পৌনে ৯ লাখ নতুন শ্রমিকের রেমিট্যান্স গেল কোথায়

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১ নভেম্বর ২০২২ ১৯:৪২; আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ০৮:০৮

ছবি: সংগৃহিত

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার দেশের রেকর্ড সংখ্যক লোক বিদেশ গমন করেছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিয়েছেন ৮ লাখ ৭৪ হাজার শ্রমিক। বণিক বার্তার।

পাড়ি জমানো প্রবাসীদের সিংহভাগেরই গন্তব্য ছিল সৌদি আরব। সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার, কুয়েত, সিঙ্গাপুরেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশী অভিবাসী হয়েছেন। শ্রমিকের সংখ্যার সঙ্গে প্রধান এসব শ্রমবাজার থেকে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহও বাড়ার কথা। কিন্তু একেবারেই বিপরীত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, দেশের প্রধান শ্রমবাজার সৌদি আরব থেকে গত অর্থবছরে (২০২১-২২) রেমিট্যান্স প্রবাহ ২১ শতাংশ কমেছে। সে ধারাবাহিকতা এখনো অব্যাহত। চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশটি থেকে আসা রেমিট্যান্স কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। অথচ চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশে অভিবাসী হয়েছেন ৫ লাখ ১৩ হাজার ৬৫৩ বাংলাদেশী শ্রমিক। ২০২১ সালেও পাড়ি দিয়েছেন ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ জন।

সৌদি আরব ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের যে দেশগুলোয় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বাংলাদেশী শ্রমিক অভিবাসী হয়েছেন, তার সবক’টি থেকেই কমেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ। গত অর্থবছরে ১৫ শতাংশ রেমিট্যান্স কমেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। একই সময়ে কুয়েত থেকে কমেছে ১০ দশমিক ৪৩, ওমান থেকে ৪১ দশমিক ৫৬ ও কাতার থেকে ৭ দশমিক ১৫ শতাংশ রেমিট্যান্স আহরণ। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম প্রধান শ্রমবাজার সিঙ্গাপুর থেকেও রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে ৩৮ শতাংশের বেশি। চলতি অর্থবছরে সেই প্রবাহ আরো বেশি নিম্নমুখী। সেপ্টেম্বরে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স এসেছে মাত্র ১৭ কোটি ৮৩ লাখ ডলার। অথচ আগের মাস আগস্টেও দেশটি থেকে ৩০ কোটি ডলার এসেছিল। আমিরাতের মতোই খারাপ পরিস্থিতি ওমান থেকে আসা রেমিট্যান্সের। সেপ্টেম্বরে কেবল ৪ কোটি ডলার এসেছে, যেখানে জুলাইয়েও এসেছিল প্রায় ৮ কোটি ডলার।

রেমিট্যান্স প্রবাহ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেলেও চলতি বছর ওমানে নতুন অভিবাসী হয়েছেন ১ লাখ ৩৫ হাজার ৪৮১ বাংলাদেশী। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৮৩ হাজার ৬৭৪, কাতারে ১৭ হাজার ২০৪, কুয়েতে ১৩ হাজার ৫৯৯ ও সিঙ্গাপুরে ৪৮ হাজার ২২৫ বাংলাদেশী নতুন অভিবাসী হয়েছেন। সব মিলিয়ে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাজের সন্ধানে বিদেশে গিয়েছেন ৮ লাখ ৭৪ হাজার ৭৩৯ জন। ২০২১ সালেও শ্রমিক হিসেবে বিদেশে গিয়েছিলেন ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ বাংলাদেশী।

শ্রমবাজারে নতুন করে যুক্ত হওয়া রেকর্ড পরিমাণ বাংলাদেশীর উপার্জিত অর্থের গন্তব্য নিয়েই এখন নানা প্রশ্ন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রবাসীরা ঠিকই দেশে থাকা স্বজনদের কাছে অর্থ পাঠাচ্ছেন। তবে ব্যাংকিং চ্যানেলে না পাঠিয়ে তারা মাধ্যম হিসেবে বেছে নিচ্ছেন অবৈধ হুন্ডিকে। এতে স্বজনরা উপকৃত হলেও ক্ষতির মুখে পড়ছে দেশ। বাড়ছে না ডলারের রিজার্ভ। অর্থনীতিবিদদের দাবি, ডলারের বিনিময় হার নিয়ে অস্থিরতার সুযোগে হুন্ডির বাজার জমজমাট হয়ে ওঠায় অভিবাসীরা অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, নতুন করে অভিবাসী হওয়া বাংলাদেশীদের উপার্জিত অর্থ যাচ্ছে কোথায়—এ প্রশ্নের উত্তর আমিও খুঁজছি। জ্বালানি তেলসহ চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের সুবিধাভোগী হলো সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। বৈশ্বিক সংকটের মধ্যেও এসব দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভালো। উচ্চমূল্যস্ফীতি সত্ত্বেও মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান শ্রমবাজারগুলোয় বাংলাদেশীরা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করছেন। নতুন করে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বাংলাদেশী এসব দেশে অভিবাসীও হয়েছেন। এর পরও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া রহস্যজনক।

