সতর্কীকরণেই সীমাবদ্ধ কেন্দ্রীয় ব্যাংক

অনিয়মের ভাগাড় সরকারী ব্যাংক

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৩১; আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০২০ ১৬:৫৯

ফাইল ছবি

সরকারী ব্যাংকগুলোতে জালিয়াতি আর অনিয়ম প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠছে। ঋণের বিদেশে পাচার করা টাকা ঋণ খেলাপিতে পরিণত হওয়ার পর আবার বিশেষ সুবিধার আওতায় ১০ বছরের জন্য ওই খেলাপি ঋণই নবায়ন করা হয়। শুধু তা-ই নয়, এক খাতের ঋণ অন্য খাতে নেয়াসহ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংক থেকে বের করা অর্থও নবায়ন হয়েছে।

সম্প্রতি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের চারটি সরকারি ব্যাংক নিয়ে পর্যালোচনা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য। প্রতিবেদনে আরও আট ধরনের ঋণ অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনা উল্লেখ করা হয়। তবে এতে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাংক এবং ঋণ অনিয়মে জড়িত প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করা হয়নি।

রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব অনিয়ম নিয়মতি বেড়েই চলছে।বিষয়টি নিয়ে স্বয়ং কেন্দ্রীয় ব্যাংকই উদ্বিগ্ন। তবে প্রভাবশালীদের হাত থাকায় কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে সতর্ক করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ ধরনের অনিয়ম রোধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারলে এ খাতের জন্য অন্ধকার অপেক্ষা করছে।

এসব অনিয়ম আর জালিয়াতি প্রতিরোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনাও উপেক্ষা করা হচ্ছে। পর্যালোচনা প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, আরেকটি সরকারি ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট ঋণ অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হলেও তা দুই বছরেও করা হয়নি। এছাড়া আরেক ব্যাংকের গ্রাহকের বকেয়া (ওভারডিউ) দায়সহ তাদের পরিচালক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে বকেয়া টাকা এবং প্রাথমিক মানের খেলাপি ঋণ (এসএমএ) রয়েছে। এরপরও ঋণ অধিগ্রহণের লক্ষ্যে ওই গ্রাহকের নামে নতুন ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।

ব্যাংক থেকে সাময়িক বিশেষ ঋণের আওতায় ঋণগ্রহীতা কোম্পানির রফতানি উন্নয়ন ফান্ডের (ইডিএফ) এলসির দায় বকেয়া থাকা সত্ত্বেও আবার ফোর্সড লোন (দ্বিগুণ মর্গেজ) সৃষ্টি করে গ্রেস পিরিয়ডসহ ৮ থেকে ১০ বছর মেয়াদে ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে।

মেয়াদোত্তীর্ণের পর টাকা পরিশোধ না করেও উল্টা সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। গ্রাহকের প্রকৃত দায়-দেনা গোপন করে অনুমোদিত ঋণসীমার অতিরিক্ত মূল্যের ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসি স্থাপন করা হয়েছে। স্বীকৃত বিল মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় অপরিশোধিত থাকা সত্ত্বেও অবারিতভাবে ‘ব্যাক টু ব্যাক’ এলসি সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে দায় সৃষ্টি করা হয়েছে, যার মধ্যে সীমাতিরিক্ত দায় রয়েছে। গ্রাহকের অনুকূলে অনিয়মিত পিএডি ও এলটিআর বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঋণের দায় থাকা সত্ত্বেও অনুমোদন ছাড়াই এলসি স্থাপন করা হয়েছে।

ব্যাংকসমূহ থেকে অনিয়ম করেই গ্রাহকদের পিএডি দায় সমন্বয় বা অর্থ আদায় না করেই ডকুমেন্টস হস্তান্তর করা হয়েছে। রফতানি বিল ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় তহবিল সংরক্ষণ বা অর্থ আদায় না করেই গ্রাহকের চলতি হিসাবে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করা হয়েছে এবং গ্রাহকের অনুকূলে চুক্তিপত্রের বিপরীতে সীমাতিরিক্ত বিশেষ দায় সৃষ্টি করা হয়েছে এবং ঋণ অনুমোদনের ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের জামানতদাতার ঋণ হিসাব আদালতের নির্দেশে অশ্রেণিকৃত (মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত) থাকা সত্ত্বেও গ্রাহকের অনুকূলে নতুন ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে।

এসব অনিয়মের ব্যাপারে কথা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের সাথে। তিনি বলেন, অর্থ পাচার একটি ফৌজদারি অপরাধ। সে অপরাধী কীভাবে ১০ বছরের সুবিধা পায়? কী করে ঋণখেলাপিমুক্ত হয়? এসব সুবিধা বাতিল করে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।

