আশা-নিরাশার বাংলা সাহিত্য: ২০২১ সালে

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৬ জানুয়ারী ২০২২ ২১:২৫; আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪ ১৪:৩৪

করোনা মহামারির কারণে আশানুরূপ কাটেনি ২০২১ সাল। বিশ্বের সার্বিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। সেই কারণে দেশের সাহিত্য জগতেও স্থবিরতা লক্ষ্য করা গেছে। অমর একুশে বইমেলা সফল না হওয়া, পুরস্কার প্রদান কমে যাওয়া, বই প্রকাশে অনীহা, কবি-লেখকদের মৃত্যুসহ নানাবিধ বিষয় ভাবিয়েছে সাহিত্যকর্মীদের। তবে শত প্রতিকূলতার পরও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করেছে। ঝুঁকি নিয়ে বইও প্রকাশ করেছে কিছু প্রকাশনী। ফলে বলাই যায়, আশা-নিরাশার মাঝেই কেটেছে বছরটি।

করোনা নিয়ন্ত্রিত বইমেলা সফল হয়নি
করোনা সংক্রমণ বাড়ায় কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে চলমান বইমেলা এবার নির্ধারিত সময়ের দুই দিন আগেই শেষ হয়ে যায়। একদিকে করোনা অন্যদিকে লকডাউনের কারণে মানুষ প্রায় ঘরবন্দি ছিল। যে কারণে বইপ্রেমীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মেলায় আসেননি বলে বিক্রেতারা ছিলেন হতাশ। এমন প্রাণহীন বইমেলা আগে কখনো দেখেননি বলেও মন্তব্য করেছেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।

এ বছর ১৮ মার্চ শুরু হয় অমর একুশে বইমেলা। ওইদিন বিকেল ৩টায় গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি বইমেলা উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পরই মেলা উন্মুক্ত হয় সবার জন্য। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসে বইমেলা শুরু হলেও মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এ বছর বইমেলা শুরু হয় মার্চের ১৮ তারিখ থেকে। মেলা চলার কথা ছিল ১৪ এপ্রিল পর্যন্ত। কিন্তু অবশেষে দুই দিন আগেই শেষ হয়ে যায় প্রাণের বইমেলা।

২০২১ সালের পুরস্কার-সম্মাননা
এ বছর কবিকুঞ্জ পদক পেয়েছেন কবি আমিনুল ইসলাম। ভ্রমণ সাহিত্যে উদয় হাকিম ‘সংশপ্তক পুরস্কার’ লাভ করেন। বানান আন্দোলন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন কবি অরিত্র দাস, লেখক কিঙ্কর আহ্সান ও কথাসাহিত্যিক ফারজানা ইসলাম। চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন অনীক মাহমুদ, মাহমুদ কামাল ও রুমা মোদক।

সাহিত্যদেশ পাণ্ডুলিপি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন মো. জাকির হোসেন, নাসির আহমাদ রাসেল, সাইদুর রহমান, মঈন মুনতাসীর, আবেদীন জনী, ইউনুস আহমেদ, রিদওয়ানুর রহমান, ইমরুল ইউসুফ ও আলী হাসান। শুভজন পদক পেয়েছেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। এছাড়াও শুভজন গুণীজন সম্মাননা পেয়েছেন শহীদুল আলম এনডিসি ও মোহাম্মদ শামসুজ্জামান।

সাহিত্য দিগন্ত লেখক পুরস্কার পেয়েছেন ড. মির্জা গোলাম সারোয়ার পিপিএম, কামরুন নাহার রুনু, আশরাফুল হক মিঠু, রাজশ্রী বন্দোপাধ্যায়, কানিজ পারিজাত, শারমিন রহমান, রনি রেজা, জেসমিন দীপা, মেহবুবা হক রুমা, সালমা সুলতানা, ড. জ্যোৎস্নালিপি, নূর আলম গন্ধী, আশ্রাফ বাবু, আনিস আহমেদ, খন্দকার ফারহানা মুন্নি, মো. আব্দুল হামিদ সরকার, জেবিন আখন্দ, সোমা খান, অধম নূর ইসলাম, সৌরভী আলম আঁখি, সামিরা আব্বাসী, হাসিদা মুন, মোস্তফা হায়দার ও শারমিন জিকরিয়া।

মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন মাসুদুজ্জামান, প্রশান্ত মৃধা, জাহিদ হায়দার ও শেখ ফিরোজ আহমদ, ফারুক হোসেন ও ইলিয়াস ফারুকী। চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন ফারহানা রহমান, ড. তপন বাগচী, মিলু শামস, এনায়েত উল্যাহ সৈয়দ শিপুল, রহমান হাবিব, অদ্বৈত মারুত ও স্বরূপ রতন দত্ত।

বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কারপ্রাপ্তরা হলেন সরকার মাসুদ, মনি হায়দার, ড. তপন বাগচী, নাহিদা আশরাফী ও আরিফ রেহমান। মোহাম্মদ নূরুল হক, নিলুফা আক্তার, ফারুক সুমন, মামুন রশীদ, আবু আফজাল সালেহ, প্রত্যয় হামিদ চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি দোনাগাজী পদক পেয়েছেন।

সাহিত্যে সামগ্রিক অবদানের জন্য এক্সিম ব্যাংক-অন্যদিন হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন প্রবীণ কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। নবীন সাহিত্য শ্রেণিতে (অনূর্ধ্ব চল্লিশ বছর) পেয়েছেন ফাতেমা আবেদীন।

বাংলা একাডেমি প্রবর্তিত রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। মেহের কবীর বিজ্ঞানসাহিত্য পুরস্কার পেয়েছেন পাখি বিশেষজ্ঞ ইনাম আল হক। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলামকে সাহিত্যিক মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ প্রবন্ধসাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। মযহারুল ইসলাম কবিতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়া। সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন ড. তসিকুল ইসলাম রাজা। ‘করোনা বৃত্তান্ত’ বইয়ের জন্য হালীমা-শরফুদ্দীন বিজ্ঞান লেখক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন সৌমিত্র চক্রবর্তী। প্রথমবারের মতো অধ্যাপক মমতাজউদদীন আহমদ নাট্যজন পুরস্কার পেয়েছেন অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার।

এছাড়া একুশে পদক ২০২১ পেয়েছেন ভাষা ও সাহিত্যে কবি কাজী রোজী, বুলবুল চৌধুরী ও গোলাম মুরশিদ। মহাদেব সাহা পেয়েছেন সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার।

বছরের আলোচিত কিছু বই
এনআরবিসি ব্যাংক, রাশিয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদ যৌথভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু’ শীর্ষক স্মারকগ্রন্থ প্রকাশ করেছে। প্রায় সাতশ অন্তর্ভুক্তি সম্বলিত ১/৮ ডিমাই আকারের ১০০০ পৃষ্ঠার মহাগ্রন্থটি (এনসাইক্লোপিডিয়া) প্রকাশিত হয় ডিসেম্বরে, বিজয় দিবসের আগে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ ও পূর্ণমাত্রিক এই এনসাইক্লোপিডিয়া ‘মুজিবপিডিয়া’, এটি প্রকাশ করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিস্ট্রি অ্যান্ড কালচার সার্কেল বাংলাদেশ লিমিটেড।

অর্থনীতি, উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক দর্শন সাধারণ পাঠকের কাছে সহজ বিষয় নয়। কিন্তু যাঁর লেখনিতে বিষয়গুলো সহজ-সরলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে তিনি নিঃসন্দেহে অনন্য। কেউ যদি মুদ্রানীতি, শেয়ারবাজার, প্রবৃদ্ধি প্রভৃতি নাও জানেন তাতেও কোনো সমস্যা হবে না বোধগম্য করে লেখা প্রবন্ধগুলো পড়ে। প্রকৃতপক্ষে ২৯৫ পৃষ্ঠার ‘গতিময় অর্থনীতি নির্বাচিত প্রবন্ধ সংকলন (২০২১)’ পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক ড. শামসুল আলমের চিন্তন মনস্কতা ও উন্নয়ন অভীপ্সার অন্যতম প্রকাশনা। মুজিববর্ষে প্রকাশিত এ গ্রন্থে তিনি দ্রুত পাল্টে যাওয়া বাংলাদেশের পুরো ছবি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন।

লেখক ও সাংবাদিক রণজিৎ সরকারের বই প্রকাশ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ই-কমার্স সাইট অ্যামাজন ডটকম। বইটি ইংরেজিতে লেখা। এর নাম ‘এমিলিয়া জার্নি উইথ অ্যানিম্যালস।’ বাংলাদেশের আরেক তরুণ লেখক অরণ্য পাশা। তিনি একাধারে মডেল ও গীতিকার। তার লেখা ইংরেজি প্রথম বই ‘মি. অ্যাংরি ওয়াটারমিলান’ প্রকাশিত হয়েছে। শিশুদের এ গল্পের বই প্রকাশ করেছে বিখ্যাত ই-কর্মাস সাইট অ্যামাজন ডটকম।

সাদাত হোসাইন সময়ের আলোচিত জনপ্রিয় লেখক ও নির্মাতা। তার নতুন বই মানেই পাঠকের সীমাহীন আগ্রহ। কাগজের মোটা মোটা বই পেতে বইমেলায় পাঠকের দীর্ঘ সারি সবার নজর কেড়েছে অনেক আগেই। তবে এবার ব্যতিক্রম আয়োজনে এসেছে তার নতুন বই। ই-বুক আকারে আসা অতিপ্রাকৃত উপন্যাসটির নাম ‘সে এখানে নেই’। বইটি প্রকাশ করেছে বইঘর।

যাদের হারিয়েছে সাহিত্য জগত
২০২০ সালের করোনার ধাক্কা গিয়ে পড়ে ২০২১ সালেও। এ বছর বেশকয়েকজন গুণীব্যক্তিত্বকে হারিয়েছি আমরা। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি একুশে পদক বিজয়ী বাংলাদেশি লেখক রাবেয়া খাতুন মারা যান। বেশ কিছুদিন বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগে বনানীতে নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক ও বিশিষ্ট প্রতœগবেষক খন্দকার মাহমুদুল হাসান ২৮ জানুয়ারি রাত ১১টা ১০ মিনিটে রাজধানীর গ্রিনলাইফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা মারা যান।

২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মারা যান লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ। মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

একই বছর ২৫ মে মারা যান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। পাকস্থলীর সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। অবস্থার অবনতি হলে ভ্যান্টিলেশনে নেওয়া হয় কবিকে। সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি তার।

লেখক ও অনুবাদক শেখ আবদুল হাকিম ২৮ আগস্ট দুপুর ১টায় রাজধানীর নিজ বাসায় মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। অবশ্য তার মৃত্যর পরে তিনি মাসুদ রানা ও কুয়াশা সিরিজের লেখক সত্ত্ব লাভ করেন। মৃত্যুর আগেই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন এ লেখক। একই দিনে মারা যান কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী। ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে রাজধানীর পুরান ঢাকায় নিজ বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক, ছড়াকার, শিশু সংগঠক, নাট্যকার ও প্রবীণ সাংবাদিক রফিকুল হক দাদুভাই ১০ অক্টোবর সকাল ১১টায় নিজ বাসায় তিনি ইন্তেকাল করেন।

স্বাধীনতা পুরস্কার ও একুশে পদকজয়ী কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ৮২ বছর বয়সে ১৫ নভেম্বর মারা যান। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগে রাজশাহীর বাসভবনে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

একুশে পদকপ্রাপ্ত নজরুল গবেষক বাংলা একাডেমির সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম ৩০ নভেম্বর মারা যান। ফুসফুসের জটিলতায় ভুগে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

হয়নি লিট ফেস্ট
২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিতব্য ঢাকা লিট ফেস্টের দশম আসর স্থগিত করা হয়েছিল। করোনা সংক্রমণের কারণে এটি পিছিয়ে ২০২২ সালে আয়োজন করা হবে বলে জানিয়েছিল আয়োজক প্রতিষ্ঠান।



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top