জার্মানির অর্থনৈতিক মন্দা: উদ্বিগ্ন বাংলাদেশী রফতানিকারকরা

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৭ অক্টোবর ২০২২ ২৩:০২; আপডেট: ১৭ অক্টোবর ২০২২ ২৩:০২

ছবি: সংগৃহিত

বড় অর্থনীতির দেশ জার্মানি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে অর্থনৈতিক মন্দার দিকে যাচ্ছে দেশটি। জার্মানির অর্থ মন্ত্রণালয় শুক্রবার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, দেশটিতে মন্দা শুরু হয়েছে। চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে শুরু হয়ে এ মন্দার ব্যাপ্তি ছড়াবে আগামী তিন প্রান্তিকেও। খবর টিবিএসের।

জার্মানির অর্থমন্ত্রী রবার্ট হাবেক ১২ অক্টোবর জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে অর্থনৈতিক মন্দায় ডুববে জার্মানি। অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়েছে, যার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে পশ্চিমের অর্থনীতিতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অর্থনীতিবিদদের ধারণা ছিল, ২০২৩ সালে জার্মান অর্থনীতি ২ দশমিক ৫ শতাংশ বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে তা শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ কমবে বলে মনে করা হচ্ছে। ২০২২ সালে ২ দশমিক ২ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে বলে মনে করা হয়েছিল, বাস্তবে তা ১ দশমিক ৪ শতাংশ হয়েছে। ফলে এ বছরও প্রবৃদ্ধির হার কম। এ দুইয়ের যোগফলেই ২০২৩ সালে জার্মানিতে মন্দা দেখা দেবে।

জার্মান অর্থনীতির বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিকারকদের মধ্যে। বিশেষ করে যারা জার্মানিতে পোশাক রফতানি করেন তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন। কারণ এরই মধ্যে দেশটিতে পোশাক রফতানির গতি কমে এসেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরু থেকেই রফতানি প্রবৃদ্ধির হারে এ প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের পণ্য রফতানির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার জার্মানি। মোট রফতানির প্রায় ১৫ শতাংশই হয় দেশটিতে। ২০২১-২২ অর্থবছর জার্মানিতে বাংলাদেশের মোট রফতানির প্রায় ৯৫ শতাংশ ছিল পোশাক। পণ্যটির রফতানিকারকরা এখন রয়েছেন বড় ধরনের শঙ্কায়। তাদের দাবি, এরই মধ্যে দেশটির পোশাক ক্রেতাদের পক্ষ থেকে ক্রয়াদেশ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। যেসব পোশাক পণ্য রফতানি হয়েছে, সেগুলো অবিক্রীত অবস্থায় মজুদ হয়ে আছে ক্রেতাদের ওয়্যারহাউজ বা গুদামে।

জার্মানিসহ ইউরোপের বাজারে বড় পরিমাণে পোশাক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে আলদি, এলপিপি, কিকসহ আরো বেশকিছু ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে এলপিপি বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকদের বড় ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। অনেকগুলো কারখানা থেকে পণ্য নিয়ে তারা অর্থ পরিশোধ করছে না। আবার প্রস্তুত হওয়া পণ্যও নিচ্ছে না। প্রথমে বলেছিল অক্টোবর-নভেম্বরে পণ্য নেবে। এখন বলছে আগামী মার্চ-এপ্রিলে নেবে। একটি কারখানা আছে যাদের সাড়ে ৬ লাখ ডলারের পণ্য আটকে গেছে। আবার ৬০ হাজার ডলারের পণ্য নিয়েও অর্থ পরিশোধ করছে না। এদিকে আরেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান কিক এখন আর নতুন করে পণ্য নিতে চাইছে না।

ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ একটি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ প্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, জার্মানিসহ গোটা ইউরোপে পোশাক রফতানির গতি কমে এসেছে। নিকটভবিষ্যতে তা আরো কমবে। অনেক কিছুই নির্ভর করছে রাশিয়ার জ্বালানি নিয়ন্ত্রণের মাত্রার ওপর। যুদ্ধটা এমন একটা জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যে অবস্থায় আগামী নভেম্বরের আগে ক্রয়াদেশ পরিস্থিতি নিয়ে কোনো রকম চিন্তাভাবনা করাও সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের প্রতিষ্ঠানের ক্রয়াদেশ পরিস্থিতি থেকে আনুমানিক হিসাব বলছে, ক্রয়াদেশ অন্তত ৪০ শতাংশ কমেছে।

