নয়া আতঙ্ক গ্যাস বিস্ফোরণ

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১৯:৫৪; আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০২১ ০৬:৪২

ছবি:প্রতিকী

আতঙ্কের নগরী ঢাকায় আগুনে কেড়ে নিচ্ছে অসংখ্য মানুষের জীবন। যার বেশির ভাগ আবাসিক এলাকায় সংঘটিত হওয়া আগুন। চলতি বছর রাজধানীতে উল্লেখযোগ্য বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে গত সোমবার রাতে রাজধানীর বংশালে আলু বাজারের একটি বাসায় গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণে চার শিশুসহ দগ্ধ ও আহত হয়েছেন ১০ জন। ওইদিন রাত দেড়টার দিকে আলুবাজার বড় মসজিদের পাশে একটি চারতলা বাড়ির নিচতলায় এ ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের পর বাড়িটি হেলে পড়েছে। যেটা এখন বসবাসের জন্য অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ। আহতদের মধ্যে রাজমিস্ত্রি কামাল হোসেনের (৩৫) শরীর ৪০ শতাংশ পুড়ে গেছে।


তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। দগ্ধ কামালের স্ত্রী সেলিনা আক্তার জানান, দুইদিন আগেই তার স্বামী গ্রাম থেকে তাদের কাছে ঢাকায় আসেন। রাতে যখন সবাই শুয়ে ছিলেন তখন হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। রুমের বাইরে রান্নাঘরে আগুন জ্বলতে দেখেন। পাশের দেওয়ালও ধসে পড়ে। এ সময় তারা রুমে আটকা পড়লে বেশ কিছুক্ষণ পর লোকজন লোহার গ্রিল ভেঙে তাদের উদ্ধার করেন। বের হওয়ার সময় তারা আগুনে দগ্ধ হন। শরীরে কাঁচের টুকরো বিদ্ধ হয়। গত ২৭শে জুন রাজধানীর মগবাজারে একটি ভবনের নিচতলার রেস্টুরেন্ট থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ১২ জনের প্রাণহানি ঘটে। বিস্ফোরণের মাত্রা এত ভয়াবহ ছিল যে, এর ফলে একই সঙ্গে ৭টি ভবন এবং রাস্তায় থাকা ৩টি বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই ঘটনায় গুরুতর আহত ৬৬ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।


গত ২রা ডিসেম্বর ভোরে চরমুক্তারপুর এলাকার স্থানীয় জয়নাল আবেদিনের চারতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে অগ্নিদগ্ধ হন বাড়ির ভাড়াটিয়া কাওছার, তার স্ত্রী শান্তা বেগম এবং তাদের দুই শিশু ইয়াছিন ও নোহর। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রথমে মারা যায় ওই পরিবারের দুই শিশু। সর্বশেষ মারা যান শিশুদের বাবা-মা।


এর আগে মুগদায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে পরিবারের চার দগ্ধ সদস্যের মৃত্যু হয়। ২২শে নভেম্বর সকালে রাজধানীর মুগদা থানার মাতব্বর গলির পাঁচ তলা ভবনের নিচ তলায় রান্নাঘরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে শিশুসহ একই পরিবারের চারজন দগ্ধ হয়। ?দগ্ধদের স্বজনরা জানায়, রান্না করতে চুলায় দিয়াশলাই দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। পরে দগ্ধ গৃহবধূ প্রিয়াঙ্কা, প্রিয়াঙ্কার শিশু সন্তান অরূপ, স্বামী সুধাংশু ও প্রিয়াঙ্কার মা শেফালী রানীকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনা বার্নে ভর্তি করা হয়। সকলেই মারা যান।


এ ছাড়া গত ৮ই জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৫২ জনের মৃত্যু হয়। যাদের ৪৯ জনের মরদেহ পুড়ে যায়। ১৭ই মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনার আইসিইউ ইউনিটে আগুনের ঘটনায় রোগী সরানোর সময় তিনজন মারা গেছেন। সরকারি এক প্রতিবেদন মতে, ২০২০ সালে সারা দেশে ১৮ হাজার ১০৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক মানুষ। ক্ষতি হয়েছে অন্তত ১৫৯ কোটি ২৫ লাখ টাকার সম্পদ।


এ বিষয়ে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন তাদের ইমারর্জেন্সি এবং আউটডোরে প্রায় সাড়ে তিন থেকে চার’শ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। ঢামেকের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সূত্র জানায়, দেশে প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন ৫-৬ লাখ মানুষ। এর মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন অন্তত অর্ধলক্ষ মানুষ। বছরে অগ্নিকাণ্ডে মারা যাচ্ছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই ৯ মাসে শুধুমাত্র রাজধানীতেই ৪ হাজার ২৯৯টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। যার বেশির ভাগই ছিল গ্যাস বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট দুর্ঘটনা। এ অগ্নিকাণ্ডে মোট ১১৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। এবং আহত হয়েছে ২০৬ জন। ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত সারা দেশে ১৮ হাজার ১০৪টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের মতে, ভবনের কোথাও গ্যাস জমে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া রাজধানীতে অগ্নিকাণ্ড থেকে সৃষ্ট ৩৯ শতাংশ দুর্ঘটনাই ঘটে গ্যাসের পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে। অনেক সময় অনিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কারণে ফ্ল্যাটের চুলার চাবি বন্ধ করা হয় না। পরে রাতের যেকোনো সময় গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে রান্নাঘরটি গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয়। এবং সেখানে আগুন জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। পরিসংখ্যান বলছে, রাজধানীতে যেমন অর্ধশত বছরের পুরনো লাইন রয়েছে, তেমনি বিভিন্ন শহরে যে গ্যাস সরবরাহ লাইন সমপ্রসারিত হয়েছে, তার ৭০ শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ।


এ বিষয়ে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক তানভীর হোসেন বলেন, এত দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর জন্য অন্যতম দায়ী হচ্ছে নিম্নমানের গ্যাস সিলিন্ডার এবং ত্রুটিপূর্ণ সংযোগ। এ ছাড়া অসচেতনতা তো রয়েছেই। এই অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর মিছিল থামাতে হলে আমাদের সামাজিক আন্দোলনের বিকল্প নেই। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন মানবজমিনকে বলেছেন, গ্যাস লিকেজ থেকে দুর্ঘটনা মূলত দুটি কারণে হচ্ছে। প্রথমত, আমাদের ব্যক্তি অসচেতনতা। দ্বিতীয়ত, নিম্নমানের সিলিন্ডার রেগুলেটর এর জন্য দায়ী। এক্ষেত্রে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি লিকেজের বিষয়টি নিয়মিত চেক করতে হবে। আপনার ঘর যেন গ্যাস চেম্বারে পরিণত না হয় তাই চুলা জ্বালানোর আগে ঘরের সকল দরজা জানালা খুলে ফ্যান ছেড়ে দিয়ে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। এরপর চুলা জ্বালাতে হবে।




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top