গ্যাস-তেল না পেলে এপ্রিলে হবে বিদ্যুতে রেকর্ড ঘাটতি!

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ২৯ অক্টোবর ২০২২ ২৩:৪১; আপডেট: ১৯ মে ২০২৪ ০৯:১৩

ছবি: সংগৃহিত

লোডশেডিং নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আশার আলো দেখানো হলেও পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে দিনের পর দিন। খবর শেয়ার বিজের।

গত জুলাই থেকে শুরু হয়েছে আনুষ্ঠানিক লোডশোডিং। মাঝে কিছুটা কমলেও সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে তা চরম আকার ধারণ করে। অক্টোবরের শুরুর দিকে দুই দিন রেকর্ড দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে। তবে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং ছিল নিয়মিত ঘটনা। তেল ও গ্যাস সংকটে বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ থাকাই এর মূল কারণ।

যদিও তিন দিন ধরে লোডশেডিংয়ের তীব্রতা কমে এসেছে। আপাতত বন্ধ হলেও লোডশেডিং থেকে মুক্তি পাচ্ছে না সাধারণ জনগণ। তবে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল না পেলে মার্চ থেকে আবারও লোডশেডিং ফিরে আসার আশঙ্কা করছেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা। তেমনটি হলে এপ্রিলে তা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। এতে বিদ্যুৎ খাতের চলমান সংকটের বিভিন্ন কারণ তুলে ধরা হয়েছে। আগামী বছর বিদ্যুতের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি কেমন হবে, তাও তুলে ধরা হয়। পাশাপাশি লোডশেডিং নিয়ন্ত্রণে বেশকিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা (আমদানিসহ) ২১ হাজার ৭১০ মেগাওয়াট। আগামী বছর ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি মাসেই তা বাড়বে। এতে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ২৫ হাজার ৫২৮ মেগাওয়াট। এর মধ্যে নিজস্ব সক্ষমতা দাঁড়াবে ২২ হাজার ৮৭২ মেগাওয়াট। আর আমদানির পরিমাণ দাঁড়াবে দুই হাজার ৬৫৬ মেগাওয়াট।

ওই সময় নিজস্ব সক্ষমতার মধ্যে জলবিদ্যুৎ ২৩০ মেগাওয়াট, নবায়নযোগ্য (সৌর ও বায়ু) ৪৬৭, গ্যাসচালিত ১০ হাজার ৭১৬, ফার্নেস অয়েলচালিত ছয় হাজার ২৪০, ডিজেলচালিত ৭৬৬ এবং কয়লাভিত্তিক চার হাজার ৪৫৬ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকবে। তবে এসব কেন্দ্র কতটা চালানো যাবে তা নির্ভর করবে গ্যাস ও ফার্নেস অয়েলের প্রাপ্যতার ওপর।

যদিও উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে বিদ্যুতের চাহিদা তুলনামূলক অনেক কমই থাকবে। প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, চলতি মাসে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট। আগামী মাসে তা দাঁড়াবে ১২ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। আর ডিসেম্বরে আরও কমে দাঁড়াবে ১১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে এ চাহিদা কিছুটা বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ১১ হাজার ৫০০ ও ১২ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। মার্চে এ চাহিদা অনেকটাই বেড়ে দাঁড়াবে ১৪ হাজার ১০০ মেগাওয়াট।

এপ্রিল ও মে মাসে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। সে সময় সর্বোচ্চ ১৬ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা থাকবে। তবে জুন থেকে কিছুটা করে কমতে থাকবে চাহিদা। এতে আগামী বছর অক্টোবরে বিদ্যুৎ চাহিদা কমে দাঁড়াবে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। আর নভেম্বর ও ডিসেম্বর তা আরও কমে যাবে। ওই দুই মাসে বিদ্যুতের চাহিদা দাঁড়াবে যথাক্রমে ১৩ হাজার ৮০০ ও ১২ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট।

প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের এপ্রিলে সর্বোচ্চ সম্ভাব্য বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে উৎপাদন পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, যদি গ্যাস ছাড়া অন্য কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হয়, তাহলে এপ্রিলে ৯ হাজার ২২৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। এর মধ্যে কয়লাচালিত কেন্দ্রগুলো থেকে পাওয়া যাবে দুই হাজার ৩৫০ মেগাওয়াট। সে সময় বড়পুকুরিয়া থেকে পাওয়া যাবে ২৫০ মেগাওয়াট, পায়রা থেকে এক হাজার ২০০, বরিশালের ৩০০ ও রামপাল থেকে আসবে ৬০০ মেগাওয়াট।

সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৪৬৭ মেগাওয়াট হলেও তা বিকাল ৫টার পর পাওয়া যাবে না। তাই সন্ধ্যায় পিক আওয়ারে এ সক্ষমতা কাজে লাগবে না। এছাড়া পানির গতিবেগ সন্ধ্যায় কমে আসায় পিক আওয়ারে পাওয়া যাবে ১০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ। আদানির একটি ইউনিট চালু হলে তা থেকে ৭২৫ মেগাওয়াট এবং ভারত থেকে নিয়মিত আমদানি হয় এক হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। মোট আমদানি বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে এক হাজার ৭৮৫ মেগাওয়াট।

ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার শর্ত বহাল থাকলে সেখান থেকে কোনো বিদ্যুৎ আসবে না গ্রিডে। আর ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় সঠিকভাবে তেল সরবরাহ করা হলে ও সক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার (প্ল্যান্ট ফ্যাক্টর ৮০ শতাংশ) হলে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে চার হাজার ৯৯২ মেগাওয়াট। যদিও ফার্নেস অয়েলের কেন্দ্রগুলো ৪০-৫০ শতাংশের বেশি চলে না। ফলে ওই খাতেও সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।

প্রতিবেদনের ভাষ্যমতে, সম্ভাব্য উৎপাদন চিত্র সঠিকভাবে ব্যবহার করা হলেও এপ্রিলে পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ ঘাটতি থেকে যাবে ছয় হাজার ৭৭৩ মেগাওয়াট। আর গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দৈনিক এক হাজার ৩০০ এমএমসিএফ গ্যাস দরকার হবে। তবে বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ করা হয় ৯০০ থেকে ৯৫০ এমএমসিএফ।

একই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে এপ্রিলে দৈনিক ৯০০ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ করা হলে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে চার হাজার ৬৮০ মেগাওয়াট। এতে প্রায় দুই হাজার ১০০ মেগাওয়াট ঘাটতি তৈরি হবে। এক হাজার এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহ করা হলে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে পাঁচ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। এতে প্রায় এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ঘাটতি তৈরি হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত আট মাস ধরে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি ছাড় বন্ধ রেখেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে ৩৩ হাজার ৮১২ কোটি টাকা ভর্তুকি বকেয়া পড়েছে। এজন্য বেসরকারি খাতের বিশেষত ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্রগুলোয় তেল সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে। এছাড়া ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো তেল আমদানিতে এলসি খুলতে চাচ্ছে না। এ নিয়েও বর্তমানে সংকটে পড়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। শিগগিরই তা কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা নেই।

এদিকে গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতিও নি¤œমুখী। সম্প্রতি জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছেন, ‘আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, আমরা জানি না সামনে কী হবে। এলএনজি এখন আমরা আনছি না। এ সময়ে ২৫ ডলার হিসাব ধরেও যদি এলএনজি আমদানি করতে যাই, চাহিদা মেটাতে অন্তত ছয় মাস কেনার মতো অবস্থা আছে কি নাÑজানি না। আমাদের এখন সাশ্রয়ী হওয়া ছাড়া উপায় নেই। প্রয়োজনে দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার বন্ধই করে দিতে হবে।’

পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, দৈনিক এক হাজার এমএমসিএফ এলএনজি আমদানির কথা থাকলেও বর্তমানে ৩৮০-৩৮৫ এমএমসিএফ সরবরাহ করা হচ্ছে। আর বিদ্যুৎ খাতে চাহিদা দৈনিক দুই হাজার ২৫২ এমএমসিএফ গ্যাস। কিন্তু সরবরাহ করা হয় ৯৫০-৯৮০ এমএমসিএফ। কোনো কোনো দিন তার চেয়েও কম। এর মধ্যে যদি এলএনজি আমদানি যদি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে আগামীতে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ ৭০০ এমএমসিএফে নেমে যেতে পারে। আর তা হলে গ্যাসচালিত কেন্দ্রগুলোয় আরও এক হাজার ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে। এতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। জ্বালানি উপদেষ্টার কথামতো আসলেই তখন দিনে বিদ্যুৎ সরবরাহ মোটামুটি বন্ধ করে দিতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পিডিবির একাধিক সদস্য শেয়ার বিজকে বলেন, গ্যাস ও তেল বর্তমান অনুপাতে সরবরাহ করা হলেও আগামী এপ্রিলে দৈনিক আড়াই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থাকবে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে প্রায় তিন হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং করতে হবে। যদিও চলতি মাসের শুরুর দিকে দুই দিন সর্বোচ্চ দুই হাজার ১০০ মেগাওয়াটের মতো ঘাটতি ছিল।

তারা আরও বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা নিয়মিত বাড়ছে। সক্ষমতা তার চেয়েও অধিক হারে বাড়ানো হয়েছে। বেশকিছু সঞ্চালন লাইন আগামী ডিসেম্বরে প্রস্তুত হয়ে যাবে। কয়লাচালিত কয়েকটি কেন্দ্রও আসছে উৎপাদনে। তবে প্রয়োজনীয় জ্বালানি ও ভর্তুকি না পাওয়া গেলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে লোডশেডিং দেয়া ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় থাকবে না।

নিউজের লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top