জার্মান গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, যুদ্ধের কারণে জার্মানি সবচেয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে জ্বালানি খাতে। সমস্যাটি জার্মানিকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে সংকটে ফেলেছে। শুধু জ্বালানি খাতের সংকটে চলতি বছর জার্মানির মুদ্রাস্ফীতি ৮ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০২৩ সালে তা ৭ শতাংশ থাকবে বলে মনে করছে দেশটির সরকার।

দেশের অন্যতম পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান এমবি নিট ফ্যাশন। তাদের রফতানি পণ্যের বড় অংশই যায় জার্মানিতে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং নিট পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বণিক বার্তাকে বলেন, জার্মানির মন্দার প্রতিফলন এরই মধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। রফতানি কমছে। জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩০ শতাংশের বেশি। অর্থবছরের দ্বিতীয় মাসে এটি ছিল ২০ শতাংশের বেশি। পরের মাসে রফতানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়েছে। ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির হার আগামী মাসে আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা করছি।

জার্মানিতে পোশাক রফতানি করে এমন একাধিক কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, উদ্বেগ শুধু জার্মানিকে নিয়ে নয়, বরং গোটা ইউরোপকে ঘিরে। মন্দার কারণে ক্রয়াদেশ কমেছে, স্থগিতও হয়েছে। প্রস্তুত হওয়া পোশাক ক্রেতারা নিচ্ছে না। এ পরিস্থিতির প্রভাব ব্যাপক। পণ্য রফতানি করলেও অর্থ পরিশোধ হচ্ছে না। ভবিষ্যৎ ক্রয়াদেশগুলোর বিপরীতে পণ্য সরবরাহের সময়সীমা ন্যূনতম ছয় মাস করে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে।

বিকেএমইএর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জার্মানি ও ফ্রান্স দুই দেশকে ফ্র্যাঙ্কো জার্মানি বলা হয়। দেশ দুটির অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি মোটামুটিভাবে একই রকম। দুই দেশ থেকেই আসা পোশাকের ক্রয়াদেশে বড় ধরনের পতন ঘটেছে। এর দুটি কারণের একটি হলো এ বাজারগুলোর ক্রেতারা অনেক বেশি পরিমাণে ক্রয়াদেশ দিয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিপুল পরিমাণ পোশাক অবিক্রীত হয়ে জমে গেছে। আরেকটি কারণ হলো ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে জার্মানির অর্থনীতির অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে। খাদ্যনিরাপত্তা, চিকিৎসা এমন বিষয়গুলোর দিকে নজর বেশি তাদের। এ পরিস্থিতিতে পোশাকের ক্রয়াদেশ কমিয়ে দিয়েছে ক্রেতারা। ফলে বড় ধাক্কাটা মোকাবেলা করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। আমাদের হিসাবে ক্রয়াদেশ অন্তত ২০ শতাংশ কমেছে।’

জার্মানিতে পোশাক রফতানিকারক অন্যতম প্রতিষ্ঠান ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক ও বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘প্রাপ্ত তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং খুচরা বাজারে প্রভাবের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানিসহ প্রধান বাজারগুলোয় রফতানি প্রবৃদ্ধি কমছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন আমরা।’

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জার্মানিতে বাংলাদেশের পণ্য রফতানি হয় ৫৮৯ কোটি ডলারের। সে সময় রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৭৫৯ কোটি ডলারের কিছু বেশি। অর্থবছরটিতে রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ। তবে এখন সেই প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিক জুলাই-সেপ্টেম্বরে রফতানি হয়েছে ১৬৩ কোটি ২৪ লাখ ডলারের পণ্য, আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা মাত্র ২ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি।

ইপিবির সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তৈরি পোশাক রফতানি হয়েছে ৪৯৪ কোটি ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নে বৃহত্তম রফতানি বাজার জার্মানিতে পোশাক রফতানি বেড়েছে মাত্র ১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, যার পরিমাণ ১৫২ কোটি ডলার।

জার্মানিতে রফতানি হওয়ার কথা এমন অনেক পণ্যের ক্রয়াদেশ স্থগিত হয়েছে উল্লেখ করে এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী, এমপি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে শক্তিশালী বাজার জার্মানি। দেশটি এখন অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পড়েছে। এর প্রভাব লক্ষ করতে শুরু করেছেন রফতানিকারকরা। ক্রয়াদেশ আগের তুলনায় অনেক কম। এ পরিস্থিতিই এখন বাস্তবতা। গোটা ইউরোপের অর্থনীতি একে অন্যের সঙ্গে জড়িত। একটি দেশ খারাপ থাকলে অন্য দেশের ওপরও প্রভাব পড়ে। যুদ্ধ না থামলে আগামী বছরটি শুধু আমাদের জন্যই নয়, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই কঠিন একটি বছর হতে যাচ্ছে।’

নিউজের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top