বাবর আজমের লং ড্রাইভ, পাপনের ভোকাল টনিক আর কলকাতার সাপোর্ট
রাজ টাইমস ডেস্ক : | প্রকাশিত: ৩১ অক্টোবর ২০২৩ ১১:৩৮; আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৫ ২১:৪৩

পাকিস্তান বনাম বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ এমন একটা খেলা, যে দিকে দু’দেশের ক্রিকেট সমর্থকরাই অধীর আগ্রহে তাকিয়ে থাকেন। ক্রিকেট ছাড়াও তার নানা সামাজিক, রাজনৈতিক বা ঐতিহাসিক কারণও আছে পুরো মাত্রায়।
তার ওপর ম্যাচটা বিশ্বকাপের মতো মঞ্চে হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এবার যেন দু’পক্ষেই উৎসাহ-উদ্দীপনার চেয়ে টেনশনেরই পাল্লা ভারী!
আসলে কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে মঙ্গলবার দুপুরে বাবর আজম আর সাকিব আল হাসান যখন টস করতে নামবেন, তখন তাদের দুই দলের অবস্থা যে খুব স্বাভাবিক- তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না!
দু’দলের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন হলেও দেয়ালে যেন পিঠ ঠেকে গেছে উভয়েরই!
দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ম্যাচটা নাটকীয়ভাবে হেরে গিয়ে পাকিস্তানের অবস্থা এখন খুবই কোণঠাসা। সেমিফাইনালের আশা টিঁকিয়ে রাখতে তাদের গ্রুপ পর্যায়ের বাকি তিনটে ম্যাচ তো জিততে হবেই, তারপরও তাকিয়ে থাকতে হবে বাকি খেলাগুলোর ফলাফলের ওপর।
দেশে ইতোমধ্যেই তুমুল সমালোচনা শুরু হয়ে গেছে যে এখন টুর্নামেন্টে নিজেদের ভাসিয়ে রাখতে আর পাকিস্তান ক্রিকেটের মান-ইজ্জত বাঁচাতে বাবর আজমের দলের মঙ্গলবার জেতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই!
অন্যদিকে বাংলাদেশের জন্য এই টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালে ওঠার আর কোনো আশা নেই, নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে অপ্রত্যাশিতভাবে হেরে দলের মনোবলও তলানিতে।
কিন্তু তারপরও প্রতিটা দেশের জন্য এমন কিছু কিছু ম্যাচ থাকে, যেগুলো জিততে পারলে বাকি টুর্নামন্টে হারার দু:খও অনায়াসে ভুলে যাওয়া যায়।
বিশ্বকাপের মঞ্চে বাংলাদেশের জন্য এই ম্যাচগুলোই হলো পাকিস্তান বা ভারতের বিরুদ্ধে খেলা।
এই দু’টি ম্যাচ জিততে পারলে অবধারিতভাবে বহু বাংলাদেশ সমর্থক নিশ্চয় নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে হারের যন্ত্রণাও ভুলতে রাজি থাকবেন।
এর মধ্যে পুনেতে ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটা হাতছাড়া হয়ে গেছে অনেক আগেই, এখন কলকাতায় পাকিস্তানকে হারাতে পারলে বাংলাদেশের কিছুটা সম্মান বাঁচবে নি:সন্দেহে।
কলকাতায় আসা বেশ কয়েক হাজার বাংলাদেশী সমর্থকও বুক বাঁধছেন সেই আশাতেই!
এই ধরনের একটা পটভূমিতেই বিশ্বকাপে মুখোমুখি হচ্ছে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান – যে ম্যাচের প্রস্তুতি ঘিরে কলকাতায় ইতোমধ্যেই ঘটনার ঘনঘটা!
ইকো পার্কে বাবর আজম, ইমাম-উল হক
শনিবার সন্ধ্যায় ইডেনে যখন ডাচ বোলারদের হাতে বাংলাদেশ ব্যাটাররা নাস্তানাবুদ হচ্ছেন, তখনই কলকাতা বিমানবন্দরে এসে নামে পাকিস্তান টিম।
বাংলাদেশ টিম শহরের কেন্দ্রে অভিজাত আলিপুর এলাকার তাজ বেঙ্গলে উঠলেও পাকিস্তানকে কিন্তু শহরের পূর্বপ্রান্তে ইএম বাইপাসের ধারে বিলাসবহুল জে ডাব্লিউ ম্যারিওট হোটেলে রাখা হয়েছে।
টিমের ক্রিকেটাররা যেহেতু এই মুহূর্তে একটু চাপে, তাই কলকাতায় এসে একটু ‘আনওয়াইন্ড’ করতে তাদের কয়েকজন শহরের ‘সায়েন্স সিটি’তে ঘুরতে যাবেন বলে স্থির হয়েছিল।
রোববার ছুটির দিনেও সায়েন্স সিটি সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য বন্ধ করে দিয়ে পুরো এলাকাটা পুলিশ কর্ডনও করে দিয়েছিল, যাতে পাকিস্তানি ক্রিকেটাররা নিশ্চিন্তে জায়গাটা ঘুরে দেখতে পারেন।
কিন্তু টিম হোটেল থেকে এই সায়েন্স সিটি একেবারে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে। যেটা দেখে বাবর আজম শেষ মুহূর্তে একটু দূরে ‘লং ড্রাইভে’ যেতে চান।
পাকিস্তান টিম ভারতের যে শহরেই থাকুক, সে রাজ্যের পুলিশের রাতের ঘুম যে বরবাদ হয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাবরের কথায় কলকাতা পুলিশ একটু বেকায়দাতেই পড়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত ঠিক হয়, বাবর আজমরা কলকাতা শহরতলির নিউ টাউনে, যেটা টিম হোটেল থেকে ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে, সেখান বরং ড্রাইভ করে যেতে পারেন!
সেই অনুযায়ী, বাবর আজম, ইমাম-উল হক ও আরো দু’একজন ক্রিকেটার নিউ টাউন এলাকার ‘ইকো পার্কে’ ঘুরে আসেন– ক্রিকেটের চাপটা থেকে নিজেদের খানিকক্ষণ দূরে রাখতে!
কয়েকজন ক্রিকেটার ক্যামাক স্ট্রিটের জুয়েলারি শপে গিয়ে কেনাকাটাও করেছেন, তবে শাদাব খান আবার পার্ক সার্কাস এলাকার একটি শপিং মলে যেতে চেয়েও অনুমতি পাননি!
সম্ভবত সাংবাদিকদের অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চান না বলেই বাবর আজম বা দলের কোনো ক্রিকেটার সোমবার প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলনেও আসেননি – তার বদলে পাঠানো হয়েছিল গ্রান্ট ব্র্যাডবার্নকে।
পাকিস্তান টিম এ মাসের গোড়ায় ভারতে পা রাখার পর থেকে বিভিন্ন শহরে যে ধরনের আপ্যায়ন পাচ্ছেন বা নানা স্বাদের বিরিয়ানি চেখে দেখছেন, তা নিয়ে পাকিস্তানি মিডিয়াতে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে।
কিন্তু কলকাতায় যে ‘আর্সালানে’র বিরিয়ানি সাম্প্রতিককালে এ শহরের জাতীয় খাদ্যে পরিণত হয়েছে – সেটা এখনো পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের পরখ করার সুযোগ হয়নি।
‘টিমের এখন যা অবস্থা, তাতে আর বিরিয়ানি খাওয়ার সুযোগ কই!’, আক্ষেপের সাথেই জানালেন পাকিস্তান টিমের ডিজিটাল আউটপুটের ভারপ্রাপ্ত আম্মার আহসান!
