জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাই কি ইসরাইল রাষ্ট্রের পতন ঘটাবে
রেজাউল ইসলাম | প্রকাশিত: ২৪ জুন ২০২৫ ১৮:১৭; আপডেট: ২৫ জুন ২০২৫ ০২:৪৯

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে নাৎসি জার্মানরা বিশ্বাস করত যে, জার্মানরা পৃথিবীর অপরাপর জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতি এবং তারাই কেবল বিশুদ্ধ আর্য রক্তের অধিকারী। তারা আরো বিশ্বাস করত যে, পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট জাতি হিসেবে তারাই কেবল পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিতে পারে।
তাদের এই জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের মিথ্যা বয়ান একসময় তাদেরকে অহংকারী করে তোলে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই বয়ানের উপর ভর করেই তারা ইহুদি-সহ অন্যান্য জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপরে একটা পর্যায়ে গণহত্যা ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করে। এরই ফলশ্রুতিতে একসময় তারা জাতি হিসেবে দিকভ্রান্ত হয়ে পড়ে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে।
এখানে মজার বিষয় হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যেই ইহুদি জাতি নাৎসি জার্মানদের দ্বারা ব্যাপকভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন ও গণহত্যার শিকার হয়, যে জাতি জার্মানদের কাছে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জাতি হিসেবে যুগ যুগ ধরে জুলুম ও নিগৃহের শিকার হয়, সেই ইহুদি জাতিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানদের পরাজয়ের পর তাদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের নতুন বয়ান পৃথিবীর সামনে উপস্থাপন করে।
তারা রাতারাতি মজলুম থেকে জালিম হয়ে ওঠে। তারা ইউরোপ-আমেরিকা-আফ্রিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরবে এসে ফিলিস্তিনিদের জমি জোরপূর্বক দখল করে বলে এটা তাদের 'প্রমিজড ল্যান্ড' বা 'প্রতিশ্রুত ভূমি'। ঈশ্বর তাদের জন্য এই ভূমি অনাদিকালের জন্য সংরক্ষণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর তারাই হচ্ছেন ঈশ্বরের 'চুজেন পিপল' বা 'মনোনীত সম্প্রদায়'। অতএব তারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতি। তারাই ঈশ্বরের কাছে সবচেয়ে সম্মানিত জাতি। আর অন্যরা সব নিকৃষ্ট, অসভ্য, বর্বর ইত্যাদি।
আজকের ইসরাইল নামক যে ইহুদি রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনের বুক চিরে এক বিষফোঁড়ায় রূপান্তরিত হয়েছে, সেই ইহুদি রাষ্ট্রটি আজ বস্তুত এই কাল্পনিক জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের বয়ানের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। এটি এমন একটি জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান যার কোনো ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই। অথচ এই নিকৃষ্ট বয়ানের উপরে ভর করেই তারা প্রতিদিন অগণিত নিরীহ-নিরপরাধ ফিলিস্তিনিদেরকে হত্যা করছে, তাদের জমি-জায়গা জোর করে দখল করছে, তাদের মেয়েদেরকে ধর্ষণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ও পদ্ধতিগতভাবে গণহত্যা পরিচালিত করছে। তাদের এই অন্যায়- অপকর্মের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলছে, তারাই তাদের নির্মম অত্যাচারের শিকার হচ্ছে।
এর সাম্প্রতিক উদাহরণ আমরা লেবানিজ, ইয়েমেনি, ইরাকি, সিরিয় ও ইরানি জাতির সাথে ঘটতে দেখেছি। নিরীহ ফিলিস্তিনিদের পক্ষে কথা বলার জন্য তাদেরকে অত্যন্ত নির্মমভাবে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে, তাদের বিপ্লবী নেতাদেরকে গুপ্তহত্যার শিকার করা হয়েছে। আকাশ থেকে বোমারু বিমান দিয়ে মিসাইল নিক্ষেপ করে সেসব দেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে তারা কোনো আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা করেনি এবং এখনও করছে না। নিজেদের আত্মরক্ষার দোহাই দিয়ে তারা যখনই প্রয়োজন মনে করছে, তখনই তারা সেসব দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করছে।
২০২৪ সালের ২-রা এপ্রিল ইসরাইল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের ইরানি কনস্যুলেটে নজিরবিহীন এক বিমান হামলা চালিয়ে কুটনীতিক ও আইআরজিসির কমান্ডার-সহ সাত ইরানি কর্মকর্তাকে হত্যা করে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি ভিয়েনা কনভেনশনস-হ সকল আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হলেও, বিশ্ববাসী তখন ইসরাইলের বিরুদ্ধে টু শব্দটি পর্যন্ত করতে পারেনি তার যুদ্ধংদেহী মনোভাবের ভয়ে। জাতিসংঘও সে ঘটনায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি তার অপরিসীম ক্ষমতার কারণে।
শুধু এখানেই শেষ নয়, একই বছরের জুলাই মাসের ৩১ তারিখে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠন হামাসের পলিটব্যুরোর প্রধান ইসমাইল হানিয়া ইরানের রাজধানী তেহরানে সেদেশের সদ্য নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের অভিষেক অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে যোগ দিতে গেলে ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে তাকে তার দেহরক্ষী-সহ হত্যা করে। আন্তর্জাতিক আইনে এগুলো অনেক বড় ঘটনা হলেও ইসরাইলের সীমাহীন ক্ষমতার ভয়ে বিশ্ববাসী কেন যেন সবসময় নিরব নিথর মরদেহের মত পড়ে থাকে!
