আইএমএফ থেকে ঋণ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১০ নভেম্বর ২০২২ ১৭:২৯; আপডেট: ৪ মে ২০২৪ ০২:৫২

ছবি: সংগৃহিত

বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকটে বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি বা সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণসহায়তা দিচ্ছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। প্রতিষ্ঠানটির চূড়ান্ত অনুমোদনের পর ঋণ হাতে পাবে বাংলাদেশ। খবর বণিক বার্তার।

আগামী তিন মাসের মধ্যে ঋণ প্রস্তাবের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার পর সংস্থাটির পর্ষদের চূড়ান্ত অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে আইএমএফ থেকে জানানো হয়েছে। আর পর্ষদের অনুমোদন পেলে সাত দফায় পুরো ঋণ ছাড় করতে সময় লাগবে ৪২ মাস।

আইএমএফ থেকে প্রত্যাশা অনুযায়ীই বাংলাদেশ ঋণ পাচ্ছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সংস্থাটির প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমরা যেভাবে চেয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই ঋণ পেতে যাচ্ছি। আগামী ফেব্রুয়ারি নাগাদ আইএমএফের ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় হবে।

অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, আইএমএফ তাদের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী তিন মাসের মধ্যে ঋণ প্রস্তাবের সব আনুষ্ঠানিকতা ও পর্ষদের চূড়ান্ত অনুমোদন সম্পন্ন করবে। ২০২৬ সাল পর্যন্ত চার বছর মেয়াদি মোট ঋণের পরিমাণ হবে ৪৫০ কোটি ডলার। মোট সাত কিস্তিতে ঋণ ছাড় করবে আইএমএফ। এর মধ্যে প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড় হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে। বাকি ঋণ প্রতি ছয় মাস অন্তর ছয়টি সমান কিস্তিতে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ পুরো অর্থ বুঝে পাবে। আইএমএফ ঋণের সুদহার হবে ফ্লোটিং বা পরিবর্তনশীল। পুরো ঋণের গড় সুদহার ২ দশমিক ২ শতাংশ হবে বলে মনে করছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এদিকে আইএমএফ থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশকে বর্ধিত ঋণ সুবিধা (ইসিএফ) ও বর্ধিত তহবিল সুবিধার (ইএফএফ) আওতায় ৩২০ কোটি ডলার এবং রেজিলিয়েন্স সাসটেইনেবিলিটি ফ্যাসিলিটির (আরএসএফ) আওতায় দেয়া হবে ১৩০ কোটি ডলার ঋণ।

এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। রফতানি ও রেমিট্যান্স আয়ের চেয়ে দেশের আমদানি ব্যয় অনেক বেশি হওয়ায় গত অর্থবছরে সরকারের চলতি হিসাবের পাশাপাশি ব্যালান্স অব পেমেন্টে রেকর্ড ঘাটতি তৈরি হয়। চলতি অর্থবছরে এ ঘাটতি আরো স্ফীত হচ্ছে। এ অবস্থায় সংকট মেটাতে আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা চেয়েছিল বাংলাদেশ। গত জুলাইয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আইএমএফকে ঋণের প্রস্তাব দেয়া হয়। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গত ২৬ অক্টোবর আইএমএফের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ১৫ দিনের সফরে বাংলাদেশ আসে। প্রতিনিধি দলটি বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ৩০টিরও বেশি বৈঠক করে। সফরের শেষ দিন গতকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে বৈঠকে বসে তারা। সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব ফাতিমা ইয়াসমিনও উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণসহায়তা বিষয়ে প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছে। আইএমএফ প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব দিয়েছেন সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ।

বৈঠক শেষে গতকাল সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী ও আইএমএফ প্রতিনিধি দল গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, সারা বিশ্বের অর্থনীতিই এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। উন্নত থেকে উন্নয়নশীল সব দেশে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে। প্রায় সব দেশের মুদ্রার মান ডলারের বিপরীতে কমে গিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কমেছে। বৈশ্বিক অর্থনীতির উত্তাপের আঁচ আমাদের অর্থনীতিতেও কিছুটা লেগেছে। এ অস্থিরতা যাতে কোনো ধরনের সংকটে ঘনীভূত না হয় তা নিশ্চিত করতেই আমরা আগাম সতর্কতা হিসেবে আইএমএফের ঋণের জন্য অনুরোধ করেছিলাম।

অর্থমন্ত্রী বলেন, আইএমএফের সঙ্গে এর আগে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। চলমান ঋণ আলোচনার পর্বটি আজ আমরা সফলভাবে শেষ করলাম। আমরা যেভাবে ঋণ চেয়েছিলাম, ঠিক সেভাবেই ঋণ পেতে যাচ্ছি। আইএমএফের সফররত দলটি বাংলাদেশ সরকারের সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আমাদের সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় ভালো বলে আমাদের তারা জানিয়েছেন। আইএমএফ টিম আমাদের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কারের সঙ্গেও একমত পোষণ করেছে। সে অনুযায়ী আমরা চার বছর মেয়াদি ঋণ কর্মসূচি নিতে যাচ্ছি।

চারটি লক্ষ্যপূরণে আইএমএফ থেকে ঋণ নেয়া হচ্ছে উল্লেখ করে অর্থমন্ত্রী বলেন, অর্থনীতির বহির্খাতকে স্থিতিশীল করা, ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণকে সামনে রেখে অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দেয়া, আর্থিক খাতকে শক্তিশালী করা, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলা করে উচ্চপ্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া।

সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কার কার্যক্রম পরিচালনা করছে দাবি করে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারের বাজেট ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রাখা হবে, যা গত প্রায় ১৪ বছর ধরে আমরা করে আসছি। আমাদের সরকারের সবসময় প্রচেষ্টা থাকে বাজেট ঘাটতিকে জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা। গত বছর আমাদের বাজেট ঘাটতি ছিল ৫ দশমিক ১ শতাংশ, যা চলতি অর্থবছরে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ধরা আছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তার মতো সামাজিক খাতে সরকারের ব্যয় বৃদ্ধি করা, যা আমরা প্রতি অর্থবছরে ক্রমান্বয়ে বাড়াচ্ছি। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে চলতি অর্থবছরে আমাদের বরাদ্দ রয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের প্রায় ১৭ শতাংশ।

অর্থমন্ত্রী বলেন, আর্থিক খাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নতুন কয়েকটি আইন প্রণয়ন এবং পুরনো কয়েকটি আইনের সংশোধনের চলমান কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার জোরদার এবং কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানোর মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়ানো হবে। ভ্যাট আদায়ের জন্য আমরা ইএফডি মেশিন স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছি। জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয়ের ব্যবস্থাটি আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সময়ে সময়ে সমন্বয় করা, যাতে মূল্য কমলে দেশের ভেতরেও তা একইভাবে কমানো যায়। টাকার বিনিময় হার নির্ধারণের কাজটি ধীরে ধীরে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হবে। এরই মধ্যে আমরা এটি শুরু করেছি। সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির বিষয়টিকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে।

আইএমএফ প্রতিনিধি দলের প্রধান রাহুল আনন্দ সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, কভিডের প্রাদুর্ভাব থেকে পুনরুদ্ধার পর্বে বৈশ্বিকভাবে পণ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে। বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর দেশ। এ দেশকে খাদ্য, সার, জ্বালানি আমদানি করতে হয়। তাই আমদানির বিপরীতে অর্থ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এটি বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ এবং টাকার ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে। বিশ্ব অর্থনীতি এখন নিম্নমুখী। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এ পরিস্থিতি বাংলাদেশের প্রধান রফতানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বিরাজ করছে। আমাদের অনুমান এর ফলে বাংলাদেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টে চাপ অব্যাহত থাকবে। এসবই ছিল আইএমএফের কাছে বাংলাদেশের ঋণ অনুরোধের প্রেক্ষাপট। রাহুল আনন্দ আরো বলেন, বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে যে ঋণ চেয়েছে, সেটি দিতে আমরা কর্মকর্তা পর্যায়ে সমঝোতায় পৌঁছেছি। আইএমএফ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সমর্থন এবং নির্বাহী পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে এটি চূড়ান্ত হবে।

বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক নীতির বিষয়ে আইএমএফের সহায়তা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রাহুল আনন্দ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলার জন্য সরকারকে রাজস্ব আহরণে জোর দিতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এ খাতে সংস্কার জরুরি। রিজার্ভ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে রাহুল আনন্দ বলেন, বাংলাদেশে এখন যে রিজার্ভ আছে তা দিয়ে সাড়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে। রিজার্ভ বাড়বে না কমবে তা নির্ভর করবে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর। কেননা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি কোনদিকে যাবে তা কেউ বলতে পারছে না। তবে আমরা মনে করি, যেসব সংস্কার কর্মসূচি নেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতি স্থিতিশীল হবে এবং রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক অবস্থানে আসবে।

আগামী জাতীয় নির্বাচন সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে রাহুল আনন্দ বলেন, বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন নিয়ে আমরা মোটেই উদ্বিগ্ন নই। আর্থিক খাতের সংস্কার কর্মসূচিকে আইএমএফ সবসময়ই গুরুত্ব দেয়, এবারো দেয়া হয়েছে। নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের কোনো সম্পর্ক নেই। আইএমএফ বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ উন্নয়ন-সহযোগী। দীর্ঘ বছর ধরে এ দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রয়েছে। আশা করি আগামীতেও এ সম্পর্ক অব্যাহত থাকবে।

এদিকে আইএমএফ থেকে নেয়া ঋণের গ্রেস পিরিয়ড ও পরিশোধের মেয়াদ সম্পর্কে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইসিএফ হিসেবে যে ঋণ পাওয়া যাবে, সেটির সাড়ে ৫ বছর গ্রেস পিরিয়ড। এরপর ১০ বছরে তা শোধ করতে হবে। ইএফএফে গ্রেস পিরিয়ড সাড়ে তিন বছর, সেটিও পরিশোধ করতে হবে ১০ বছরে। আরএসএফে ১০ বছরের গ্রেড পিরিয়ড, যা ২০ বছরে শোধ করতে হবে।

আর্থিক খাতের সংস্কার প্রসঙ্গে গভর্নর বলেন, এ মুহূর্তে আমাদের খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে। আইএমএফও বলেছে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের নিচে থাকতে হবে। এক্ষেত্রে নতুন কোনো শর্ত আসেনি। তবে ব্যাংকগুলোর ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসি রেশিও ব্যাসেল-৩-এর ওপরে নিয়ে যেতে বলেছে তারা। আমাদের ৬১টি ব্যাংক, এর মধ্যে ৮-১০টি ব্যাংকের এটি নেই। আমরা ওই ব্যাংকগুলোর ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসি রেশিও বাড়াব। রিজার্ভের বিষয়ে গভর্নর বলেন, আমরা রিজার্ভের পরিমাণ গ্রস দেখাই। আইএমএফ আমাদের নিট দেখাতে বলেছে। আজকে আমাদের গ্রস রিজার্ভ হলো ৩৪ দশমিক ৩ বিলিয়ন। এখান থেকে ইডিএফ ও আরো কয়েকটা ফান্ডে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আছে। সেটা বাদ দিলে নিট রিজার্ভ বের হয়ে যাবে।

বণিক বার্তার প্রতিবেদনটির লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top