বাংলাদেশীদের জন্য ওমানের ভিসা বন্ধ : প্রভাব কী হতে পারে

রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:২৯; আপডেট: ৮ মে ২০২৫ ০১:৪৭

মধ্যপ্রাচ্যে অনেকেই যায় নির্মাণশ্রমিক হিসেবে - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশী নাগরিকদের সব ধরনের ভিসা দেয়া স্থগিত করেছে ওমান। দেশটির রয়্যাল পুলিশ এক ঘোষণায় এটি জানিয়েছে। একই জানানো হয়েছে, ‘টুরিস্ট’ কিংবা ‘ভিজিট ভিসা’ নিয়ে ওমান গেলে সেটি ‘ওয়ার্ক ভিসায়’ পরিবর্তন করা যাবে না। গত ৩১ অক্টোবর থেকে সব দেশের জন্য এটি কার্যকর করা হয়েছে।

ওমানের জনসংখ্যা ৫০ লাখের মতো। বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে বলা হচ্ছে, ওমানে ২০ লাখের মতো প্রবাসী শ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশী শ্রমিকদের সংখ্যা সাত লাখের বেশি।

ঢাকায় ওমান দূতাবাসের একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ‘এটি ওমানি শ্রম বাজারের চাহিদা ও স্থিতিশীলতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার একটি প্রয়াস। যার উদ্দেশ্য বর্তমান শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিক ও নিয়োগকর্তা উভয়ের অধিকার নিশ্চিত করা।’

বাংলাদেশ দূতাবাস যা বলছে

বাংলাদেশে দূতাবাস বিষয়টিকে ‘সাময়িক পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। এছাড়া বিষয়টি কোনোভাবেই ‘রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতির নয়’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে।

ওমানে বাংলাদেশের দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে, সেখানে যত বাংলাদেশী আছে সে তুলনায় কর্মসংস্থান নেই। ফলে যারা আগে থেকে চাকরি নিশ্চিত করে যাচ্ছে না, তাদের অনেককে বেকার থাকতে হচ্ছে অথবা স্বল্প মজুরিতে তাদের কাজ করানো হচ্ছে, যেটা তাদের শ্রম অধিকার খর্ব করে।

ওমানে বাংলাদেশ দূতাবাসের উপ-প্রধান মৌসুমী রহমান বলেন, অনেক সময় কাজ না পেয়ে তারা দালালদের খপ্পরে পড়ে পাচারেরও শিকার হয়। অনেকে ইরান বা তুরস্কের মতো দেশ হয়ে ইউরোপ পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করে। এমন নানাবিধ কারণে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং অধিকার নিশ্চিত করতেই এমন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘পুরো জিনিসটা রিস্ট্রাকচার করে ওদের যদি কোনো পলিসিগত পরিবর্তন করতে হয় সেটা করে তারা আবার এটা চালু করবে।’

বাংলাদেশীরা সাধারণত ‘টুরিস্ট ভিসায়’ না গেলেও ‘ভিজিট ভিসায়’ অনেকে ওমান যায়, যাদের অনেকেই আর কাজ পায় না।

মৌসুমী রহমান বলেন, দূতাবাসে প্রতিনিয়তই ৫০ থেকে ১০০ জন করে যায়, তারা জানায় যে মাস বা বছরব্যাপী থেকেও ওমানে কোনো কাজ পায়নি এবং দেশে ফিরতে চায়।

বিদেশে কাজের ক্ষেত্রে বাংলাদেশীরা যেসব দেশে গন্তব্য হিসেবে বেছে নেয় তার মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে আছে ওমান।

২০২২ সালে অবশ্য একধাপ এগিয়েছে ওমান। জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর হিসেবে, ২০২২ সালে সৌদি আরবের পর দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ওমান। ওই বছর ওমানে গিয়েছিল প্রায় এক লাখ আশি হাজার বাংলাদেশী।

অভিবাসন নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান রামরু বলছে, চলতি বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক লাখের বেশি বাংলাদেশী ইতোমধ্যে ওমানে পাড়ি দিয়েছে।

রামরুর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘এটা বাংলাদেশের একটা ট্রেন্ড (প্রবণতা) যে একটা দেশে লোক পাঠাতে থাকলে অনবরত সেটা চলতেই থাকে।’

তিনি বলেন, কোনো একটি দেশে বেশি সংখ্যক বাংলাদেশী চলে গেলে তখন এমন ‘নিষেধাজ্ঞা’ দেয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।

তিনি আরো বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাতে দেখা গেছে এমন নিষেধাজ্ঞা, সৌদি আরবেও ছয় সাত বছর ছিল এমন নিষেধাজ্ঞা, এটাও তেমনই একটা নিষেধাজ্ঞা।’

নানা কারণে মালয়েশিয়াতেও চার বছরের মতো বাংলাদেশী কর্মী নেয়া বন্ধ ছিল, যেটা ২০২২ সালের আগস্ট মাস থেকে আবার শুরু হয়েছে। বাহরাইনেও বাংলাদেশীদের জন্য শ্রমবাজার বন্ধ ছিল প্রায় সাড়ে চার বছর। পরে এটি আবারো চালু হয়েছে।

ওমানে ভিসা বন্ধের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেন, ঠিকমতো চাকরির বন্দোবস্ত না করেই অনেককে আদম ব্যবসায়ীরা পাঠিয়ে দিয়েছে। এ কারণে হয়তো সাময়িক এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। কেউ যেন অবৈধ অভিবাসনে না যান তার অনুরোধও করেন তিনি।

প্রভাব কী হতে পারে?

