জৌলুস হারাচ্ছে শতবর্ষী জিলা স্কুলগুলো

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৩ নভেম্বর ২০২২ ২০:৪১; আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ০১:২০

ছবি: সংগৃহিত

ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের জিলা স্কুল গুলো। ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত স্কুলগুলো এখনো অনেক বর্ণাঢ্য ব্যক্তিদের বিদ্যাপিঠ। কিন্তু সময়ের আবর্তনে নানা সমস্যায় জজর্রিত শতবর্ষী এই স্কুলগুলো। খবর বণিক বার্তার।

খুলনা জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় উনিশ শতকের শেষ ভাগে। খুলনা অঞ্চলে মাধ্যমিক শিক্ষার বিকাশে বিদ্যালয়টির বড় ভূমিকা রয়েছে। এ অঞ্চলে বেড়ে ওঠা অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্বেরই শিক্ষাজীবনের মূল ভিত্তি গড়ে উঠেছিল এখানে। দেশের সবচেয়ে প্রাচীন বিদ্যালয়গুলোর অন্যতম খুলনা জিলা স্কুলের অর্জনের ঝুলি এখন অনেক সমৃদ্ধ। যদিও মান ও সক্ষমতার দিক থেকে শতবর্ষী বিদ্যালয়টি এখন আর আগের সে অবস্থানে নেই বলে মনে করছেন খুলনার স্থানীয় বাসিন্দারা। বিদ্যালয়টিতে প্রতি শিক্ষকের বিপরীতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০-এর বেশি। যদিও বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত হওয়া উচিত সর্বোচ্চ ১:৩০। আবার শ্রেণীকক্ষের দিক থেকেও ১৩৭ বছর পুরনো বিদ্যালয়টির অবস্থান মানদণ্ডের বেশ নিচে। জনবল, অবকাঠামো ও পাঠদান পদ্ধতি বিবেচনায় কোনো দিক থেকেই আগের মতো সক্ষমতার ছাপ দেখাতে পারছে না বিদ্যালয়টি।

দেশের বিভিন্ন জেলা শহরে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত অন্য ১২টি জিলা স্কুলের চিত্রও কম-বেশি একই রকম। স্কুলগুলোয় খোঁজ নিয়ে জানা গিয়েছে, কোথাও শিক্ষক বা অন্যান্য জনবলের সংকট রয়েছে। আবার কোথাও রয়েছে শ্রেণীকক্ষ, ল্যাব বা গ্রন্থাগারের অপ্রতুলতা। এমনকি যুগের চাহিদা অনুযায়ী পাঠ্যবইয়ের তালিকায় যুক্ত হওয়া আইসিটি বিষয়ে পাঠদানে কোনো শিক্ষক নেই জিলা স্কুলগুলোয়। কম্পিউটার ল্যাবসহ বিজ্ঞানাগারগুলোয় যন্ত্রপাতির সংকট রয়েছে প্রায় সবক’টি প্রতিষ্ঠানে। গ্রন্থাগার পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় সৃষ্টি করা হয়নি কোনো গ্রন্থাগারিক পদ। এছাড়া সরকারের অনেক সাধারণ নির্দেশনা অনুসরণ করতে গিয়ে নিজস্ব পাঠদান কৌশলেও অনেক পরিবর্তন এসেছে জিলা স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রমে। একসময় বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা থাকলেও এখন এর পরিধি ক্রমেই কমিয়ে আনা হচ্ছে। হোস্টেল পরিচালনার জন্য কোনো জনবল কাঠামো নেই। সব মিলিয়ে ক্রমেই গৌরব হারাচ্ছে একসময়ের ঐতিহ্যবাহী এ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো।

ইতিহাস-ঐতিহ্য ও অবদানের দিক থেকে শতবর্ষী এসব জিলা স্কুলের যেভাবে গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল, সরকারি উন্নয়ন ভাবনা ও পরিকল্পনায় তার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি বলে অভিমত সংশ্লিষ্টদের। তাদের ভাষ্যমতে, ১৯৮৫ সালে তৈরি করা শিক্ষক ও জনবল কাঠামোয় পরিচালিত হচ্ছে বিদ্যালয়গুলো। এরপর সময় গড়িয়েছে চার দশকের কাছাকাছি। দীর্ঘ এ সময়ের মধ্যে বিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে কয়েক গুণ। কিন্তু শিক্ষক ও জনবল কাঠামো রয়ে গিয়েছে আগের মতোই।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য ও খুলনা জিলা স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, আমি যখন খুলনা জিলা স্কুলে পড়তাম, তখন পাঠদান কৌশল ও সংস্কৃতিচর্চায় বিদ্যালয়টির আলাদা একটি পরিচয় ছিল। শুধু খুলনা নয়, অন্যান্য জিলা স্কুলেরও স্বকীয় একটি পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা ছিল। ওই সময় সমাজে জিলা স্কুলের শিক্ষকদের পরিচয়ও ছিল বেশ মর্যাদাপূর্ণ। জিলা স্কুলের অংকের শিক্ষক, ইংরেজির শিক্ষক—এভাবেই সমাদৃত হতেন তারা। এখন সেখানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন শিক্ষকরা হয়ে গিয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা। নাম আর প্রাচীন অবকাঠামো ছাড়া জিলা স্কুলগুলোকে শিক্ষা কার্যক্রম-সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় দিয়ে আলাদা করা কঠিন হয়ে পড়েছে।

