রাজধানীর নিমতলী দেউড়ি এখন ঐতিহ্য জাদুঘর

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৫ আগস্ট ২০২২ ০৬:০৬; আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪ ০৩:০৫

ছবি : সংগৃহীত

জাদুঘরে ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষিত হয়। তবে সেসব ইতিহাসের সাথে একাকী দাঁড়িয়ে আলাপ করার সুযোগ হয়তো খুব কম জাদুঘরেই রয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে পুরান ঢাকার নিমতলীতে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক নিমতলী দেউড়ি। এখানেই বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির উদ্যোগে স্থাপন করা হয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটি ঐতিহ্য জাদুঘর। একা দাঁড়িয়ে আলাপ করার সুযোগ যে কয়টিতে রয়েছে তার মধ্যে এ জাদুঘর একটি, যেন নীরবে বর্ণনা করছে নায়েব নাজিম আর ঢাকার দু'শ বছরের ইতিহাস।

দেউড়ি ভবনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৭৬৩ সালে ইংরেজ ক্যাপ্টেন আর্চিবল সুইন্টনের নেতৃত্বে ইংরেজরা (ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি) ঢাকা দখল করেন। দখল পরবর্তী সময়ে তারা নায়েব নাজিমদের নাজিমুদ্দীন রোডের আবাসন থেকে বের করে দিয়ে বড় কাটরায় পাঠিয়ে দেন। অনেকে মনে করেন ইংরেজ ক্যাপ্টেন আর্চিবল সুইন্টনের পরে অনুশোচনা হয়, ফলে তিনি নায়েব নাজিমদের থাকার জন্যে একটি প্রাসাদ তৈরি করে দেন ঢাকার নিমতলীতে। বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল, শহীদুল্লাহ হল, অমর একুশে হল ও এর আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা এই প্রাসাদের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে জানা যায়। প্রাসাদটি নির্মাণ করা হয় ১৭৬৫-৬৬ সালে, এর তদারকি করতেন আর্চিবল নিজেই।

নায়েব নাজিমরা সেই প্রাসাদে তাদের আবাসন শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৮৪৩ সালে নায়েবি শাসনের অবসান হলে সে প্রাসাদ অযত্নে-অবহেলায় পড়ে থাকে। ১৮৯৭ সালে এই প্রাসাদের মূল ভবনসহ অধিকাংশ স্থাপনা ঘূর্ণিঝড়ে ভেঙে যায়। শুধুই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থেকে যায় নিমতলী দেউড়ি।

জানা যায়, নিমতলী দেউড়ির মতোই আরও একটি দেউড়ি ছিলো ফুলবাড়িয়া সরকারী কর্মচারী হাসপাতালের কাছাকাছি কোনো এক স্থানে। তবে ইতিহাস কিংবা কোনো ছবিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। অবশ্য আবিষ্কারের পূর্বে কোথাও নিমতলী দেউড়িরও উল্লেখ পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি এর কোনো ছবিও। পুরো প্রাসাদটি বিভিন্ন সময়ে ধ্বংস হয়ে যায়। শুধু এর ২৫৫ বছরের ইতিহাসের একমাত্র সাক্ষী হিসেবে রয়ে গেছে নিমতলী দেউড়ি।

দেউড়িতেই যাত্রা শুরু বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির
নিমতলী প্রাসাদের এই গেইট হাউজই সকলের কাছে নিমতলী দেউড়ি নামে পরিচিত। এই গেইট হাউজেই ১৯৫২ সালের ৩রা জানুয়ারি অরাজনৈতিক ও অলাভজনক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান' প্রতিষ্ঠা লাভ করে। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হলে এই প্রতিষ্ঠানের নাম পরিবর্তন করে 'বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি' করা হয়। এর পরপরই নতুন দুইটি ভবন নির্মাণ করে সেখানে এশিয়াটিক সোসাইটি কার্যক্রম পরিচালিত হতে থাকে। তখন থেকে আবারও অবহেলিত হয়ে পড়ে এই দেউড়ি।