বোর্ড সভাপতির সিরিজ বৈঠক
নেদারল্যান্ডস ম্যাচে ৮৭ রানে হারার পর হতোদ্যম বাংলাদেশ ক্রিকেটারদের শরীরী ভাষা আর অ্যাটিচিউড যে একেবারে ‘ঝুলে গেছে’ – তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পাকিস্তানে যেমন ক্রিকেটারদের তীব্র সমালোচনা হচ্ছে, তেমনি বিশ্বকাপে হতাশাজনক পারফরমেন্সের জেরে বাংলাদেশের মিডিয়াও দেশের ক্রিকেট তারকাদের আক্রমণে ছিঁড়ে খাচ্ছে।
এই পটভূমিতেই রোববার দুপুরে কলকাতায় এসেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হোসন পাপন।
বিমানবন্দর থেকেই তিনি বোর্ড ডিরেক্টরদের নিয়ে সোজা টিম হোটেলে গিয়ে সিনিয়র ক্রিকেটারদের সাথে এক এক করে আলাদা বৈঠকে বসেন।
পরে নিজেই জানান সাকিব আল হাসান, লিটন দাস, মেহেদি হাসান মিরাজ – সবার সঙ্গেই আলাদা করে একান্তে কথা বলেছেন তিনি। মুশফিকুর রহিম ও মাহমুদুল্লাহ অবশ্য দু’জনে এক সাথেই বসেছিলেন বোর্ড সভাপতির সঙ্গে।
বিশ্বকাপে দলটার ঠিক কোথায় সমস্যা হচ্ছে, কোন জিনিসগুলো ঠিক করা দরকার, বোর্ড আর কিভাবে তাদের সাহায্য করতে পারে এই সব বিষয় নিয়েই ক্রিকেটারদের সাথে কথা বলেন বোর্ড সভাপতি।
টুর্নামেন্টে বাকি তিনটি ম্যাচ যে ‘ভয়ডরহীন’ভাবে খেলা দরকার, সেই বার্তাও টিমকে দিয়ে এসেছেন তিনি।
রোববার বিকেলে ক্রিকেটারদের সঙ্গে নাজমুল হোসেন পাপনের এই যে সংলাপ, কলকাতার ক্রীড়া ময়দানের ভাষায় সেটাকেই বলে ‘ভোকাল টনিক’। আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে অনেকে যাকে ‘পেপ টক’ বলেও চেনেন।
কলকাতার প্রবাদপ্রতিম ফুটবল কোচ, প্রয়াত পি কে ব্যানার্জি (‘পিকে’) এই ভোকাল টনিক শব্দটাকে শহরের খেলাধুলোর অভিধানে প্রায় অমর করে গিয়েছেন।
জাতীয় দলই হোক কিংবা ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান– পিকে যখন যে দলের কোচিং করেছেন ম্যাচের আগে বা হাফটাইমে তাদের সামনে নরমে-গরমে ভাষণ দিয়ে ফুটবলারদের তাতাতে তার জুড়ি ছিল না। আর তার সেই কথাবার্তাই বিখ্যাত হয়ে আছে ‘ভোকাল টনিক’ নামে।
নাজমুল হোসেন পাপন ক্রিকেটারদের আলাদা আলাদা করে যেভাবে হতোদ্যম দশা থেকে চাঙ্গা করতে চেয়েছেন, সেটাও আসলে এক ধরনের ভোকাল টনিক ছাড়া আর কিছুই নয়!
কিন্তু টুর্নামেন্টে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের পারফরমেন্স এতটাই হতশ্রী যে এই ভোকাল টনিকে আদৌ কোনো কাজ হবে, বাংলাদেশ সমর্থকরাই সে কথা মানতে রাজি নন!
ইডেনে ক্লাব হাউস গেটের সামনে ঢাকা থেকে আসা এমনই কয়েকজন সমর্থক বিবিসি বাংলাকে বলেই ফেললেন, ‘আরে ছাড়ুন! পাপন সাহেবের নিজের চাকরি বাঁচে কি না তার ঠিক নেই, উনি দলকে কী চাঙ্গা করবেন!’
