতে পঙ্কজ বাগান শুরু করেছিলেন ছাত্র থাকাকালে। প্রত্যন্ত গ্রামে এমন একটি উদ্ভিদের নার্সারি করা হয়েছে, এটা দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, নার্সারিতে যাওয়ার পর জানতে পারলেন, গত গরমে ভালো ছাউনি না থাকায় বাগানের সাকুলেন্ট কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাঁরা একটি প্রকল্পের আওতায় পঙ্কজের বাগানে পলি হাউস করে দেবেন। তিনি এ বিষয়ে সুপারিশও করেছেন বলে জানান।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top