দেউড়ি সংস্কার
১৬১০ সাল মতান্তরে ১৬০৮ সালে ঢাকাকে মোগল সাম্রাজ্যের বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রাজধানী করা হয়। সেই হিসেবে ঢাকার চারশো বছর পূর্ণ হয় ২০০৮ (মতান্তরে ২০১০) সালে। ২০০৯-১০ সালে ঢাকার চারশো বছরের ইতিহাস সংরক্ষণ প্রকল্পের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। সেই প্রকল্পের আওতায় 'রাজধানী ঢাকার ৪০০ বছর ও উত্তরকাল' নামে ২১ খন্ডের একটি বই প্রকাশ করা হয়। এর পাশাপাশি ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণের উদ্যোগও নেওয়া হয়। দেউড়ি ভবন সংস্কার তারই একটি অংশ।

স্থপতি অধ্যাপক সাঈদ আহমেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, এশিয়াটিক সোসাইটির সহ-সভাপতি অধ্যাপক শরীফ উদ্দিন আহমেদ, এশিয়াটিক সোসাইটির তৎকালীন সভাপতি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মাহফুজা খানম এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

সেই সংস্কার প্রকল্প গ্রহণের সময়েই ঠিক করা হয় যে এটি সংস্কার করে সংরক্ষণ করা হবে। পরবর্তীতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই দেউড়িতে একটি জাদুঘর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় এশিয়াটিক সোসাইটি কাউন্সিল।

২০১৭ সালে এই প্রকল্পের জন্য একটা প্রকল্পপত্র তৈরি করে তা পাঠানো হয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে। সেখান থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ে বাজেট বরাদ্দের পরেই পুরোদমে কাজ শুরু হয় এই জাদুঘরের।

২০১৮ সালেই শেষ হয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কার্যক্রম। সে বছরের ১১ই অক্টোবর জাদুঘরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। উদ্বোধনের পরপরই তা দর্শকের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়নি।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালের ৩রা জানুয়ারি বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই জাদুঘর দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

কীভাবে গড়ে তোলা হয়েছে এই সংগ্রহশালা
ইতিহাস সংরক্ষণের বা উদ্ধারের কাজ কখনও সহজ নয়। ব্যতিক্রম ছিলো না এই জাদুঘরও। নিদর্শন সংগ্রহের লক্ষ্যে ঢাকার স্থানীয়দের নিয়ে একটি কর্মশালার আয়োজন করে প্রতিষ্ঠানটি। এসব মানুষের পাশাপাশি আমন্ত্রণ করা হয় শিক্ষাবিদ, প্রকৌশলীসহ নানা পেশার মানুষকে। সকলের মতামতের ভিত্তিতে গড়ে তোলা হয় এই সংগ্রহশালা।

১৭১৭-১৮৪৩ পর্যন্ত নায়েব নাজিমরা এই অঞ্চলে ছিলেন। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে তাদের কোন নিদর্শন কারো কাছে ছিলো না এবং থাকার সম্ভাবনাও ছিলো না। সেজন্য ১৭০০ থেকে ১৯০০ এই দুইশো বছরের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে এই জাদুঘরে। পাশাপাশি সে সময়ের যেসব নিদর্শন ঢাকাবাসীর কাছে রয়েছে সেগুলো জমা দেওয়ার জন্য উন্মুক্ত আহ্বান করে কর্তৃপক্ষ। এতে অনেকেই এসে জমা দিয়েছেন তাদের কাছে থাকা বিভিন্ন নিদর্শন। মানুষের বাসায় বাসায় গিয়েও নিদর্শনগুলো সংগ্রহ করেছে কর্তৃপক্ষ। তবে এগুলোর কোনটিই কিনতে হয়নি তাদের, মানুষ নিজেরাই উপহার হিসেবে দেয়। সংগ্রহের এই প্রক্রিয়া নিয়ে বের করা হয়েছে একটি বই।

কেন মানুষ এই জাদুঘরে আসবে
কিউরেটর জাহাঙ্গীরকে করা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "এখানে আসবে আমাদের ২০০ বছরের ইতিহাস জানার জন্যে। এই জাদুঘরে আসলে ঢাকার ইতিহাস জানতে পারবে এবং ঐ সময়ে ঢাকার মানুষের জীবনযাত্রা কেমন ছিলো তা জানতে পারবে। সেসময়কার মানুষের পরিহিত বস্ত্র, তৈজসপত্র, বাসন-কোসন, মুদ্রা ইত্যাদির সাথে পরিচিত হতে পারবে। ইতিহাস জানার পাশাপাশি তা অনুভব করতে পারবে।"

তিনতলা বিশিষ্ট এই জাদুঘরে মোট ৫টি গ্যালারি রয়েছে। এর প্রতিটিতেই রয়েছে নানান ধরনের নিদর্শন। প্রতিটি গ্যালারিতে রয়েছে এলইডি স্ক্রিন। যেখানে দেউড়ির ইতিহাস, নায়েব নাজিমদের ইতিহাস প্রভৃতির ধারাবাহিক বর্ণনা দেখতে ও শুনতে পারবেন পর্যটকরা।

এসব গ্যালারির বাইরে এই জাদুঘরের মূল আকর্ষণ হলে নবাব নুসরাত জং এর দরবারের ডায়োরামা বা ত্রিমাত্রিক উপস্থাপন। এখানে নবাবকে হুক্কা হাতে তার দরবারে বসে থাকতে দেখা যাবে। পাশেই একজন দেহরক্ষী দাঁড়িয়ে, অন্য ভৃত্য হাতপাখায় বাতাস করতে মগ্ন।

গ্যালারিগুলোকে সংগৃহীত নিদর্শনের ভিত্তিতে বিভিন্ন নামও দেয়া হয়েছে।

গ্যালারি-১: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও এরসাথে জড়িত ব্যক্তিদের পরিচিতি রয়েছে।

গ্যালারি-২: নিমতলী দেউড়ি ভবন সংস্কার ও পুরনরুদ্ধারের ইতিহাসের সাথে জড়িত নিদর্শন দিয়ে সাজানো হয়েছে এই গ্যালারি।

গ্যালারি-৩: সুবা বাংলার ঐতিহাসিক পটভূমি এবং তার নিদর্শন।

গ্যালারি-৪: নায়েব নাজিমদের ইতিহাস

গ্যালারি-৫: ঢাকার জীবন ও শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে এই গ্যালারিতে। এখানে নায়েব নাজিমদের ব্যবহৃত নানা তৈজসপত্রের দেখা মিলবে।

বৃহস্পতি ও শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৬টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে জাদুঘরটি। শিক্ষার্থীরা ১০ টাকা, বিদেশিরা ২০০ টাকা এবং অন্যান্যরা ২০ টাকার বিনিময়ে এই ইতিহাসের সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবেন।

কারা এই নায়েব নাজিম?
সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোঘল সাম্রাজ্য নানা অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ঠিক সে সময়ে মুর্শিদকুলি খান বাংলায় অর্ধস্বাধীন নওয়াবি শাসনের সূচনা করেন। আঠারো শতকের শুরুতে দূরবর্তী এলাকা শাসন ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন করার ক্ষেত্রে নওয়াবদের সহযোগিতা করার জন্যে নতুন এক পদের সৃষ্টি করেন, যারা নায়েব নাজিম হিসেবে পরিচিত।

১৬ জন নায়েব নাজিম শত বছরেরও বেশি সময় ঢাকা ও এর আশেপাশের অঞ্চল শাসন করেন। ১৭১৭ থেকে ১৮৪৩ সালের এই দীর্ঘ সময়ে নায়েবরা তাদের আধিপত্য বজায় রেখেছেন। প্রথম নায়েব নাজিম ছিলেন মোহাম্মদ আলী খান। আর এই নায়েব নাজিমদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন নুসরাত জং।

১৭৭২ সালে লর্ড হেস্টিংস এর সময়ে তিনি প্রত্যেক জেলায় কালেক্টর নিয়োগ দেন। যার ফলে নায়েবরা তাদের ক্ষমতা হারায় ঠিকই তবে তারা তাদের পদ ধরে রাখতে সক্ষম হন। শেষদিকে নায়েব নাজিমরা ঢাকার প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সকল ধরনের প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলেন। এসময়ে তারা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করতেন।

নায়েবরা প্রথম দিকে ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে পুরাতন কারাগারের ভেতরে থাকা দুর্গের ভেতরে বাস করতেন। পরবর্তী সময়ে তাদেরকে সেখান থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকেরা বিতাড়িত করেন এবং থাকার জন্যে বড় কাটারায় পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে অবশ্য ক্যাপ্টেন আর্চিবল সুইন্টন নায়েবদের থাকার জন্যে পুরান ঢাকার নিমতলীতে সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করে দেন। সেখানে বাকি সময় তারা কাটান।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top