কর্পোরেট জগতে সুফল দিচ্ছে ডিভিএস

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৬ নভেম্বর ২০২২ ২০:৫৩; আপডেট: ১১ মে ২০২৫ ০৪:০৭

ছবি: সংগৃহিত

কর্পোরেট জগতে সুফল দিচ্ছে ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেম (ডিভিএস)। কর্পোরেট কমপ্ল্যায়েন্স নিশ্চিতকরণে গেম চেঞ্জারের ভূমিকা রাখছে এই প্রযুক্তি। বাংলাদেশও ব্যবহার সুফল পাচ্ছে এই সিস্টেমের। খবর টিবিএসের।

এটি কোম্পানি বা অডিট ফার্মের করা নিরীক্ষিত প্রতিবেদনে অনিয়ম শনাক্তে কার্যকর অবদান রাখছে বলে দেখতে পাচ্ছেন নিয়ন্ত্রকরা। যাচাই করা যাচ্ছে প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা-ও।

ডিভিএস এমন একটি সফটওয়্যার যা একটি কোম্পানির কাছ থেকে নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন প্রাপ্তি নিশ্চিত করে। এতে করে, কর্পোরেট নিয়ন্ত্রকরা ইউনিক ভেরিফিকেশন কোড ব্যবহার করে সার্ভারে ঢুকে এটি যাচাইয়ের সুযোগও পান।

কোম্পানিগুলি যাতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের দ্বারা প্রত্যয়িত আর্থিক বিবৃতিসহ ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়– এলক্ষ্যে ২০২০ সালে ডিভিএস বাধ্যতামূলক করা হয়।

পরের বছর বাংলাদেশ ব্যাংক নন-পারফর্মিং ঋণের ঝুঁকি কমাতে এবং ঋণ শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে ইনস্টিটিউড অভ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টস অভ বাংলাদেশ (আইসিএবি)-র ডেভেলপ করা সফটওয়্যারটি ব্যাংক এবং ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেয়।

ঋণ পেতে বেশি মুনাফা দেখানো হয়েছে কিনা; বা কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য মুনাফা কমিয়ে দেখানো হয়েছে কিনা– এমন বিষয়গুলি যাচাই করার দিকটি মাথায় রেখে এটি তৈরি করা হয়েছে।

এর অন্যতম ব্যবহারকারী নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ– জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) – ব্যবস্থাটি কার্যকর হওয়ার দেড় বছরে এর মাধ্যমে ভালো ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছে।

রাজস্ব কর্মকর্তারা বলেছেন, ডিভিএস চালু হওয়ার আগে বছরে প্রায় ২৭ হাজারের মতো কোম্পানি এনবিআরে নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী জমা দিত। তার প্রায় এক-তৃতীয়াংশেরই অডিটর বা নিরীক্ষকের হদিস পাওয়া যেত না।

কিন্তু, এনবিআর ও আইসিএবি'র সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ডিভিএস এর সাহায্যে গত বছর কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রায় ৩২ হাজার নিরীক্ষিত বিবরণী ও তাদের কর রিটার্ন যাচাই করা সম্ভব হয়েছে।

চলতি বছর ৪০ হাজার এবং আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে ১ লাখ কোম্পানির নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণী পাবে বলে আশা করছে এনবিআর। অথচ গত কয়েক বছর ধরে এই সংখ্যাটি ছিল ২৫ হাজারের আশপাশে।

নতুন ব্যবস্থাটির মাধ্যমে রাজস্ব সংগ্রহও বেড়েছে। নাম না প্রকাশের শর্তে, ঢাকা কর অফিসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে জানান, গত বছর একটি কোম্পানির কাছ থেকে উৎসে কর কর্তন (টিডিএস) হিসাবে ৬০ থেকে ৬২ লাখ টাকা পাওয়া যেত, গত বছর ওই কোম্পানি পরিশোধ করেছে ২ কোটি টাকার বেশি।

সার্বিকভাবে গত বছর কোম্পানিগুলির কাছ থেকে কর আদায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে বলেও জানান।

আইসিএবি'র সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন টিবিএসকে বলেন, ডিভিএস চালু হওয়ার পর কিছু অডিটরের অনিয়ম করার প্রমাণও তারা পেয়েছেন। এরমধ্যেই তারা ৯টি অডিটর ফার্মের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও নিয়েছেন। অন্য কয়েকটি অডিট ফার্মের বিষয়েও তদন্ত করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

আইসিএবি জানিয়েছে, ইতিমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি), বেশিরভাগ ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক সংস্থা, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), জয়েন্ট স্টক কোম্পানি ও ফার্মের রিজাস্ট্রারার– ৯টি ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডিভিএস এর তথ্য শেয়ারের বিষয়ে আইসিএবি'র চুক্তি হয়েছে। এর ফলে এসব প্রতিষ্ঠান নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনলাইনে যাচাই করার সুযোগ পাচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকও ইতিমধ্যে ব্যাংকগুলোকে ডিভিএস এর মাধ্যমে অডিটেড রিপোর্ট যাচাই করার নির্দেশনা দিয়েছে।

আইসিএবি'র সদস্যভুক্ত কোনো কোনো ফার্ম বছরে শত শত কোম্পানির অডিট করেছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। জানা গেছে, একটি ফার্ম এক বছরে ১ হাজারের বেশি কোম্পানির অডিট করেছে; যা তাদের সামর্থ্য বিবেচনায় অসম্ভব।

শাহাদাৎ হোসেন টিবিএসকে বলেন, ডিভিএস চালু হওয়ার পর এখন আর এ সুযোগ থাকছে না। যে প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে ডিভিএস সার্ভারে প্রবেশাধিকারের বিষয়ে চুক্তি হয়েছে, তারা অনলাইনে জানতে পারবে কোন অডিটর সাইন করেছে। পাশাপাশি তারা কোনো কোম্পানির লাভ/ লোকসান, আয়, দায়, শেয়ারমূল্য, সম্পত্তি ইত্যাদি সম্পর্কে জানতে পারবে।

আনবে কর্পোরেট সুশসান

ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং অ্যাসোসিয়েশন অভ ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)-র সভাপতি সেলিম আর. এফ হোসেন টিবিএসকে বলেন, ডিভিএস কর্পোরেট সুশাসনের আনার ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যেই যা লক্ষ করা যাবে।

এতে করে, দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকের নন-পারফর্মিং ঋণের চাপও কমবে বলে মনে করেন তিনি।

ইমার্জিং ক্রেডিট রেটিং লিমিটেড- এর পরিচালক এবং ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিজ অভ বাংলাদেশের সভাপতি এন কে এ মোবিন টিবিএসকে বলেন, 'এখন মানসম্পন্ন অডিট রিপোর্টের কারণে অনেক কোম্পানির রেটিং কমে যাবে। তবে এটি সার্বিকভাবে ভবিষ্যতে কোম্পানির বিবরণীতে স্বচ্ছতা আনার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে'।

অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান– ড. আহসান এইচ মনসুর-ও মনে করেন, আর্থিক খাতে কমপ্ল্যায়েন্স নিশ্চিতকরণে ইতিবাচক প্রভাবই যোগ করবে ডিভিএস।

তিনি বলেন, এখন থেকে কেউ যদি অতিরিক্ত ঋণ নিতে চায়, তাহলে তাকে আরও বেশি কর দিতে হবে। একইভাবে, যদি তারা কর ফাঁকি দেয়– সেক্ষেত্রে তারা চাহিদা অনুযায়ী ঋণও পাবে না।

শুরু থেকেই ডিভিএস ব্যবস্থা তৈরির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন আইসিএবি'র কাউন্সিল সদস্য মোহাম্মদ ফোরকান উদ্দিন। তিনি জানান, প্রতিবেশী ভারত, শ্রীলঙ্কা এবং নেপালেও ডিভিএস ব্যবস্থা আছে, তবে একটু অন্যভাবে।

কর্পোরেট কমপ্ল্যায়েন্স টাস্ক ফোর্সের প্রধান শাব্বির আহমেদ টিবিএস'কে বলেন, 'ডিভিএস চালুর পর, এরমধ্যেই আমরা তার সুফল পেতে শুরু করেছি। ভবিষ্যতে কোম্পানি ট্যাক্সের পাশাপাশি পে-রোল ট্যাক্সও বাড়বে'।

কর্পোরেট কমপ্ল্যায়েন্স- এর ক্ষেত্রে ব্যবস্থাটি একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, দেশের প্রায় ২ লাখ কোম্পানি এবং তাদের প্রায় ৩ লাখ পরিচালক মোট করদাতাদের মধ্যে মাত্র ৭ শতাংশ। তবে তারা মোট কর আদায়ের ৯০% অংশ।

এমবি নিট ফ্যাশনস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ডিভিএস এর পাশাপাশি দেশের কর ব্যবস্থাকে ব্যবসা ও করদাতা বান্ধব করতে হবে।

এনবিআরের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'কোম্পানিগুলোতে কমপ্লায়েন্স আনার স্বার্থে আমরা অলিখিত ছাড় দিচ্ছি। এ বিষয়ে মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোকে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া আছে, যাতে কোম্পানিগুলোকে বড় ধরনের অনিয়ম না পেলে হয়রানি না করে'।

তবে আইসিএবি'র একজন জ্যেষ্ঠ একাউন্টেন্ট জানান, জরিমানার করা হবে এমন আশঙ্কায় এখনও কিছু কোম্পানি সঠিক তথ্য দিতে ভয় পাচ্ছে। এক্ষেত্রে এনবিআর- এর ছাড়ের বিষয়টি স্পষ্ট করতে হবে।

অডিটের ব্যয়ের বিষয়ে আইসিএবি সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন বলেন, যেহেতু এখন (মানসম্পন্ন) কোয়ালিটি অডিট হবে, সেজন্য ব্যয়ও কিছুটা বাড়বে।

টিবিএসের প্রতিবেদনটি পড়তে চাইলে ক্লিক করুন



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top