ওমানে এমন সিদ্ধান্তের প্রাথমিক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রেমিট্যান্সের ওপর। রিজার্ভ সঙ্কটের মধ্যে বিদেশে একটি বড় শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া বড় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।

আন্তর্জাতিক রিক্রুটিং অ্যাজেন্সিদের সংস্থা বায়রার প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, ‘আমাদের যদি ৫০ হাজার লোকও বছরে কোনো দেশে গিয়ে থাকে সেটা বন্ধ হলে তো সেটার রেমিট্যান্সের সুযোগও বন্ধ হয়ে যাবে।’

ঢালাওভাবে বেশি কর্মী কোনো দেশে গেলে তাদেরকে নিয়ে যখন সমস্যা দেখা দেয় তার প্রভাবটা পড়ে অন্যদের ওপরে এসে পড়ে।

আবুল বাশার বলেন, ‘আমাদের আবুধাবি বন্ধ হয়ে গেল, এখন ওমান, পাশাপাশি যদি কুয়েত বা কাতার বন্ধ হয়ে যায় তাহলে আমাদের লোক যাওয়ার মতো জায়গা সৃষ্টি হচ্ছে না।’

এই শঙ্কা যে শুধু আবুল বাশারের তেমনও না। যে কারণে ওমানে ভিসা দেয়া বন্ধের কথা উঠে আসছে সেই একই কারণে সংযুক্ত আরব আমিরাতেও ভিসা দেয়া বন্ধ হতে পারে বলে মনে করেন দুবাইতে গালফ নিউজের সাবেক সিনিয়র সাংবাদিক সাইফুর রহমান।

তিনি বলেন, ‘কোভিড-১৯ মহামারির পর প্রচুর বাংলাদেশী আরব আমিরাতে গেছে, যাদের কিছু অংশের মাত্র কাজের সুযোগ হয়েছে। বাকিরা অবৈধ অভিবাসী হয়ে গেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘অবৈধের সংখ্যা যখন মাত্রাধিক হয়ে যায় তখন একটা নিরাপত্তা হুমকির মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়। তখন ওই দেশের নাগরিককে হাইরিস্ক ক্যাটাগরিতে ফেলে ভিসা স্থগিত করে দেয়, অনেক সময় ট্যুরিস্ট ভিসাও বন্ধ করে দেয়।’

তিনি বলেন, দুটি বড় এয়ারলাইন- এমিরেটস এবং ফ্লাই দুবাই ব্যবসায়িক স্বার্থে এখন পর্যন্ত দুবাই ভিসা দিচ্ছে, কিন্তু সরকার হস্তক্ষেপ করে সিদ্ধান্ত নিলে সেখানেও বাংলাদেশীদের ভিসা স্থগিতের সম্ভাবনা রয়েছে।

আরব দেশগুলোতে কর্মী যাতায়াতের ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকার মতো শক্তভাবে যাচাই-বাছাই করা হয় না বলেই ঢালাওভাবে অদক্ষ কর্মী যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয় বলে মনে করেন তিনি।

এই মুহূর্তে ওমানের ভিসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি বাংলাদেশের বাজারের ওপর খুব বড় প্রভাব পড়বে মনে করছেন না অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী।

তিনি বলেন, ‘এই বছর হয়তো একটু কম যাবে, পরের বছর দেখা যাবে আরেকটা দেশ বের করে সেখানে যাচ্ছে।’

এর আগেও যতবার হয়েছে সেগুলো বাংলাদেশের জন্য খুব বিশাল কোনো সঙ্কট হিসেবে আসেনি বলেই উল্লেখ করেন তিনি।

তবে দীর্ঘমেয়াদে এমন সমস্যা ঠেকাতে কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর দিকে জোর দেন অধ্যাপক তাসনীম। এর পাশাপাশি বৈধ কাগজপত্র এবং চাকরি নিশ্চিত করে প্রবাসে যাওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

নানা অনিয়মের কারণে যখন কোনো একটি দেশে এমন ভিসা স্থগিত করা হয় তখন ওই কারণে বৈধভাবে যাতায়াতকারীদের ওপরে প্রভাব পড়ে বলেও মনে করেন তিনি।

সূত্র : বিবিসি



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top