এসব অনিয়ম আর জালিয়াতিতে জড়িত কর্মকর্তা সহ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া জরুরী মনে করেন খোন্দকার ইব্রাহিম। তাছাড়া অর্থ পাচারের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেই উদ্ঘাটন করেছে, সেহেতু জড়িত ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আর কোনো বাধা থাকার কথা নয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারিতে এসব প্রতিষ্ঠানের জাল-জালিয়াতি, ফান্ড ডাইভারশনসহ (এক খাতের ঋণ অন্য খাতে ব্যবহার করা) মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার বা সন্দেহজনক লেনদেন) সম্পৃক্ত অপরাধ থাকলেও এরপরও ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধার আওতায় তাদের ঋণ পুনঃতফসিল করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টের আওতায় এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ৯ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা ঋণ পুনঃতফসিল করেছে। এই সুবিধার বাইরে পুনঃতফসিল হয়েছে আরও ৩ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। এসব ব্যাংকে জুন পর্যন্ত মোট ১৩ হাজার ১৭৭ কোটি টাকা নবায়ন করা হয়। কিন্তু এর বিপরীতে ডাউন পেমেন্ট হিসেবে জমা হয়েছে মাত্র ২৪০ কোটি টাকা, যা মোট পুনঃতফসিলের ১ দশমিক ৮২ শতাংশ।

এসব অনিয়ম ক্রমাগত চলতে থাকলে সাধারণ গ্রাহকদের আস্থা কমার কথা বলেন ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান এবং মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক এমডি আনিস এ খান। তিনি বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান অর্থ পাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ বাংলাদেশ ব্যাংক পেয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান কীভাবে ১০ বছরের জন্য ঋণখেলাপিমুক্তির সুবিধা পায়। এটা বোধগম্য হয় না। এ ধরনের ঘটনা নিন্দনীয়।

এর আগে প্রজ্ঞাপন জারি করে গত বছর মাত্র ২ শতাংশ নগদ জমা দিয়ে ১০ বছরের জন্য মন্দমানের খেলাপি ঋণ নবায়নের সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এক্ষেত্রে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ সুদহার নির্ধারণ করা হয় ৯ শতাংশ। এমনকি পুনঃতফসিলের আগে সুদ মওকুফ সুবিধার সুযোগও রাখা হয়। ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো খসড়া পরিপত্রের আলোকে ১৬ মে প্রজ্ঞাপনটি জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই সময় জারী করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বিশেষ এ নীতিমালার আওতায় ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দ বা ক্ষতিজনক মানে শ্রেণিকৃত ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে। ব্যাংকগুলো ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে অনারোপিত সুদের সম্পূর্ণ অংশ এবং ব্যাংকের স্থগিত খাতে রক্ষিত সুদের পুরোটা মওকুফ করতে পারবে। তবে কোনো ক্ষেত্রে সুদহার ৯ শতাংশের বেশি হবে না। মাসিক অথবা ত্রৈমাসিক কিস্তিতে এ ঋণ আদায় করা যাবে।

ব্যাংকসমূহের চলমান নিয়ম অনুযায়ী আসল এবং সুদ বিবেচনায় নিয়ে কিস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে। এক বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ সর্বোচ্চ ১০ বছরের জন্য ঋণ পুনঃতফসিল করা যাবে। ঋণ পুনঃতফসিলের ক্ষেত্রে নগদে ন্যূনতম ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিতে হবে। কোনো ঋণের ৯টি মাসিক কিস্তির মধ্যে ৬টি এবং ৩টি ত্রৈমাসিক কিস্তির ২টি অনাদায়ি হলে এ সুবিধা বাতিল হবে।

ঋণের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের জন্য এত সুযোগ-সুবিধা থাকার পর ও ক্রমেই বাড়ছে ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ। ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ১০ বছরের জন্য খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ নিয়ে গত বছর (২০১৯) রেকর্ড ৫২ হাজার ৭৬৭ কোটি টাকার খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলের মাধ্যমে নিয়মিত করেছে পুরো ব্যাংক খাত।

সর্বশেষ চলতি বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর সময়েই পুনঃতফসিল করা হয় ২১ হাজার ৫৯২ কোটি টাকা। এসব কারণে আদায় না বাড়লেও গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ কমে ৯৪ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা হয়। এর তিন মাস আগে তথা গত বছরের সেপ্টেম্বর শেষে এর পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। খবর-যুগান্তর

  • এসএইচ

 

 



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top