তিনি আরো বলেন, জিলা স্কুলগুলোর বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য ছিল হাতে-কলমের শিক্ষা। তখন আমাদের বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো ব্যবহারিক উপায়ে ধরে ধরে শেখানো হতো। কারিগরি জ্ঞানার্জনের আলাদা ব্যবস্থা ছিল। এখন ল্যাবে গিয়ে দেখবেন, যন্ত্রপাতির অবস্থা খারাপ। কম্পিউটার ল্যাবের অধিকাংশ কম্পিউটার নষ্ট। এসব কারণেই আমরা সরকারীকরণ নয়, রাষ্ট্রীয়করণের কথা বলে আসছি। কারণ সরকারীকরণের কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের মানে উন্নয়ন না ঘটে উল্টো অবনমন ঘটে। আসলে সরকারের কাছ থেকে বেতন পাওয়াটাই একটি প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে বড় অর্জন হতে পারে না। সেখানকার শিক্ষার মান ও ইতিহাস-ঐতিহ্যও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

দেশে এখন জিলা স্কুলের সংখ্যা ১৪। এর মধ্যে কুমিল্লা, খুলনা, যশোর, নোয়াখালী, ফরিদপুর, বরিশাল, জামালপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, রংপুর, নওগাঁ, পাবনা, বগুড়া—এ ১৩ জেলায় জিলা স্কুল গড়ে ওঠে ব্রিটিশ আমলে, যার সবক’টিরই বয়স ১০০ বছরের বেশি। এরপর ১৯৬১ সালে পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠা করা হয় কুষ্টিয়া জিলা স্কুল।

রংপুর জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠা পায় ১৮৩৭ সালে। সে হিসেবে আর ১৫ বছর পরই দুই শতক পূরণ করতে যাচ্ছে বিদ্যালয়টি। রংপুর জিলা স্কুলে দুটি শিফট মিলে বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছে ১ হাজার ৯৬৬ জন। এসব শিক্ষার্থীর পাঠদানে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ৫০ জন। যদিও গুণগত পাঠদানের জন্য অন্তত ২০০ জন শিক্ষক প্রয়োজন বলে মনে করছেন খোদ বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আবু রায়হান মিজানুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ব্রিটিশ সরকারের বিশেষ অর্থায়নে জিলা স্কুলগুলো গড়ে তোলা হয়েছিল। ওই সময় তত্কালীন ভারতবর্ষে ৬৫টির মতো মাধ্যমিক বিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়, যার কিছু বর্তমানে রয়েছে বাংলাদেশ অংশে। স্কুলগুলো গড়ে তোলা হয়েছিল বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। বর্তমান সময়ে সরকারও বেশ গুরুত্ব দিচ্ছে, তবে প্রয়োজনীয়তার তুলনায় তা অপ্রতুল। দুই শতকের কাছাকাছি বয়সের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে রিসোর্স থাকার কথা ছিল, সেটি আমাদের নেই এটা সত্য। আসলে জিলা স্কুলগুলো আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে। আমাদের উচিত এর সঠিক সংরক্ষণ করা।

তিনি আরো বলেন, জিলা স্কুলগুলোয় তৃতীয় শ্রেণী থেকে পাঠদান দেয়া হয়। মাধ্যমিকের আগে প্রাথমিকের যে তিনটি শ্রেণী পড়ানো হয়, এগুলোর জন্য আলাদা কোনো শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয় না। মাধ্যমিকের শিক্ষকরাই তাদের পড়ান। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বই বিতরণ ছাড়া অন্য কোনো সহায়তা আমাদের প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা পায় না।

ফরিদপুর জিলা স্কুল গড়ে ওঠে ১৮৪০ সালে। ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়টির সহকারী প্রধান শিক্ষক পদের দুটি পদই শূন্য। এছাড়া শিক্ষার্থী অনুপাত বিবেচনায় নিলে বিদ্যালয়টির অবকাঠামো বেশ অপ্রতুল। কম্পিউটার ল্যাবের কম্পিউটারগুলো অনেকটাই অকেজো হয়ে পড়েছে। এছাড়া বিদ্যালয়টির স্যানিটেশন ব্যবস্থাও বেশ নিম্নমানের।

বিদ্যালয়টির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ছিলেন নাসিমা বেগম। বর্তমানে তিনি ফরিদপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। স্কুলটির বিষয়ে তিনি বলেন, জিলা স্কুলে দায়িত্ব পালনের সময় গ্রন্থাগার পরিচালনার জন্য একজন গ্রন্থাগারিকের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতাম। আইসিটি শিক্ষক না থাকায় অন্য বিষয়ের শিক্ষক দিয়ে পড়ানো হতো। এখন যেখানে আছি, সেখানেও একই অবস্থা। এছাড়া স্যানিটেশনের ক্ষেত্রেও বেশকিছু দুর্বলতা রয়ে গিয়েছে। আর মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর আরেকটি সমস্যা হলো এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় না। অথচ তারা বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। আমি মনে করি, বিষয়গুলোয় সরকারের নজর দেয়া প্রয়োজন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক উইং) মোহাম্মদ বেলাল হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, মাধ্যমিকের অন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারের যে দৃষ্টিভঙ্গি, জিলা স্কুলের ক্ষেত্রেও তা একই। যেহেতু শিক্ষক পদায়ন থেকে শুরু করে শিক্ষার্থী ভর্তি সবই এক, তাহলে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একইভাবে অবকাঠামো উন্নয়নের দিক থেকেও আমরা সব বিদ্যালয়কে একই নীতিতে দেখি।

বণিক বার্তার প্রতিবেদনটির লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top