হানাদার মুক্ত তানোর দিবস

মহিব্বুল আরেফিন | প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২০ ০৫:০৬; আপডেট: ২৯ মার্চ ২০২৪ ০৮:২৩

তানোর থানা ও মুক্তিযোদ্ধাদের নামের একাংশ

আজ হানাদার মুক্ত তানোর দিবস। ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বরের এ দিনে রাজশাহীর তানোর উপজেলাকে পাক-হানাদার ও রাজাকারমুক্ত হিসেবে ঘোষনা করা হয়। তবে প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন করা হয় ১৭ই ডিসেম্বর। আর তানোরের গোল্লাপাড়া বাজার এলাকার বধ্যভূমি মুক্তিযুদ্ধেও ভয়ানয়ক স্মৃতি আজও বহন করছে।

রাজশাহীর তানোর উপজেলা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পায় ১৯৭১ সালের ৩০ শে নভেম্বর। এর আগে ২৯ শে নভেম্বর রাতে এখানে সর্বশেষ যুদ্ধ হয়। মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা বাহিনীর নেতৃত্ব দেন সফিকুর রহমান রাজা। ওই দিন তানোর বুরুজ গ্রামের বুরুজ ঘাট এলাকায় ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারদের সহযোগিতায় পাক বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পরে তাদের তানোর থানা টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্ত করতে ২৯ শে নভেম্বর তানোর থানায় হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

তানোর থানায় তখন অবাঙালী পুলিশ আর পাকিস্তানি সেনাদের স্থানীয় ঘাঁটি ছিলো। ওই রাতে সফিকুর রহমান রাজার নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল চার ভাগে বিভক্ত হয়ে তানোর থানায় অতর্কিত হামলা চালান। প্রবল আক্রমণের মুখে পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। থানার বন্দীদশা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের মুক্ত করেন। আর এটিই ছিল তানোরে সর্বশেষ সম্মুখযুদ্ধ। এসময় তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। তবে সিরাজুল ইসলাম ওরফে হানিফ মৃধা নামে আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হলেও তিনি বেঁচে যান। শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা হলেন রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের ছাত্র মোনায়েম মঞ্জুর, কাটাখালীর মাসকাটাদিঘী বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র মোঃ ইসলাম ও আরেকজন নাম না জানা আদিবাসী যুবক।

সফিকুর রহমান রাজা একটি গণ মাধ্যমে সাক্ষাৎকারে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তানোর থানা একাধিকবার আক্রমণ করা হয়। এর মধ্যে আগস্টের শেষের দিকে একটি সফল অপারেশন হয়। সেদিন থানা থেকে মুক্ত করে আনা হয় ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে। এদের মধ্যে চারজনই ছিলেন আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের যুবক। এই ছয়জনসহ আমরা মোট ৫০ থেকে ৬০ জন মুক্তিযোদ্ধা পবার দুয়ারি ও বাগধানী ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার অপারেশনে যাই। কারণ, পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি চলাচল বন্ধ করতে পারলে তাদের কোণঠাসা করা সহজ হবে। কিন্তু দুয়ারিতে যাওয়ার পর পাক হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। শুরু হয় সম্মুখ সমর। সারারাত যুদ্ধ চলে। অস্ত্র-গোলাবারুদের সংকটে ভোরের দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান। যে যেদিক দিয়ে পারেন এলাকা ত্যাগ করেন। পথে বুরুজ ঘাট এলাকায় মুসলিম লীগের এজেন্ট আইয়ুব আলী চেয়ারম্যান ছয় মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে ফেলে। চার আদিবাসীসহ এই ছয় মুক্তিযোদ্ধাকে তানোর থানায় নিয়ে বন্দী করে রাখা হয়। তখন আমার অধীনে ৩৫ থেকে ৪০ জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।”

তথ্য সূত্র বলে, রাজশাহী ৭ নম্বর সেক্টরের ৪ নম্বর সাব-সেক্টরের অধিনায়ক মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী এই এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয় ও পরবর্তীতে তিনিই অপারেশনের সফল পরিকল্পনা করেন। এর মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী’র মনোনীত মুক্তিযোদ্ধা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে জুলাই মাসের দিকে রাজশাহী শহর ও জেলার বিভিন্ন থানায় গেরিলা যুদ্ধ করার লক্ষ্যে পবা এলাকা দিয়ে প্রবেশ করেন। ২২ আগস্ট মুক্তিযোদ্ধারা গোদাগাড়ী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ রোডের ওপরে অভয়া ব্রিজে অপারেশন চালায়।
এ অপারেশনে নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে ৪০-৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা অংশ গ্রহন করেন। যার নেতৃত্বে দেন মেজর গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহনীর একজন এবং পাকিস্তানি পক্ষের ৯-১০ জন মারা যায়। যা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এ যুদ্ধের কথা প্রচারিত হয়।

এর আগে, ১৯৭১ সালের ১৪ এপ্রিল উপজেলার কামারগাঁ মহারাজার কাচারি বাড়ির সামনে পাকিস্তানি পতাকায় আগুন লাগিয়ে দেয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা। খবরটি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে পাকিস্তানি সেনারা এলাকায় খুঁজতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের। এ সময় রাজাকাররা বিভিন্ন স্থান থেকে সাধারণ মানুষদের ধরে কামারগাঁ দোলায়পুকুর ও তালন্দ তাতাল কুড়ীর মধ্যে গুলি করে মেরে পুঁতে রাখতো।

পরে যুদ্ধ শেষ পর্যায়ে পৌঁছালে ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে হানাদার বাহিনী ও রাজাকাররা পালিয়ে রাজশাহী শহরে চলে যায়। ফলে ১৩ ডিসেম্বর তানোরকে পাক হানাদার বাহিনী ও রাজাকারমুক্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সেই দিন কামারগাঁ মহারাজার কাচারি বাড়ি, তালন্দ জমিদার বাড়ির সামনে ও তানোর সদরে বাংলাদেশের মানচিত্র অঙ্কিত পতাকা উত্তোলন করা হয়। তবে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ে ১৭ই ডিসেম্বর। আর সেই থেকে ১৩ ডিসেম্বর তানোর মুক্ত দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হয়ে আসছে।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top