অথচ এসকল ভয়ঙ্কর ঘটনা একটা বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত বাঁধিয়ে দিতে পারে- যা আমরা দেখেছি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার ক্ষেত্রে। ১৯১৪ সালের ২৮ জুন অস্ট্রিয়ার যুবরাজ ফ্রাঞ্জ ফার্দিনান্ড তার স্ত্রী সোফি-সহ সার্বিয়া ভ্রমণকালে এক সার্বের হাতে খুন হওয়ার পর কীভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল তা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছিল সেসময়।
ইসমাইল হানিয়া একটি মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক প্রধান হওয়ায় তার গুপ্তহত্যার বিষয়টিও বিশ্বে তেমনই আলোড়ন ফেলে দিতে পারত যদি কিনা ইরান বা তার মিত্ররা সেটা সেভাবে মনে করত। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তির বলে রাষ্ট্রটি বারবার তার সীমা অতিক্রম করছে, তবুও তার টিকিটা পর্যন্ত কেউ ছুঁতে পারছে না! এই বলেই বলিয়ান হয়ে সে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একর পর এক বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে যারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্তর্জাতিক রাজনীতির খবরাখবর রাখেন, তারা জানেন কেমন সুপরিকল্পিত উপায়ে ইসরাইল রাষ্ট্র ও তার অন্ধ অনুসারীরা ফিলিস্তিনিদের ভূমিকে তাদের 'চুজেন ল্যান্ড' বা 'প্রতিশ্রুত ভূমি' হিসেবে তার ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় বৈধতার প্রচার করে, কীভাবে তারা নিজেদেরকে ঈশ্বরের মনোনীত সম্প্রদায় হিসেবে জাহির করে।
এভাবে বিশ্বে যত প্রকারের প্রচারযন্ত্র ও গণমাধ্যম আছে তার সবগুলোই তারা সুনিপুণভাবে ব্যবহার করে তাদের জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের গালগল্প তুলে ধরার জন্য। তারা ঈশ্বরের কতটা আশির্বাদ ও সমর্থনপুষ্ট- সেসব বস্তাপচা কল্পকাহিনী কত অবলীলায় না প্রচার করে! তারা খুব দৃঢ়ভাবে দম্ভোক্তি করে বলে থাকে, পৃথিবীর কোনো লড়াইয়েই তারা পরাজিত হবে না, পৃথিবীর কোনো শক্তিই তাদেরকে হারাতে পারবে না, কারণ সব পরিস্থিতিতেই ঈশ্বর তাদের সাথে আছেন। ঈশ্বরের কাছে তারাই সবচেয়ে বিশ্বস্ত ও শ্রেষ্ঠ জাতি।
অন্যের জমি জোরপূর্বক দখল করে একটা মিথ্যা ধর্মীয় ও জাতিগত বয়ান দিয়ে তা জায়েয করার এক অভিনব কৌশলের উপরেই মূলত যুগের পর যুগ ধরে টিকে আছে ইসরাইল নামক অবৈধ এই রাষ্ট্রটি। এই নির্জলা মিথ্যা বয়ানটি সেদেশের একজন সাধারণ ইহুদি থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের সব ব্যক্তিই অত্যন্ত সাবলীলভাবে প্রচার করে থাকে।
শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মী- সেনাবাহিনীর অফিসার - মন্ত্রিপরিষদ সদস্য-সবাই একযোগে এই ভ্রান্ত মতবাদটি প্রচার করে তাদের রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে দীর্ঘায়িত করতে চায়। কিন্তু তাদের ধর্মীয় ও জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের ভ্রান্ত এই ধারণাটিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে তারা অন্য জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপরে যে পরিমাণ ন্যাক্কারজনক গণহত্যা ও সীমাহীন দুর্ভোগ চাপিয়ে দিচ্ছে, সেটিই কি একসময় ইসরাইল নামক বিতর্কিত এই রাষ্ট্রটির পতন ঘটাবে?
রেজাউল ইসলাম: কথাসাহিত্যিক ইমেইল: [email protected]
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: