আজ বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধন, খুলছে অর্থনীতির দ্বার
রাজ টাইমস | প্রকাশিত: ২৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৯:৪৮; আপডেট: ৮ মে ২০২৫ ০১:৪৪

দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নদীর তলদেশে নির্মিত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উদ্বোধন হচ্ছে আজ। দেশের বৃহত্তম স্থাপনা পদ্মা সেতু, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সেপ্রেসওয়ের ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের সাফল্যে যুক্ত হচ্ছে আরেকটি সোনালি পালক।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল’ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে উদ্বোধনের পর টানেলের হয়ে আনোয়ারা প্রান্তে পৌঁছে জনসমাবেশে অংশ নেবেন সরকার প্রধান। উদ্বোধনের পরদিন রবিবার (২৯ অক্টোবর) সকাল ৬টা থেকে সর্ব সাধারণের যান চলাচলের জন্য টানেলটি খুলে দেওয়া হবে।
দুটি টিউবের চার লেনের সড়কের মাধ্যমে নদীর তলদেশ দিয়ে পাঁচ মিনিটে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে যাওয়া যাবে আনোয়ারায়। এ টানেল চালুর মধ্য দিয়ে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের দূরত্ব ৪০ কিলোমিটার কমে আসবে। এতে যাত্রা সময়ও এক ঘণ্টার মতো কমবে।
চট্টগ্রামকে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ করবে প্রকল্পটি। চট্টগ্রামের নতুন শহর গড়ে উঠবে নদীর অপর প্রান্তেও। এর ফলে নগরীর অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক আকার হবে দ্বিগুণ।
প্রকল্পের অ্যালাইনমেন্ট পতেঙ্গা প্রান্তে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে কর্ণফুলী নদীর ২ কিলোমিটার ভাটিতে। ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার টানেল যুক্ত করবে কর্ণফুলী নদীর পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি আর অপর প্রান্তের চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা (সিইউএফএল)।
সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আনোয়ারা প্রান্তে ব্রিজ ভায়াডাক্টের দৈর্ঘ্য ৭২৭ মিটার। অ্যাপ্রোচ সড়কের দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার। টোল প্লাজার দৈর্ঘ্য ৭ হাজার ৬০০ বর্গমিটার। এ ছাড়া আনোয়ারা প্রান্তে সংযোগ সড়কের সঙ্গে ৭২৭ মিটার ভায়াডাক্ট (উড়াল সড়ক) রয়েছে।
টানেলে আন্ডার পাসের সংখ্যা আনোয়ারা প্রান্তে পাঁচটি ও পতেঙ্গা প্রান্তে একটি আর কালভার্টের সংখ্যা ১২টি। এ ছাড়া সার্ভিস এলাকায় ৩০টি বাংলো, একটি ভিআইপি বাংলোসহ মোটেল মেস, হেলথ সেন্টার, কনভেনশন সেন্টার, জাদুঘর, সুইমিংপুল, ব্রিজ, মসজিদ ও অভ্যন্তরীণ রাস্তা থাকবে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, টানেলের দুপাশে দুটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, পুলিশের ক্যাম্প নির্মাণ ও মোবাইল নেটওয়ার্ক কার্যক্রম এখনও বাকি। এ ছাড়া নিরাপত্তার জন্য স্ক্যান মেশিন বসানো হচ্ছে।
সেতু বিভাগ থেকে জানা গেছে, দুই টিউব সংবলিত মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এ দুই টিউব তিনটি সংযোগ পথের (ক্রস প্যাসেজ) মাধ্যমে যুক্ত থাকবে। বিপদের সময় অন্য টিউবে গমনের জন্য এ ক্রস প্যাসেজগুলো ব্যবহার হবে। টানেল টিউবের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার ও ভেতরের ব্যাস ১০ দশমিক ৮০ মিটার।
‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ হবে চট্টগ্রাম
বঙ্গবন্ধু টানেল পরিবহনের কেন্দ্র হিসেবে চট্টগ্রামের সক্ষমতা বাড়াবে, যার ফলে এশিয়ান হাইওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন হবে। চীনের সাংহাই শহরের মতো চট্টগ্রাম শহরকে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ মডেলে গড়ে উঠবে।
নিরাপত্তায় বসেছে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে স্ক্যানার
নদীর তলদেশের এ প্রকল্পের নিরাপত্তা দিতে দুই প্রান্তে দুটি করে চারটি স্ক্যানার বসানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। চারটি স্ক্যানারের জন্য ব্যয় হচ্ছে ৩০০ কোটি টাকা।
সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ব্রিটেন থেকে আনা স্ক্যানারগুলো টানেলের ভেতর দিয়ে যাওয়া পণ্যবাহী ভারী গাড়িগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে। ১৩ টন ওজনের প্রতিটি স্ক্যানার প্রায় ৫০ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার প্রশস্ত। সময় লাগবে পরিবহনপ্রতি দুই মিনিট।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের নভেম্বরে অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। শুরুতে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮ হাজার ৪৪৬ দশমিক ৬৪ কোটি টাকা। পরে তা বেড়ে হয় ১০ হাজার ৩৭৪ দশমিক ৪২ কোটি টাকা।
আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯-২০১৪ মেয়াদে এ টানেল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০১১ সালে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ২০১৪ সালের ৯ জুন টানেলটি নির্মাণে চীনের সঙ্গে জি টু জি ভিত্তিতে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৫ সালের ১৫ জুন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের মধ্যে টানেল নির্মাণের লক্ষ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। একই বছর নভেম্বরে একনেকে প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর টানেল নির্মাণ কাজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিংপিং।
২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন। ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দ্বিতীয় টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করেন।
চীনের এক্সিম ব্যাংক ২ শতাংশ সুদে এ প্রকল্পের জন্য ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়। বাকি টাকার জোগান দেয় বাংলাদেশ সরকার। চায়না কমিউনিকেশন অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন কোম্পানি টানেলটি নির্মাণ করছে।
যা বললেন প্রধানমন্ত্রী
বঙ্গবন্ধু টানেল সম্পর্কে সংসদের প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল এ টানেল যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হওয়ার পর বন্দরনগরী চট্টগ্রাম তথা দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। টানেলের আনোয়ারা প্রান্তে আবাসন শিল্পের বিকাশ, কলকারখানা স্থাপন, পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। টানেল নির্মাণের ফলে মীরসরাই থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত বিনিয়োগের বিশাল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। টানেল সড়কের সঙ্গে যুক্ত হবে মীরসরাই ইকোনমিক জোন, আনোয়ারার চাইনিজ ইকোনমিক অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল জোন, বে-টার্মিনাল, মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনাল। ফলে টানেল ব্যবহার করে উল্লিখিত অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ সারা দেশের কারখানার পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর এবং কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে আমদানি-রফতানি করা যাবে দ্রুত সময়ে।
তিনি আরও বলেছিলেন, বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে আবর্তিত ব্লু ইকোনমির নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। অর্থ ও সময় সাশ্রয় হবে। ফলশ্রুতিতে শিল্পকারখানা ও পর্যটন শিল্পের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। নতুন উচ্চতায় পৌঁছে যাবে দেশের অর্থনীতি।
সম্ভাব্যতা সমীক্ষা অনুযায়ী জিডিপিতে এই টানেল শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ অবদান রাখবে। এ টানেল নির্মাণের মাধ্যমে বন্দর নগরী ‘এক নগর দুই শহরে’ গড়ে উঠবে। তাছাড়া, টানেলের মাধ্যমে এশিয়ান হাইওয়ের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপিত হবে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: