চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভারসাম্য জটিল রূপ নিচ্ছে

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১ সেপ্টেম্বর ২০২২ ২২:২৫; আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ০৩:৩১

ছবি: সংগৃহিত

আন্তর্জাতিক পরাশক্তি গুলোর সাথে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক রক্ষা করতে বেগ পেতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে পরাশক্তিধর দেশগুলোর দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান দূরত্ব এই সমস্যা আরো বাড়িয়ে তুলছে। খবর টিবিএসের। 

বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ওপরেই সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল বাংলাদেশ। এর মধ্যে দেশে আমদানি পণ্যের সবচেয়ে বড় উৎস হলো চীন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র হয়ে উঠেছে বৃহত্তম রফতানি গন্তব্য। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের দিক থেকে বড় সম্পর্ক রয়েছে ভারতের সঙ্গেও। দেশ তিনটির মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ খাতে সম্পর্ক বেশি দৃশ্যমান হলেও চীন ও ভারতের ক্ষেত্রে তা দেখা যায় প্রধানত কানেক্টিভিটি, অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে।

বাংলাদেশে এখন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারত—এ তিন দেশেরই সফট পাওয়ারের (বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা) প্রভাব দিনে দিনে বাড়ছে। প্রতি বছর প্রচুরসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য দেশ তিনটিতে পাড়ি দিচ্ছেন। শক্তিশালী হয়ে উঠছে সাংস্কৃতিক যোগাযোগও। যদিও আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য করে চলা বাংলাদেশের জন্য জটিল হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন অনেক পর্যবেক্ষক।

তাদের ভাষ্যমতে, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথ এখন শুধু ভূরাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনৈতিক পরাশক্তি হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায়ও লিপ্ত রয়েছে দেশ দুটি। এর মধ্যেই তাইওয়ান ইস্যুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বৈরিতার মাত্রা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। দুটি দেশই বিশ্বের অন্যান্য দেশকে নিজ নিজ প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর। আবার ভারতের সঙ্গেও চীনের বৈরিতা মারাত্মক আকার নিয়েছে। গত পাঁচ বছরে অন্তত দুইবার যুদ্ধ শুরুর পরিস্থিতিতে চলে গিয়েছিল দেশ দুটি। এমন পরিস্থিতিতে তিন দেশের সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা যেকোনো দেশের জন্যই মুশকিল। তবে এখন পর্যন্ত এদিক থেকে অনেকটাই উতরে গিয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) সবচেয়ে বড় উৎস এখন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত হালনাগাদকৃত তথ্য অনুযায়ী, দেশে মার্কিন পুঞ্জীভূত এফডিআইয়ের (এফডিআই স্টক) পরিমাণ এখন ৪৩৯ কোটি ডলারের বেশি। এদিক থেকে চীনের অবস্থান পঞ্চম। দেশে চীনের এফডিআই স্টকের পরিমাণ প্রায় ১৪৪ কোটি ডলার। এফডিআই স্টকের উৎস হিসেবে তালিকায় দশম অবস্থানে রয়েছে ভারত। বাংলাদেশে ভারতীয় এফডিআই স্টকের পরিমাণ ৭৬ কোটি ডলারের কিছু বেশি।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধানত ভারতকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকেই গুরুত্ব দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এ অঞ্চলে চীনকে ভূরাজনৈতিকভাবে মোকাবেলার জন্য ভারতের ওপরেই সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। এতে করে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির টাগ অব ওয়ারও এখন ভারত ও চীনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এখন পর্যন্ত সফলতার সঙ্গে এ দ্বৈরথে জড়িয়ে পড়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত ও কূটনৈতিক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবির বণিক বার্তাকে বলেন, তিনটি দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তিন ধরনের। ভারত বা চীন আমাদের আমদানির উৎস। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের শীর্ষ রফতানি গন্তব্য। আমরা যদি সক্ষম ও দক্ষ কূটনীতি বজায় রাখতে পারি, ভূরাজনৈতিক দ্বৈরথ আমাদের জন্য খুব একটা সমস্যার কারণ হবে না। বরং আমাদের দেখতে হবে এখানে কার বিনিয়োগ সক্ষমতা বেশি। চীনের দিক থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুযোগ আছে। তারা যে অন্য খাতে খুব একটা বিনিয়োগ করে, তা কিন্তু না। অন্যান্য খাতে বিনিয়োগটা আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আবার আমাদের রেমিট্যান্সের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসও যুক্তরাষ্ট্র। কাজেই আমাদের খতিয়ে দেখতে হবে কোন জায়গায় সবচেয়ে বেশি সুবিধা আসে। এ মুহূর্তে বাজারের দিক থেকে বড় হলো যুক্তরাষ্ট্র। পণ্য দেয়া গেলে সেখানকার বাজার সীমাহীন সম্ভাবনার। দক্ষিণে সুনীল অর্থনীতির কথা বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভালো বিনিয়োগ কেউ করতে পারবে না। কাজেই চিন্তা করতে হবে কোন জায়গায় কোন দেশটি আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্প। আবার চীন আমাদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে সাশ্রয়ী উৎস। কাজেই সে সুবিধাটাও আমাদের নিতে হবে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই আমাদের ভূরাজনৈতিক দ্বৈরথের বাইরে থেকেই দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