প্রাক-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলনে আসা সাকিব আল হাসানকে একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করছিলেন, ঠিক দু’দিন আগে নেদারল্যান্ডসের কাছে হারের পর আপনার গলাটা একদম ডাউন শোনাচ্ছিল... মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সাকিব হেসে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ‘আজকে গলাটা চাঙ্গা শোনাচ্ছে তো?’
তারপর জানালেন, মাঠে নেমে আসল কাজটা কিন্তু ক্রিকেটারদেরই করতে হবে। তারা তাদের সেরাটা দিতে পারলেই কেবল ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব!
কার পাশে থাকবে কলকাতা?
সোমবার বিকেল ৪টার দিকে পাকিস্তানের প্র্যাকটিস শেষে মহম্মদ রিজওয়ান যখন মাঠ থেকে ফিরছেন, গ্যালারিতে আচমকা শতখানেক ক্রিকেট ভক্ত কোথা থেকে উদয় হয়ে ‘রিজওয়ার রিজওয়ান’ আওয়াজে ইডেন মাতিয়ে তুললেন!
ম্যাচের আগের দিন এই দর্শকদের মাঠের ভেতরে ঢোকার কথা নয়। কিন্তু তারাই বলতে পারবেন কিভাবে ঢুকলেন এবং এটাও বুঝিয়ে দিলেন, মঙ্গলবার কলকাতার দর্শকদের একটা বড় অংশ পাকিস্তানের জন্যই গলা ফাটাবেন।
মোহম্মদ রিজওয়ান, ও পরে শাহিন শাহ আফ্রিদিও গ্যালারির কাছে গিয়ে এই ভক্তদের আবদার মেটালেন, তাদের সেলফিতে মুখ দেখালেন এবং কয়েকটা অটোগ্রাফও দিলেন।
ঠিক সাড়ে সাত বছর আগে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এই ইডেনেই যখন বাংলাদেশ ও পাকিস্তান মুখোমুখি হয়েছিল, তখন কিন্তু কলকাতার বেশিরভাগ দর্শক পাকিস্তানের সমর্থনেই স্লোগান দিয়েছিল।
সে দিন মাঠে বাংলাদেশের হাজার কয়েক সমর্থক স্তম্ভিত হয়ে দেখেছিলেন গ্যালারিতে পাকিস্তানের সমর্থকদেরই পাল্লা ভারী। আর তাদের ‘জিও জিও পাকিস্তান’ স্লোগানে ইডেন মুখরিত।
পাকিস্তানি তারকা মোহাম্মদ হাফিজ সেই ম্যাচের পর না-বলে পারেননি, “কলকাতার মাঠে ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, পাকিস্তান জিতেগা’ শুনে আমার দিল ভরে গেছে!”
সেই বিশ্বকাপে পাকিস্তান-বাংলাদেশ ম্যাচের টিকিটের চাহিদা অত ছিল না, আর কলকাতার বাছাই করা কিছু ক্লাবই সিএবি থেকে কোটার সব টিকিট তুলে নিয়েছিল।
তারপর শহরের কোনো কোনো অঞ্চল থেকে দলবদ্ধভাবে এক শ্রেণীর দর্শকরা সেই টিকিট নিয়ে ইডেন ভরিয়ে দিয়েছিলেন। আর তাদের মুখেই ছিল পাকিস্তানের জয়ধ্বনি!
সাড়ে সাত বছর আগের সেই ম্যাচের তুলনায় এখন অবশ্য অনেক বেশি বাংলাদেশী সমর্থক কলকাতায় পা রেখেছেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ম্যাচে মাঠে তাদের দেখাও মিলবে।
কিন্তু বিশ্বকাপের আসরে মঙ্গলবার ইডেন গার্ডেন্সে কলকাতার বেশিরভাগ দর্শকের সমর্থন কারা পাবে, সেটাই এখন কোটি টাকার প্রশ্ন!
সূত্র : বিবিসি
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: