অতিরিক্ত প্রকল্পই কি সংকট ঘনীভূত করছে?

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৫ নভেম্বর ২০২২ ২০:৪৪; আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০২২ ২০:৪৫

ছবি: সংগৃহিত

২০১৮-১৯ অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্প বেড়েছে প্রায় চারগুণ। অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ ও অতিরিক্ত প্রকল্প অনুমোদনে দেশের সংকট সৃষ্টি হয়েছে কি না সে প্রশ্ন তুলেছেন অর্থনীতিবিদরা। খবর বণিক বার্তার।

,২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অধীন উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা এক ধাক্কায় ২৩৬টি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৭৬টিতে। একই সঙ্গে ব্যয়ও প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৬ কোটি টাকায়। উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয়ের এ প্রবণতা বজায় ছিল পরের দুই অর্থবছরেও। এখন পর্যন্ত এডিপির অধীনে এ তিন অর্থবছরেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরেও উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারের বরাদ্দ ঠেকেছে ২ লাখ ১২ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকায়। পর্যাপ্ত রাজস্ব আয় না বাড়িয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধির এ প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টির পেছনে বড় অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে কিনা, সে বিষয়ে এখন প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদরা।

গত এক দশকে দেশে ব্যাপক মাত্রায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় দেশে একের পর এক ছোট থেকে শুরু করে মেগা অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে এডিপির অধীন উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যায় বড় উল্লম্ফন ঘটে। ওই অর্থবছর প্রকল্প সংখ্যা প্রথমবারের মতো ১ হাজার ৯০০ ছাড়িয়ে যায়, যা বজায় ছিল ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত।

ওই তিন অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ প্রকল্প অনুমোদন এবং এ বাবদ ব্যয় বৃদ্ধিই দেশের বর্তমান আর্থিক সংকটকে ঘনীভূত করেছে কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সময় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে মানেই সরকারি ব্যয় ও কেনাকাটা বেড়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে আমদানি চাপও। সব মিলিয়ে এ তিন অর্থবছরে সরকারের ব্যয়ের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে এডিপির অধীন প্রকল্প ছিল ১ হাজার ১৮৩টি। ওই অর্থবছরে প্রকল্পগুলোর পেছনে সরকারের ব্যয় হয় ২৫ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় প্রতি অর্থবছরেই প্রকল্পের সংখ্যা ও ব্যয় দুটিই বেড়েছে। এডিপির অধীনে সবচেয়ে বেশি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন ছিল ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত তিন অর্থবছরে। এর মধ্যে ব্যয়ের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। এ সময় ১ হাজার ৯৫৪টি প্রকল্পের বিপরীতে মোট ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৬ কোটি (প্রকল্প সংখ্যা ১ হাজার ৯৭৬) ও ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা (প্রকল্প সংখ্যা ১ হাজার ৯০৮)।

এছাড়া প্রকল্প ব্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন দেখা যায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ওই সময়ে এক অর্থবছরেই ৪১ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয় উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয়। আর প্রকল্প সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করা হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ওই বছর এক লাফে এডিপির অধীন উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে যায় ২৩৬টি।

আলোচিত সময়ে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, কয়লাভিত্তিক বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে শুরু করে দেশের ছোটখাটো নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতিও আমদানি করতে হয়েছে। আবার রড, সিমেন্ট, পাথরের মতো অবকাঠামো নির্মাণ উপকরণ দেশে উৎপাদন হলেও এগুলোর কাঁচামাল আনতে হয়েছে বিদেশ থেকে। উন্নয়ন প্রকল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি, নির্মাণ উপকরণ আমদানি থেকে শুরু করে বিদেশী শ্রমিকের পারিশ্রমিক পরিশোধে ব্যয় হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা। রেমিট্যান্স, রফতানি আয় ও বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের চেয়েও ডলারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টে (বিওপি) বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আবার অনেক বড় প্রকল্প আর্থিকভাবে লাভজনক না হওয়ারও নজির রয়েছে।

বেসরকারি খাতের অস্বাভাবিক আমদানির চাপ, অর্থ পাচারের পাশাপাশি সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পদ্মা সেতু দিয়ে রেল সংযোগে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ টাকা খরচ করে পায়রা বন্দর ও যশোর পর্যন্ত যে রেললাইন নেয়া হচ্ছে, সেটি লাভজনক না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তেমনিভাবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার নির্মীয়মান রেললাইন প্রকল্পও লাভজনকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। একইভাবে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের মুনাফাযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এটি থেকেও খুব বেশি মানুষের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা কম।

এ ধরনের প্রকল্পগুলোকে ‘শ্বেতহস্তী’ আখ্যা দিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, অনেকগুলো প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যেগুলোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। নীতিনির্ধারক পর্যায়ের খামখেয়ালিপনার কারণে সেগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। এখন যে ডলার সংকট, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, আমদানি-রফতানির মধ্যে বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি হওয়ার মতো সমস্যা তৈরি হয়েছে; এগুলো আগামী বছরগুলোয় যদি ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। এক বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলার কমেছে। ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সেখান থেকে কমে এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছে। এক বছরে ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের পতন, এটি বড় ধরনের একটা বিপদ; যা এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছে। এ ধারা বন্ধ করতে না পারলে আগামী এক বছরে সাংঘাতিক সংকটে পড়ে যাবে অর্থনীতি।

সরকারের মেগা প্রকল্প বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের মোট ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ ছিল ৫৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে আমদানির নতুন এলসি খোলা কিছুটা কমে যায়। এর পরও অর্থবছরটিতে ৫৩ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের নতুন এলসি খোলা হয়েছিল। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আমদানির এলসি খোলা হয়েছে গত দুই অর্থবছরে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ৬৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানির নতুন এলসি খোলার পরিমাণ দাঁড়ায় ৯২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। ইতিহাস সৃষ্টি করা আমদানির নতুন এ এলসিই দেশের অর্থনীতির বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে।

সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণ রড, সিমেন্ট, পাথরসহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণের প্রয়োজন হচ্ছে। বেশির ভাগ নির্মাণ উপকরণ দেশে তৈরি হলেও এর কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি করতে হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মূলধনি যন্ত্রপাতিও। উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে আমদানি বেড়েছে বিলাসবহুল গাড়ির। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো নির্মাণে কাজ করছেন কয়েক লাখ বিদেশী শ্রমিক ও পরামর্শক। এসব শ্রমিক ও পরামর্শকের পারিশ্রমিকও ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরেই সিমেন্ট, ক্লিংকার, বিপি শিট, টিন প্লেট, লোহাসহ ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালসহ মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমিডিয়েট গুডস) আমদানির ৭ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমদানির এলসি খোলার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ শতাংশেরও বেশি। আর শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতির নতুন এলসি খোলা হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের। রেকর্ড পরিমাণ নির্মাণ উপকরণ ও যন্ত্রপাতি আমদানির প্রভাব পড়েছে সরকারের চলতি হিসাব ও বিওপির ওপর। গত অর্থবছরে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ দুই নির্দেশকে রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

গত অর্থবছর শেষে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছাড়ায় ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায় সরকারের চলতি হিসাবের ঘটতি। সব মিলিয়ে বিওপি ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে গত অর্থবছর শেষ হয়। নতুন এলসি খোলা কিছুটা কমে এলেও চলতি অর্থবছরে এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে। এ কারণে গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাণিজ্য ঘাটতি, চলতি হিসাবে ঘাটতি ও বিওপির ঘাটতি আরো বড় হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৭৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৭৫৪ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৫৪ কোটি ডলার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এ ঘাটতি ৩৬১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই বিওপির ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৩৪৪ কোটি ডলার। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি মাত্র ৮১ কোটি ডলারে সীমাবদ্ধ ছিল।

অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় অক্টোবরে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। অক্টোবরে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় উভয়ই ৭ শতাংশের বেশি হারে কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান দুই উৎসেই পতন হওয়ায় বিওপির ঘাটতি স্ফীত হয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করতে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরে প্রথম চার মাসেই (জুলাই-অক্টোবর) রিজার্ভ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ৩৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যদিও গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। আর এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় হার ৮৫ থেকে বেড়ে ১০৫ টাকায় ঠেকেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পের সংখ্যা যা-ই হোক, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা। বাস্তবতা হলো সরকারি সংস্থা আইএমইডি, যাদের অনেক বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে চলতে হয়; তাদের মূল্যায়নেই প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের নানামুখী সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়। দেখা গিয়েছে, সময়ের পরিক্রমায় প্রকল্প বাস্তবায়ন সক্ষমতা অনেকটাই কমে গিয়েছে। সুষ্ঠুভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের জনবলসহ অন্যান্য যে সক্ষমতা দরকার, সেই সক্ষমতা বাড়ছে না, বরং আরো কমছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সক্ষমতা বাড়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সক্ষমতার এ নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যেই ঠিকই প্রকল্প সংখ্যা বাড়ছে। এতে প্রকল্পগুলো বিভিন্নভাবে সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হয় না, ব্যয় বাড়ে, সময় বাড়ে। আবার বাস্তবায়ন হলেও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না। এতে অর্থের অপচয় ঘটে। প্রকল্প থেকে যে সুবিধা আশা করা হয়, তা পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন সক্ষমতা না বাড়িয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হলে তা অর্থ অপব্যয়ের উৎসে পরিণত হয়। এখন সরকারের অপব্যয়টা প্রচণ্ডভাবে ঘটছে। প্রকল্প সংখ্যা বাড়ে রাজনৈতিকভাবে প্রকল্পগুলো অন্তর্ভুক্ত করার কারণে। রাজনৈতিক নেতা থেকে আরম্ভ করে সংশ্লিষ্ট সবারই দু-একটা চাহিদা থাকে প্রকল্প গ্রহণের। কিন্তু এতে অপব্যয় বাড়ে। ছোট থেকে শুরু করে মেগা, সব প্রকল্পেই এ প্রবণতা আছে। আবার প্রকল্পের অর্থ নিয়ে নয়ছয়ের প্রবণতও আছে। আমাদের সম্পদ যদি আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার না করি, তাহলে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়বেই। এ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে, সরকারি রাজস্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সব কিছুই ঘটে। এ সবকিছু মিলিয়েই অর্থনীতির সংকট ঘনীভূত হয়। আজকে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা আসলে একটা পরিণতি। দীর্ঘদিনের চর্চা এখন সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি বণিক বার্তাকে বলেন, যেটিকে ‘কিক বা জাম্প স্টার্ট’ বলা হয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সেটিই ছিল সরকারের কৌশল। এটি ভুল কিছু নয়। অনেক দেশই এ ধরনের কৌশল গ্রহণ করে। কোরিয়া, তাইওয়ান বা মাহাথির মোহাম্মদের সময় মালয়েশিয়াও কিক স্টার্ট কৌশল গ্রহণ করেছিল। আমাদের অর্থনীতি একটা স্থবিরতার মধ্যে ছিল। সরকার শুরুতে কিক স্টার্ট করেছে। ফলও পাওয়া গিয়েছে ভালো। ধ্রুপদি অর্থনীতি যারা পড়ান, তারা অনেক সময় একমত হন না। কিন্তু ফলেই পরিচয়। আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে উচ্চহারে। রেমিট্যান্সও এসেছিল ভালো পরিমাণে। কেউ জানত না যে কভিড আর ইউক্রেন আসবে। মানসিকভাবে ফুরফুরে ভাব ছিল। পেছনের দিকে তাকালে অনেক কিছুই বিচার বিবেচনা করা যায়। কিন্তু তখন কৌশল অনুযায়ী যা দরকার ছিল, তা-ই করা হয়েছে। শুরু থেকে সরকারের লক্ষ্য ছিল বড় প্রকল্প হাতে নেয়া, যার মধ্যে অন্যতম অবকাঠামো প্রকল্প। এক্ষেত্রে সরকার আগ্রাসীভাবে প্রকল্পে হাত দিয়েছে, যার ফলও পেয়েছে। পদ্মা সেতু করা গিয়েছে, এর ফল আমরা পাব। সারা দেশেই উন্নয়ন প্রকল্প ছড়িয়ে গিয়েছে। এগুলোর ফল অবশ্যই আসবে। বিশ্লেষণ করলে অনেক কিছুই বলা যাবে। কিন্তু সার্বিক ফলটা দেখতে হবে। আমরা যারা সরকারে আছি, তারা গোটা ফল দেখি। মাথাপিছু আয় দেখি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখি। ঋণ-জিডিপি অনুপাত দেখি। এ সবকিছু দেখেই আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া যেতে পারে। সেগুলো আমরা নিজেরাও বিবেচনা করি। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা বড় প্রকল্প কম নিচ্ছি। সরকারপ্রধান বলেছেন এখন আপাতত বড় প্রকল্পের দিকে না যেতে। আমার বিশ্বাস, আগামী চার-পাঁচ মাস কৃচ্ছ্রতার মধ্যে থাকলে বর্তমান সংকট আমরা পার হতে পারব।


২০১৮-১৯ অর্থবছরে উন্নয়ন প্রকল্প বেড়েছে প্রায় চারগুণ। অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ ও অতিরিক্ত প্রকল্প অনুমোদন করানোইে দেশের সংকট সৃষ্টি হয়েছে কি না সে প্রশ্ন তুলেছেন আইনজীবীরা। খবর টিবিএসের


,২০১৮-১৯ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) অধীন উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা এক ধাক্কায় ২৩৬টি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৭৬টিতে। একই সঙ্গে ব্যয়ও প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৬ কোটি টাকায়। উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয়ের এ প্রবণতা বজায় ছিল পরের দুই অর্থবছরেও। এখন পর্যন্ত এডিপির অধীনে এ তিন অর্থবছরেই প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরেও উন্নয়ন প্রকল্পে সরকারের বরাদ্দ ঠেকেছে ২ লাখ ১২ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকায়। পর্যাপ্ত রাজস্ব আয় না বাড়িয়ে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বৃদ্ধির এ প্রবণতা দেশের অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টির পেছনে বড় অনুঘটক হিসেবে ভূমিকা রেখেছে কিনা, সে বিষয়ে এখন প্রশ্ন তুলছেন অর্থনীতিবিদরা।

গত এক দশকে দেশে ব্যাপক মাত্রায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় দেশে একের পর এক ছোট থেকে শুরু করে মেগা অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে এডিপির অধীন উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যায় বড় উল্লম্ফন ঘটে। ওই অর্থবছর প্রকল্প সংখ্যা প্রথমবারের মতো ১ হাজার ৯০০ ছাড়িয়ে যায়, যা বজায় ছিল ২০২০-২১ অর্থবছর পর্যন্ত।

ওই তিন অর্থবছরে বিপুল পরিমাণ প্রকল্প অনুমোদন এবং এ বাবদ ব্যয় বৃদ্ধিই দেশের বর্তমান আর্থিক সংকটকে ঘনীভূত করেছে কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সময় নতুন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে মানেই সরকারি ব্যয় ও কেনাকাটা বেড়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে আমদানি চাপও। সব মিলিয়ে এ তিন অর্থবছরে সরকারের ব্যয়ের ওপর বড় ধরনের চাপ পড়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে এডিপির অধীন প্রকল্প ছিল ১ হাজার ১৮৩টি। ওই অর্থবছরে প্রকল্পগুলোর পেছনে সরকারের ব্যয় হয় ২৫ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় প্রতি অর্থবছরেই প্রকল্পের সংখ্যা ও ব্যয় দুটিই বেড়েছে। এডিপির অধীনে সবচেয়ে বেশি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন ছিল ২০১৮-১৯ থেকে ২০২০-২১ পর্যন্ত তিন অর্থবছরে। এর মধ্যে ব্যয়ের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি ছিল ২০২০-২১ অর্থবছরে। এ সময় ১ হাজার ৯৫৪টি প্রকল্পের বিপরীতে মোট ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। এছাড়া ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ব্যয় হয়েছে যথাক্রমে ১ লাখ ৬৭ হাজার ১৮৬ কোটি (প্রকল্প সংখ্যা ১ হাজার ৯৭৬) ও ১ লাখ ৬১ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা (প্রকল্প সংখ্যা ১ হাজার ৯০৮)।

এছাড়া প্রকল্প ব্যয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় উল্লম্ফন দেখা যায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। ওই সময়ে এক অর্থবছরেই ৪১ হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয় উন্নয়ন কর্মসূচির ব্যয়। আর প্রকল্প সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করা হয়েছে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। ওই বছর এক লাফে এডিপির অধীন উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা বেড়ে যায় ২৩৬টি।

আলোচিত সময়ে পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, কয়লাভিত্তিক বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ থেকে শুরু করে দেশের ছোটখাটো নানা উন্নয়ন প্রকল্পের কাঁচামাল ও মূলধনি যন্ত্রপাতিও আমদানি করতে হয়েছে। আবার রড, সিমেন্ট, পাথরের মতো অবকাঠামো নির্মাণ উপকরণ দেশে উৎপাদন হলেও এগুলোর কাঁচামাল আনতে হয়েছে বিদেশ থেকে। উন্নয়ন প্রকল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি, নির্মাণ উপকরণ আমদানি থেকে শুরু করে বিদেশী শ্রমিকের পারিশ্রমিক পরিশোধে ব্যয় হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা। রেমিট্যান্স, রফতানি আয় ও বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের চেয়েও ডলারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টে (বিওপি) বড় ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আবার অনেক বড় প্রকল্প আর্থিকভাবে লাভজনক না হওয়ারও নজির রয়েছে।

বেসরকারি খাতের অস্বাভাবিক আমদানির চাপ, অর্থ পাচারের পাশাপাশি সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্ষয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পদ্মা সেতু দিয়ে রেল সংযোগে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ টাকা খরচ করে পায়রা বন্দর ও যশোর পর্যন্ত যে রেললাইন নেয়া হচ্ছে, সেটি লাভজনক না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তেমনিভাবে চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার নির্মীয়মান রেললাইন প্রকল্পও লাভজনকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হবে না। একইভাবে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের মুনাফাযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এটি থেকেও খুব বেশি মানুষের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা কম।

এ ধরনের প্রকল্পগুলোকে ‘শ্বেতহস্তী’ আখ্যা দিয়ে অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, অনেকগুলো প্রকল্প নেয়া হয়েছে, যেগুলোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। নীতিনির্ধারক পর্যায়ের খামখেয়ালিপনার কারণে সেগুলো গ্রহণ করা হয়েছে। এখন যে ডলার সংকট, বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যাওয়া, আমদানি-রফতানির মধ্যে বিশাল পার্থক্য সৃষ্টি হওয়ার মতো সমস্যা তৈরি হয়েছে; এগুলো আগামী বছরগুলোয় যদি ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। এক বছরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলার কমেছে। ২০২১ সালের আগস্টে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার, সেখান থেকে কমে এখন ২৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছে। এক বছরে ২২ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভের পতন, এটি বড় ধরনের একটা বিপদ; যা এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছে। এ ধারা বন্ধ করতে না পারলে আগামী এক বছরে সাংঘাতিক সংকটে পড়ে যাবে অর্থনীতি।

সরকারের মেগা প্রকল্প বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশের আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশের মোট ঋণপত্র (এলসি) খোলার পরিমাণ ছিল ৫৮ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নভেল করোনাভাইরাসের প্রভাবে আমদানির নতুন এলসি খোলা কিছুটা কমে যায়। এর পরও অর্থবছরটিতে ৫৩ দশমিক ১২ বিলিয়ন ডলারের নতুন এলসি খোলা হয়েছিল। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ আমদানির এলসি খোলা হয়েছে গত দুই অর্থবছরে। এর মধ্যে ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানির এলসি খোলার পরিমাণ ৬৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। আর সর্বশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানির নতুন এলসি খোলার পরিমাণ দাঁড়ায় ৯২ দশমিক ২৩ বিলিয়ন ডলার। ইতিহাস সৃষ্টি করা আমদানির নতুন এ এলসিই দেশের অর্থনীতির বড় বিপদের কারণ হয়ে উঠেছে।

সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বিপুল পরিমাণ রড, সিমেন্ট, পাথরসহ বিভিন্ন ধরনের উপকরণের প্রয়োজন হচ্ছে। বেশির ভাগ নির্মাণ উপকরণ দেশে তৈরি হলেও এর কাঁচামাল আমদানি করতে হচ্ছে। অন্যদিকে আমদানি করতে হচ্ছে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর মূলধনি যন্ত্রপাতিও। উন্নয়ন প্রকল্পকে ঘিরে আমদানি বেড়েছে বিলাসবহুল গাড়ির। সরকারের মেগা প্রকল্পগুলো নির্মাণে কাজ করছেন কয়েক লাখ বিদেশী শ্রমিক ও পরামর্শক। এসব শ্রমিক ও পরামর্শকের পারিশ্রমিকও ডলারে পরিশোধ করতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরেই সিমেন্ট, ক্লিংকার, বিপি শিট, টিন প্লেট, লোহাসহ ইস্পাত শিল্পের কাঁচামালসহ মধ্যবর্তী পণ্য (ইন্টারমিডিয়েট গুডস) আমদানির ৭ দশমিক ৮৮ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমদানির এলসি খোলার প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৮ শতাংশেরও বেশি। আর শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতির নতুন এলসি খোলা হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলারের। রেকর্ড পরিমাণ নির্মাণ উপকরণ ও যন্ত্রপাতি আমদানির প্রভাব পড়েছে সরকারের চলতি হিসাব ও বিওপির ওপর। গত অর্থবছরে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ দুই নির্দেশকে রেকর্ড পরিমাণ ঘাটতি তৈরি হয়েছে।

গত অর্থবছর শেষে দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছাড়ায় ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার। ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার ছাড়ায় সরকারের চলতি হিসাবের ঘটতি। সব মিলিয়ে বিওপি ৫ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে গত অর্থবছর শেষ হয়। নতুন এলসি খোলা কিছুটা কমে এলেও চলতি অর্থবছরে এলসি নিষ্পত্তি বেড়েছে। এ কারণে গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাণিজ্য ঘাটতি, চলতি হিসাবে ঘাটতি ও বিওপির ঘাটতি আরো বড় হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৬৭৭ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৭৫৪ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৫৪ কোটি ডলার। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এ ঘাটতি ৩৬১ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেই বিওপির ঘাটতি ছাড়িয়েছে ৩৪৪ কোটি ডলার। যদিও গত অর্থবছরের একই সময়ে এ ঘাটতি মাত্র ৮১ কোটি ডলারে সীমাবদ্ধ ছিল।

অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় অক্টোবরে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। অক্টোবরে রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় উভয়ই ৭ শতাংশের বেশি হারে কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রার প্রধান দুই উৎসেই পতন হওয়ায় বিওপির ঘাটতি স্ফীত হয়েছে। এ ঘাটতি পূরণ করতে প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এরই মধ্যে চলতি অর্থবছরে প্রথম চার মাসেই (জুলাই-অক্টোবর) রিজার্ভ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ৩৪ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যদিও গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছিল। আর এক বছরের ব্যবধানে ডলারের বিনিময় হার ৮৫ থেকে বেড়ে ১০৫ টাকায় ঠেকেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পের সংখ্যা যা-ই হোক, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে প্রকল্প বাস্তবায়নের সক্ষমতা। বাস্তবতা হলো সরকারি সংস্থা আইএমইডি, যাদের অনেক বাধ্যবাধকতার মধ্য দিয়ে চলতে হয়; তাদের মূল্যায়নেই প্রকল্প সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়নের নানামুখী সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়। দেখা গিয়েছে, সময়ের পরিক্রমায় প্রকল্প বাস্তবায়ন সক্ষমতা অনেকটাই কমে গিয়েছে। সুষ্ঠুভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নের জনবলসহ অন্যান্য যে সক্ষমতা দরকার, সেই সক্ষমতা বাড়ছে না, বরং আরো কমছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো সক্ষমতা বাড়ার কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। সক্ষমতার এ নিম্নমুখী প্রবণতার মধ্যেই ঠিকই প্রকল্প সংখ্যা বাড়ছে। এতে প্রকল্পগুলো বিভিন্নভাবে সুষ্ঠু বাস্তবায়ন হয় না, ব্যয় বাড়ে, সময় বাড়ে। আবার বাস্তবায়ন হলেও সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হয় না। এতে অর্থের অপচয় ঘটে। প্রকল্প থেকে যে সুবিধা আশা করা হয়, তা পাওয়া যায় না।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বণিক বার্তাকে বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন সক্ষমতা না বাড়িয়ে প্রকল্প গ্রহণ করা হলে তা অর্থ অপব্যয়ের উৎসে পরিণত হয়। এখন সরকারের অপব্যয়টা প্রচণ্ডভাবে ঘটছে। প্রকল্প সংখ্যা বাড়ে রাজনৈতিকভাবে প্রকল্পগুলো অন্তর্ভুক্ত করার কারণে। রাজনৈতিক নেতা থেকে আরম্ভ করে সংশ্লিষ্ট সবারই দু-একটা চাহিদা থাকে প্রকল্প গ্রহণের। কিন্তু এতে অপব্যয় বাড়ে। ছোট থেকে শুরু করে মেগা, সব প্রকল্পেই এ প্রবণতা আছে। আবার প্রকল্পের অর্থ নিয়ে নয়ছয়ের প্রবণতও আছে। আমাদের সম্পদ যদি আমরা সঠিকভাবে ব্যবহার না করি, তাহলে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়বেই। এ পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে, সরকারি রাজস্বের ওপর চাপ সৃষ্টি করে। সব কিছুই ঘটে। এ সবকিছু মিলিয়েই অর্থনীতির সংকট ঘনীভূত হয়। আজকে যে সংকট দেখা দিয়েছে, তা আসলে একটা পরিণতি। দীর্ঘদিনের চর্চা এখন সংকটকে আরো ঘনীভূত করেছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান এমপি বণিক বার্তাকে বলেন, যেটিকে ‘কিক বা জাম্প স্টার্ট’ বলা হয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নে সেটিই ছিল সরকারের কৌশল। এটি ভুল কিছু নয়। অনেক দেশই এ ধরনের কৌশল গ্রহণ করে। কোরিয়া, তাইওয়ান বা মাহাথির মোহাম্মদের সময় মালয়েশিয়াও কিক স্টার্ট কৌশল গ্রহণ করেছিল। আমাদের অর্থনীতি একটা স্থবিরতার মধ্যে ছিল। সরকার শুরুতে কিক স্টার্ট করেছে। ফলও পাওয়া গিয়েছে ভালো। ধ্রুপদি অর্থনীতি যারা পড়ান, তারা অনেক সময় একমত হন না। কিন্তু ফলেই পরিচয়। আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে উচ্চহারে। রেমিট্যান্সও এসেছিল ভালো পরিমাণে। কেউ জানত না যে কভিড আর ইউক্রেন আসবে। মানসিকভাবে ফুরফুরে ভাব ছিল। পেছনের দিকে তাকালে অনেক কিছুই বিচার বিবেচনা করা যায়। কিন্তু তখন কৌশল অনুযায়ী যা দরকার ছিল, তা-ই করা হয়েছে। শুরু থেকে সরকারের লক্ষ্য ছিল বড় প্রকল্প হাতে নেয়া, যার মধ্যে অন্যতম অবকাঠামো প্রকল্প। এক্ষেত্রে সরকার আগ্রাসীভাবে প্রকল্পে হাত দিয়েছে, যার ফলও পেয়েছে। পদ্মা সেতু করা গিয়েছে, এর ফল আমরা পাব। সারা দেশেই উন্নয়ন প্রকল্প ছড়িয়ে গিয়েছে। এগুলোর ফল অবশ্যই আসবে। বিশ্লেষণ করলে অনেক কিছুই বলা যাবে। কিন্তু সার্বিক ফলটা দেখতে হবে। আমরা যারা সরকারে আছি, তারা গোটা ফল দেখি। মাথাপিছু আয় দেখি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখি। ঋণ-জিডিপি অনুপাত দেখি। এ সবকিছু দেখেই আমরা বিচার-বিশ্লেষণ করি। তাত্ত্বিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া যেতে পারে। সেগুলো আমরা নিজেরাও বিবেচনা করি। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা বড় প্রকল্প কম নিচ্ছি। সরকারপ্রধান বলেছেন এখন আপাতত বড় প্রকল্পের দিকে না যেতে। আমার বিশ্বাস, আগামী চার-পাঁচ মাস কৃচ্ছ্রতার মধ্যে থাকলে বর্তমান সংকট আমরা পার হতে পারব।

বণিক বার্তার প্রতিবেদনটির লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top