তিনি আরো বলেন, এখানে আমি মনে করি খুব সক্ষম ও গভীর কূটনীতি দরকার, যেটা ভিয়েতনাম করছে। তারা চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক রাখছে, আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নিরাপত্তার সম্পর্ক রাখছে। তারা আবার জাপান-রাশিয়ার সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক বজায় রাখছে। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতির সফল বাস্তবায়ন করতে হলে সক্ষমতা দরকার। সেই সক্ষমতাটা শুধু কূটনীতিকদের থাকলে হবে না। সরকারের সব পর্যায়েই এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বোঝাপড়া ও উদ্যোগ থাকতে হবে। ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কেও এ বিষয়গুলোর সঙ্গে এক হতে হবে।

সব মিলিয়ে নীতিনির্ধারণী, কূটনীতিক, গবেষক বা ব্যবসায়ী পর্যায়ে সবাইকে এদিক থেকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। এদিক থেকে আমাদের এখনো অনেক উন্নতি করতে হবে।

ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক নৈকট্য এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বড় মিত্র হিসেবে ভারতের ভূমিকা দেশটিকে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী সপ্তাহেই দেশটিতে সফরে যাচ্ছেন। তার এ সফর চলাকালে দুই দেশের মধ্যে বেশকিছু চুক্তি হওয়ার কথা রয়েছে।

গত কয়েক বছরে দেশে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশকিছু মেগা প্রজেক্ট ভারতীয় অর্থায়নে বাস্তবায়ন হয়েছে। বর্তমানেও দেশটির অর্থায়নে কয়েকটি বড় প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হলো খুলনা-মোংলা বন্দর রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প। এ প্রকল্পের আওতায় রূপসা নদীর ওপর রেলসেতু নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। রেলওয়ের ঢাকা-টঙ্গী সেকশনের তৃতীয় ও চতুর্থ ডুয়াল গেজ এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়াল গেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এর বাইরেও আরো কয়েকটি প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। তবে আঞ্চলিক কানেক্টিভিটিতে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই এখন রেল যোগাযোগের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে বেশি।

উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) আওতায় দক্ষিণ এশিয়ায় বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করে চলেছে চীন। এসব বিনিয়োগ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়েছে কানেক্টিভিটি, অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এর জবাবে ভারতও এখন আঞ্চলিক ও উপআঞ্চলিক জোটের ভিত্তিতে খাতগুলোয় বিনিয়োগ করে চলেছে। তবে খাতগুলোয় বিনিয়োগের ব্যাপকতা ও সক্ষমতার দিক থেকে বহুলাংশে এগিয়ে রয়েছে চীন।

বর্তমানে দেশে চীনা অর্থায়নে সব মিলিয়ে বেশকিছু বড় প্রকল্প চলমান রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সড়ক ও রেল যোগাযোগ এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতেই চীনা বিনিয়োগ রয়েছে সবচেয়ে বেশি। কর্ণফুলী নদীর তলদেশে চীনা অর্থায়নে তৈরি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল প্রকল্প। ৩ হাজার ৪০০ মিটার দীর্ঘ টানেলটি নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। পদ্মা বহুমুখী সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। প্রকল্পটিতে চীনা এক্সিম ব্যাংকের বিনিয়োগ প্রায় ২১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। পটুয়াখালীর পায়রায় ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকার বেশি। রাজধানী ঢাকায় ডিপিডিসির বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ রয়েছে ১১ হাজার ৯২৪ কোটি টাকা। এছাড়া ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে চীনের অর্থায়ন রয়েছে ১০ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০-২১-এর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশকে প্রায় ৪৬৩ কোটি ২৪ লাখ ডলারের ঋণ ছাড় করেছে চীন।

বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কানেক্টিভিটি ও অবকাঠামো খাতে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত অনুপস্থিত যুক্তরাষ্ট্র। তবে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের বড় অংশীদার হয়ে উঠেছে দেশটি। দেশের গ্যাস খাতে এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় বিদেশী প্রতিষ্ঠান এখন মার্কিন কোম্পানি শেভরন। বাংলাদেশে দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ব্যবসা করছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমানে দেশে জাতীয় গ্রিডে স্থানীয় পর্যায়ে সরবরাহকৃত গ্যাসের ৬০ শতাংশই আসছে শেভরনের পরিচালনাধীন কূপগুলো থেকে। কোম্পানিটি এখন দেশের গ্যাসসহ জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ আরো বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়ও কোম্পানিটির ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের পরিকল্পনা এখন শুধু বাংলাদেশকেন্দ্রিক। এছাড়া মার্কিন অন্যান্য কোম্পানিও জ্বালানি খাতের অংশীদার হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে এসেছে দীর্ঘদিন ধরেই।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে নানা খাতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে প্রধানত ইউএসএআইডি, মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) ও দেশটির অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে। মূলত কৃষি, খাদ্যনিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি, জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শিক্ষা খাতে এসব সহযোগিতা করা হচ্ছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকেই দেশে ঋণ সহায়তা দিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত এর পরিমাণ ৭০০ কোটি ডলারেরও বেশি।

গত এক দশকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংকট্যাংক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক রিসার্চ ফেলো জেফ সি স্মিথের ভাষ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। বিশেষ করে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে দুই দেশ যৌথ উদ্যোগে সহযোগিতামূলক অবস্থানও নিয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আইনিভাবে সমুদ্রসীমার বিরোধ নিষ্পত্তিসহ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বেশকিছু দায়িত্বশীল পদক্ষেপ নেয়ায় ওয়াশিংটনও বারবার বাংলাদেশের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছে।

দেশের বাণিজ্য খাতেও চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রেরই আধিপত্য সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মোট পণ্য আমদানির প্রায় অর্ধেকই আসে দেশ তিনটি থেকে। এর মধ্যে দেশের পণ্য আমদানির সবচেয়ে বড় উৎস চীন। দেশটি থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট ১ হাজার ২৯২ কোটি ৫২ লাখ ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ, যা মোট আমদানির ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ। ভারত থেকে আমদানি হয়েছে ৮৫৯ কোটি ডলারের বেশি পণ্য, যা মোট আমদানির প্রায় ১৭ শতাংশ। তবে দেশের পণ্য আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান তেমন একটা বেশি নয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি করেছে ২২৬ কোটি ৮২ লাখ ডলারের কিছু বেশি, যা মোট আমদানির ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি কম হলেও এ দেশটিই এখন বাংলাদেশী পণ্যের প্রধান রফতানি গন্তব্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে দেশটিতে পণ্য রফতানি হয়েছে ৬৯৭ কোটি ডলারের বেশি। ভারতে পণ্য গিয়েছে প্রায় ১২৮ কোটি ডলারের। তুলনামূলক কম রফতানি হয়েছে চীনে। ২০২০-২১ অর্থবছরে চীনে ৬৮ কোটি ডলারের সামান্য বেশি পরিমাণে পণ্য রফতানি করেছে বাংলাদেশ।

যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো বৃহৎ অর্থনীতিগুলোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এখনো দেশের কূটনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর অনেক সুযোগ রয়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (অ্যামচেম) সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনে আমাদের রফতানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে কূটনৈতিক মহলের বড় ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। দেশ তিনটির বাণিজ্য বিভাগের সঙ্গে সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সেখানে বাজার সম্প্রসারণ ও রফতানি পণ্যের সংখ্যা বাড়ানোর সম্ভাবনাগুলোকে খতিয়ে দেখা যেতে পারে।

এক্ষেত্রে কূটনৈতিক মহল থেকে আরো বড় অবদানের সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কূটনীতি মানেই অর্থনীতি। অন্য দেশের রাষ্ট্রদূতরা এখানে এসে বিভিন্ন চেম্বারে মিটিং করে। তারা বিভিন্ন জায়গা বা শিল্প-কারখানাগুলোয় যাচ্ছে, নিজস্ব বিনিয়োগগুলো পরিদর্শন করছে। এ জায়গায় আমার মনে হয় আমাদের অনেক উন্নতি করার সুযোগ রয়েছে। এছাড়া আমাদের ট্রেড কাউন্সিলর হিসেবে দক্ষ ব্যক্তিদের পাঠানো উচিত। যেমন যিনি দীর্ঘদিন অর্থ মন্ত্রণালয় বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কাজ করেছেন, এমন কাউকে যদি পাঠানো যায় আমরা ভালো ফলাফল পাব। এখানে আমাদের দক্ষ লোক পাঠানো উচিত। এখানে আমরা খুবই দুর্বল। বেসরকারি খাত থেকেও এটার জন্য বাছাই করা যেতে পারে।

বাংলাদেশের অস্ত্র আমদানিতেও বড় অবদান রাখছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এসআইপিআরআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আট বছরে বাংলাদেশে ২৩৭ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে চীন। এ সময় বাংলাদেশের শীর্ষ অস্ত্র সরবরাহকারীতে পরিণত হয়েছে চীন। একই সময়ে দেশে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম আমদানি হয়েছে ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলারের। দেশে সমরাস্ত্র সরবরাহকারীর তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখন তৃতীয়। উল্লিখিত সময়ে ভারত থেকে অস্ত্র আমদানির কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।


সামনের দিনগুলোয় পানি সমস্যা বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কে অস্বস্তি তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের। এ বিষয়ে বার্লিনভিত্তিক মেরকাটর ইনস্টিটিউট ফর চায়না স্টাডিজের এক সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণে বলা হয়, উজানে ব্রহ্মপুত্র নদে চীনের বাঁধ দেয়ার পরিকল্পনা বাংলাদেশের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। দেশের কৃষি, বন ও মত্স্য খাতে পানিপ্রবাহের প্রধানতম উৎসগুলোর একটি হলো ব্রহ্মপুত্র। দেশের জিডিপিতে খাত তিনটির অবদান সাড়ে ১২ শতাংশ। চীনের এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তিনটি খাতই মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা দুই দেশের সম্পর্কে শীতলতারও কারণ হয়ে ওঠার বড় আশঙ্কা রয়েছে।

তবে চীনের সঙ্গে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈরথ দেশ তিনটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, গোটা বিশ্ব এখন বহু মেরুকরণের দিকে যাচ্ছে। সেটা থামানোর কোনো উপায় নেই। আমরা এসব মেরুকরণের কোনোটিতেই অংশ নিচ্ছি না। যদি সেদিকে যেতাম তাহলে সে চিন্তা থাকত। স্নায়ুযুদ্ধের সময় সোভিয়েত বনাম যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিমেরুকরণের অংশ হয়নি বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর পরই ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’—এমন নীতি গ্রহণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পিছপা হননি। আর এখন তো দ্বিমেরুকরণের কোনো সুযোগই নেই। বরং এখন সবাই বহুমেরুকরণের দিকে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে রাশিয়া, ভারত বা ইউরোপসহ একাধিক মেরুকরণ থাকবে। এসব মেরুকরণের মধ্যেও সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষা করছে বাংলাদেশ। দ্বিমেরুকরণে গেলে বৈরিতার সুযোগ থাকত। তার ওপর আমাদের কোনো শত্রু নেই। এমনকি রোহিঙ্গা ইস্যুতেও মিয়ানমারের সঙ্গে শত্রুতা হয়নি। আমরা বাণিজ্য করে যাচ্ছি। মানুষও আসা-যাওয়া করছে এখনো। এর একটাই কারণ, আমাদের অর্থনীতি ঠিক রাখা। আমরা কারো সঙ্গে যুদ্ধেও জড়াইনি। কারো সঙ্গে জড়াবও না। বাংলাদেশ সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রেখে একটি অর্থনৈতিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছে, যার কারণে সামরিক নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশ চিন্তিত না। আর এটা সবাই বোঝে বাংলাদেশ অথনৈতিক উন্নয়নের তাগিদেই সবার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখছে। অতএব ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—এ তিন দেশের সঙ্গে একসঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখাটা বাংলাদেশের জন্য আরো সুযোগ তৈরি করে দেবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

মূল খবরের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top