রাশিয়ার সঙ্গে আরো নৈকট্যে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্ব বাড়বে ভারতের?

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:১১; আপডেট: ৪ মে ২০২৪ ০৩:৫২

ছবি: সংগৃহীত

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর এখন মস্কোয় অবস্থান করছেন। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভের সঙ্গে বুধবার তার এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে তারা সামরিক ও প্রযুক্তি খাতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করেন। কথা হয় যৌথভাবে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র উৎপাদন ও উন্নয়নের বিষয়েও। দুই দেশের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে এ-সংক্রান্ত কিছু উদ্যোগও নেয়া হয়েছে বলে বৈঠক শেষে এক যৌথ ব্রিফিংয়ে জানানো হয়।

ওইদিনই রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে দেখা করেন সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্কর। সে সময় ইউক্রেন ইস্যুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিরপেক্ষ অবস্থানের প্রশংসা করেন ভ্লাদিমির পুতিন। নরেন্দ্র মোদিকে আখ্যায়িত করেন ‘‌বন্ধু’ হিসেবে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে রাশিয়া সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে জয়শঙ্করকে তিনি বলেন, ‘‌তাকে এখানে দেখতে পেলে আমরা আনন্দিত হব।’

ভারত-রাশিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বাণিজ্যিক-সামরিক ও কৌশলগত নৈকট্য এখন বাড়ছে। এরই মধ্যে ভারত-রাশিয়া দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের আকার ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। সুব্রামনিয়াম জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক চলাকালে ভ্লাদিমির পুতিন বিষয়টি নিয়ে উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছেন। মস্কো ও নয়াদিল্লির মধ্যকার এ নৈকট্যের প্রেক্ষাপটে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নতুন করে আগ্রহী করে তুলছে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকদের।

তাদের ভাষ্যমতে, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শুরু থেকেই রাশিয়াকে কূটনৈতিকভাবে ‘‌একঘরে’ করে ফেলার নীতি অনুসরণ করছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্য যেকোনো দেশের মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা নিয়ে বিভিন্ন সময় দেশটি প্রতিক্রিয়া দেখালেও ব্যতিক্রম ভারত। শুরু থেকেই রাশিয়া ইস্যুতে নয়াদিল্লিকে ‘‌ব্ল্যাংক চেক’ দিয়ে রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ভারত ও রাশিয়া এখন যেভাবে একে অন্যের কাছাকাছি আসছে, তাতে ভবিষ্যতে বিষয়টি নিয়ে ওয়াশিংটনের অস্বস্তি বাড়ার জোর আশঙ্কা রয়েছে।

দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা অস্বস্তি এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন নিবন্ধের ভাষ্যমতে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে এ অস্বস্তির সূচনা যুক্তরাষ্ট্রে শিখ সম্প্রদায়ের নেতা গুরওয়ান্ত সিং পান্নুনকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ থেকে। খালিস্তানপন্থী ওই শিখ নেতাকে হত্যার চেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়া হয়েছে দাবি করে গত মাসের শেষদিকে বক্তব্য রাখে ওয়াশিংটন।

এর পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, সরাসরি না বললেও এর সঙ্গে নয়াদিল্লির সংশ্লিষ্টতা নিয়ে সন্দেহ করছে ওয়াশিংটন। আর হোয়াইট হাউজের পক্ষ থেকে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে এ হত্যা চেষ্টার অভিযোগটিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে মার্কিন সরকার। ভারত সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়কে বিষয়টি জানানোও হয়েছে।

সে সময় ভারতের পক্ষ থেকেও বিষয়টি নিয়ে জোর তদন্ত ও অনুসন্ধান চালানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।

ভূরাজনীতির পর্যবেক্ষকরা বলছেন, বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব মোকাবেলার তাগিদ থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোয় মনোযোগী হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। সর্বশেষ গত জুনে যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হোয়াইট হাউজে লালগালিচা সংবর্ধনাও দেয়া হয়। কিন্তু এর কয়েক মাসের মাথায় দুই দেশকেই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয় পান্নুন হত্যাচেষ্টার অভিযোগ। ওই অস্বস্তি পুরোপুরি কেটে ওঠার আগেই যৌথভাবে অস্ত্র উৎপাদনে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে রাশিয়া ও ভারত। বিষয়টি ওয়াশিংটন-নয়াদিল্লি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে প্রভাব ফেলার জোর আশঙ্কা রয়েছে।

কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে গেছে বলে নিক্কেই এশিয়ায় চলতি সপ্তাহেই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংকট্যাংক প্রতিষ্ঠান ন্যাটস্ট্র্যাটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো রাজ কুমার শর্মা সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, ‘‌রাজনৈতিক ইঙ্গিতের কথা বলতে গেলে (জয়শঙ্করের) এ সফর বেশ গুরুত্বপূর্ণ।’

এ সময় শিখ নেতার হত্যাচেষ্টায় ভারতের জড়িত থাকার সম্ভাবনা নিয়ে ওয়াশিংটনের গত মাসে তোলা অভিযোগের বিষয়টিকেও সামনে নিয়ে আসেন তিনি।

জয়শঙ্করের সফরের প্রেক্ষাপটে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক অন্যান্য সংবাদমাধ্যমও। এসব মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন-নিবন্ধের ভাষ্য অনুযায়ী, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরুর পর রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা। এসব বিধিনিষেধ উপেক্ষা করেই এখন রুশ অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হয়ে উঠেছে ভারত। দেশটি এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে রাশিয়ার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের যেকোনো বৈরী পদক্ষেপে অংশগ্রহণ থেকেও নিজেকে বিরত রেখেছে।

ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযানের নিন্দা জানিয়ে জাতিসংঘে আনা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিতে বারবার অস্বীকৃতি জানিয়েছে ভারত। আবার দুই দেশের মধ্যে জ্বালানি বাণিজ্যে লেনদেন হচ্ছে স্থানীয় মুদ্রায়। এটিও বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে ডলারের আধিপত্য চাপে ফেলার ক্ষেত্রে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই ভারতের রুশ এস-৪০০ এয়ার ডিফেন্স মিসাইল সিস্টেম ক্রয় নিয়ে আপত্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। ওই আপত্তির মধ্যেও ২০২১ সালের শেষ দিকে রাশিয়া থেকে অস্ত্র আমদানিতে নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হয় ভারত। এর পরও এখন পর্যন্ত রাশিয়া-ভারতের দ্বিপক্ষীয় ঘনিষ্ঠতার বিষয়টিকে এক প্রকার উপেক্ষা করে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভিত্তি হলো ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। বিশেষ করে ২০২০ সালে চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সংঘর্ষ ইন্দো-মার্কিন ঘনিষ্ঠতাকে বাড়ানোর অন্যতম বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। সে সময় জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে সঙ্গে করে প্রায় বিস্মৃত কোয়াড জোটের পুনরুত্থান ঘটায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র।

যদিও এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত নির্ভরযোগ্য মিত্র হিসেবে একে অন্যের কাছে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো কভিডের প্রাদুর্ভাবের পর নয়াদিল্লির কাছে আঞ্চলিক ভূরাজনীতির বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল ভারতীয় কোম্পানি সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত টিকা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সে সময় আকস্মিকভাবেই টিকার কাঁচামাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

এতে বিভিন্ন দেশে প্রতিশ্রুত টিকা সরবরাহ করা দূরের কথা, নিজ দেশে কভিডের প্রাদুর্ভাব বাড়া সত্ত্বেও স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতে গিয়েই বিপাকে পড়ে যায় ভারত। অন্যদিকে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোয় টিকার সরবরাহ বাড়িয়ে আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে নিজের প্রভাব আরো শক্ত করে তোলার সুযোগ পায় চীন। আবার চীনের সঙ্গে ভারতের বৈরিতার মাত্রা সাম্প্রতিক মাসগুলোয় বেশ কমে আসতেও দেখা গেছে।

চলতি বছর ভারত ও চীনের মধ্যে তেমন কোনো উত্তেজনাও দেখা যায়নি। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি নিয়ে নতুন করে হিসাব-নিকাশে বসছেন বিশেষজ্ঞরা।




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top