হুন্ডির বাজার চাঙ্গা হওয়ার কারণেই দেশে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে গিয়েছে বলে মনে করেন ড. জাহিদ হোসেন। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক এ মুখ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশে ডলারের বিনিময় হার নিয়ে বড় ধরনের অস্পষ্টতা রয়েছে। রফতানি আয়ের ক্ষেত্রে ডলারের সর্বোচ্চ দর ৯৯ টাকা ৫০ পয়সা। এক্সচেঞ্জ হাউজের রেমিট্যান্সের দর ১০৭ টাকা। আবার খুচরা বাজারে ডলারের দর ১১৫ টাকারও বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করছে ৯৭ টাকায়। এক বাজারে ডলারের এত ধরনের দর হুন্ডি তত্পরতাকেই উৎসাহিত করছে।

দেশের বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলার সংকট চলছে এক বছরের বেশি সময় ধরে। এ সংকট তীব্র হলে গত আগস্টে খুচরা বাজারে (কার্ব মার্কেট) প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১২০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়। ওই সময় রেমিট্যান্স হাউজ থেকে ১১২-১১৫ টাকায়ও প্রবাসীদের পাঠানো ডলার কিনেছিল ব্যাংকগুলো। এ অবস্থায় ডলারের একক দর বেঁধে দেয়ার উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কয়েক দফায় তা বেঁধে দেয়া হলেও সেটি কার্যকর হয়নি। পরে ১১ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন এবিবি ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকগুলোর সংগঠন বাফেদা ডলারের একক দর নির্ধারণ করে দেয়। এক্ষেত্রে এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে কেনা ডলারের সর্বোচ্চ দর নির্ধারণ করা হয় ১০৮ টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডলারের একক দর নির্ধারণ করে দেয়ার পরই দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টে ১২ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধিতে ছিল রেমিট্যান্স প্রবাহ। কিন্তু সেপ্টেম্বরে এসে তা নেতিবাচক ধারায় চলে যায়। আগস্টে ২০৪ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এলেও সেপ্টেম্বরে এসেছে কেবল ১৫৪ কোটি ডলার। আগের বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় কমে যায় প্রায় ১১ শতাংশ। সেপ্টেম্বরের মতো অক্টোবরেও রেমিট্যান্স প্রবাহে বিপর্যয় হয়েছে। ২৭ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে মাত্র ১৩৬ কোটি ডলার এসেছে।

দেশের একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের চলমান ডলার সংকটের মধ্যে রেমিট্যান্স আশার আলো দেখাচ্ছিল। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত চাপাচাপির কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটার টান শুরু হয়েছে। ডলারের দর বেঁধে দেয়ার পর এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর কাছ থেকে রেমিট্যান্স কেনা যাচ্ছে না। ব্যাংকিং চ্যানেলের তুলনায় হুন্ডিতে প্রবাসীরা অনেক বেশি দর পাচ্ছেন। এ কারণে হুন্ডির বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠেছে।

এদিকে ডলারের সংকট থেকে উত্তরণে গতকালও এবিবি ও বাফেদার নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে ডলারের বিদ্যমান সংকট ও উত্তরণের উপায় সম্পর্কে আলোচনা হয়। সভায় এক্সচেঞ্জ হাউজের মতো অন্য উৎস থেকে সংগৃহীত রেমিট্যান্সও ১০৭ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুজন ডেপুটি গভর্নর ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। সভায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বেসরকারি খাতের জন্য ডলার সহায়তা দেয়া হবে না বলেও পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হয়েছে।

বিপুলসংখ্যক নতুন শ্রমিক যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও প্রধান শ্রমবাজারগুলো থেকে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, সবাই বলছে হুন্ডির বাজার চাঙ্গা হওয়ার কারণে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। যদিও আমরা আসলে জানি না, দেশে হুন্ডির বাজারের আকার কত? প্রবাসীরা কী পরিমাণ অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাঠান সে বিষয়েও কোনো তথ্য আমাদের হাতে নেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব হবে প্রথমে হুন্ডির বাজার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা। এতে হুন্ডির তত্পরতা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হবে।

 

নিউজের লিঙ্ক

 



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top