বেসরকারি অনেক ব্যাংকের নেতৃত্বে দ্বিতীয় প্রজন্ম

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ২৮ আগস্ট ২০২২ ২২:৩৯; আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ২২:১০

ছবি: সংগৃহিত

দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে অনেক বেসরকারি ব্যাংক। যেসব ব্যাংক এর আগেও ছিল নানা সমস্যায় জর্জরিত। সংশ্লিষ্টরা বিষয়টাকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। খবর বণিক বার্তার।

এক দশক আগেও দেশের সমস্যাগ্রস্ত ব্যাংকের তালিকায় নাম ছিল বেসরকারি খাতের দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেডের। দ্বিতীয় প্রজন্মের হাত ধরে ব্যাংকটি এখন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকের কাতারে উঠে এসেছে। ২০০৭ সালে সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন আজিজ আল কায়সার। ব্যাংকটির অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা ও পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এমএ হাশেমের সন্তান তিনি। এটি ছিল উদ্যোক্তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে বেসরকারি ব্যাংক ছেড়ে দেয়ার প্রথম ঘটনা।

দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেয়ার ঘটনা এর পরেও আরো অনেক ঘটেছে। বর্তমানে দেশের প্রথম সারির ছয়টি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছে উদ্যোক্তাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম। সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার ছাড়াও এ তালিকায় থাকা অন্যরা হলেন প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান তানজিল চৌধুরী, এনসিসি ব্যাংকের চেয়ারম্যান মো. আবুল বাশার, ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসানুল আলম ও আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সেলিম রহমান। গতকাল এ তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ব্যাংক এশিয়ার চেয়ারম্যান রোমো রউফ চৌধুরী। তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান আ. রউফ চৌধুরীর ছেলে।

প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান তানজিল চৌধুরী ব্যাংকটিরই সাবেক চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরীর সন্তান। আর মো. আবুল বাশার এনসিসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল আউয়ালের ছেলে। ইউনিয়ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসানুল আলম এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম মাসুদের জ্যেষ্ঠ সন্তান। অন্যদিকে আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সেলিম রহমান কেডিএস গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা খলিলুর রহমানের ছেলে। দেশের বেসরকারি ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদেও উদ্যোক্তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

চেয়ারম্যান পদ ছাড়াও দেশের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের বেশির ভাগ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন উদ্যোক্তাদের দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিরা। এর মধ্যে প্রয়াত জয়নুল হক সিকদারের সন্তানরা ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) লিমিটেডের নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রয়াত আখতারুজ্জামান বাবুর সন্তানরা। এছাড়া পূবালী ব্যাংক, উত্তরা ব্যাংক, আইএফআইসি, এবি ব্যাংকের মতো প্রথম প্রজন্মের ব্যাংকগুলোর পর্ষদেও দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের বড় অংশই শূন্য থেকে বড় হয়েছেন। অনেকেরই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল খুবই কম। নিজেদের মেধা ও পরিশ্রমে প্রথমে পুঁজি গঠন করেছেন। এরপর ব্যাংকের উদ্যোক্তা হয়ে বেসরকারি ব্যাংক গড়ে তুলেছেন। এখন সেসব ব্যাংকের নেতৃত্বে আসছে দ্বিতীয় প্রজন্ম। মূল উদ্যোক্তাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে দ্বিতীয় প্রজন্মের উচ্চশিক্ষা ও প্রযুক্তির জ্ঞান। দ্বিতীয় প্রজন্ম সততার সঙ্গে ব্যাংকের নেতৃত্ব দিলে দেশের অনেক বেসরকারি ব্যাংকেরই আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত। ইউরোপ-আমেরিকার স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে তারা উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন। পাশাপাশি দ্বিতীয় প্রজন্মের রয়েছে প্রযুক্তিগত জ্ঞান। অভিজ্ঞতা যা-ই থাকুক, দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে ব্যাংকগুলো ভালো করবে বলেই আমার বিশ্বাস।

নজরুল ইসলাম মজুমদার আরো বলেন, যে কয়টি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে দ্বিতীয় প্রজন্ম দায়িত্ব নিয়েছে, তাদের ব্যক্তিগতভাবে আমি চিনি। তারা ভালো করছেন বলেও আমি জেনেছি। আশা করছি, বর্তমান বিশ্বের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে তারা ব্যাংকের যোগ্য নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে উঠতে পারবেন।

দেশে প্রথম প্রজন্মের শিল্পোদ্যোক্তাদের হাত ধরে গড়ে ওঠে বেসরকারি ব্যাংক। আশির দশকের শুরুতে দেশে বেসরকারি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা আরম্ভ হয়। বর্তমানে এ খাতের ব্যাংকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৩। প্রথম প্রজন্মের কোনো কোনো ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার চার দশকও পূর্ণ হয়েছে। এসব ব্যাংক উদ্যোক্তাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। জীবিত থাকলেও অনেকেই বার্ধক্যের ভারে ন্যুব্জ। এ কারণে দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে ব্যাংকগুলোর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বর্তাচ্ছে। আবার অনেকে নিজ সন্তানদের ব্যাংকে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হচ্ছেন। চেয়ারম্যান পদ ছেড়ে দিয়ে সন্তানকে নিজের চেয়ারে বসাচ্ছেন। আবার নিজেও ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে থেকে সন্তানের অবস্থান পোক্ত করছেন।

১৯৮৩ সালে ১২ জন তরুণ শিল্পোদ্যোক্তা মিলে গড়ে তোলেন বেসরকারি খাতের দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড। এ উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এমএ হাশেম। ২০০৭ সালে মূল উদ্যোক্তারা ব্যাংকটি দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে ছেড়ে দেন। ওই সময় ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নেন এমএ হাশেমের জ্যেষ্ঠ সন্তান আজিজ আল কায়সার। মাঝে বিরতি দিয়ে বর্তমানেও তিনি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালন করছেন। সিটি ব্যাংকের মূল উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন শিল্পোদ্যোক্তা আনোয়ার হোসেন। বর্তমানে ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান পদে নেতৃত্ব দিচ্ছেন আনোয়ার হোসেনের ছেলে হোসেন খালেদ।

দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে ব্যাংকটির রূপান্তর বিষয়ে জানতে চাইলে সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার বণিক বার্তাকে বলেন, চলতি দশকের প্রথম দিকে আমরা দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিরা সিটি ব্যাংকের হাল ধরি। এ ব্যাংকের ট্রান্সফরমেশনের মূল কাজ শুরু হয় ২০০৭ সালে। বিদেশী ব্যাংকে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা টিম আনা হয়। সে সময় সিটি ব্যাংকের অনেক সমস্যা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ‘প্রবলেম ব্যাংক’ হিসেবে চিহ্নিত এটি। সিটি ব্যাংকের পর্ষদে বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যবেক্ষক বসতেন। সে পরিস্থিতি থেকে ব্যাংকটি আজকের অবস্থানে এসেছে।

আজিজ আল কায়সার বলেন, আমার সৌভাগ্য যে দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মধ্যে যারা পর্ষদে ছিলেন এবং এখনো আছেন তারা নিঃশর্তভাবে ও আন্তরিকতার সঙ্গে পুরো কমপ্লায়েন্ট, প্রযুক্তিমুখী, আধুনিক নতুন সিটি ব্যাংক গড়তে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। ২০০৭ সাল-পরবর্তী সময়ে আমরা ব্যাংকটির প্রতিটি দিক ও বিভাগ নতুন করে সাজিয়েছি। এ কারণে সিটি ব্যাংক বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংকে রূপান্তর হতে পেরেছে। বর্তমানে দেশের রিটেইল ব্যাংকিংয়ে আমাদের আধিপত্য সর্বাধিক। আইএফসির মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এখন সিটি ব্যাংকের অংশীদার। সিটি ব্যাংক এখন মুনাফায়, রিটার্ন অন ইকুইটিতে, নামে-সুনামে দেশের প্রথম তিন ব্যাংকের একটি। দ্বিতীয় প্রজন্মের পরিচালকরা ব্যাংকে যে আসলেই সুশাসন আনতে পারেন, স্বচ্ছতা আনতে পারেন সিটি ব্যাংক এ দেশে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। আমাদের মডেল অনুসরণ করে যেকোনো ব্যাংক তার ট্রান্সফরমেশন সম্পন্ন করতে পারে।

প্রাইম ব্যাংকের প্রধান উদ্যোক্তাদের একজন ইস্ট কোস্ট গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আজম জে চৌধুরী। বেসরকারি খাতের নেতৃস্থানীয় এ ব্যাংকের দীর্ঘকালীন চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০২০ সালে আজম জে চৌধুরী প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে দাঁড়ান। ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব নেন তারই সন্তান তানজিল চৌধুরী। ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি প্রাইম ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদে থাকবেন।

দ্বিতীয় প্রজন্মের হাতে ব্যাংকের নেতৃত্ব ছেড়ে দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আজম জে চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, উচ্চশিক্ষা, জ্ঞান, আধুনিক প্রযুক্তিতে দ্বিতীয় প্রজন্ম অনেক বেশি সমৃদ্ধ। তবে এ প্রজন্মের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা নেই। পেছন থেকে গাইড করা না হলে এ প্রজন্মের প্রতিনিধিরা ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এ কারণেই পুরনো-নতুন সংমিশ্রণে প্রাইম ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। দেশের প্রথম প্রজন্মের ব্যবসায়ীরা অনেক ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করে আজকের অবস্থানে এসেছেন। দুর্যোগ মোকাবেলার অভিজ্ঞতা দ্বিতীয় প্রজন্মের নেই। তবে আশা করছি, অর্জিত জ্ঞান দিয়ে তারা নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে পারবেন।

মূল খবরের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top