গত অর্থবছরে যন্ত্রপাতি আমদানিতে চারগুণ ব্যয়

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১৯:০৫; আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:২৬

ছবি: সংগৃহিত

প্রতিবছর যন্ত্রপাতি আমদানিতে ব্যয়ের চারগুণ ব্যয় হয়েছে গত অর্থবছরে (২০২১-২২)। সংশ্লিষ্টরা এর পেছনে পুরনো ঋণপত্রের (এলসি) বিলম্বিত অর্থ পরিশোধ ও যন্ত্রপাতির মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করলেও অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা দেখছেন ভিন্নভাবে। খবর যুগান্তরের।

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা বলছেন, শুধু এ দুটি বিষয় দিয়ে মূলধনি যন্ত্রের আমদানি ব্যয়ে এত বড় উল্লম্ফনকে কোনোভাবেই যৌক্তিকতা দেয়া যায় না। ওভার ইনভয়েসিংয়ের (আমদানি ব্যয় বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা) মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে বলে সন্দেহ করছেন তারা। একই সঙ্গে এ বিষয়ে বাণিজ্যিক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা বলছেন, সংস্থাগুলোর এখনই এ বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন, যাতে সামনের দিনগুলোয় আর এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে গত অর্থবছরে দেশে মূলধনি যন্ত্রপাতিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৩ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৩২ কোটি ৯০ লাখ ডলার, যেখানে আগের অর্থবছরেও (২০২০-২১) বাংলাদেশের আমদানিকারকরা এ বাবদ ব্যয় করেছিলেন ৩০৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার। সে হিসেবে গত অর্থবছরে মূলধনি যন্ত্র আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে ৩৩৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। এর আগে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে সর্বোচ্চ ব্যয় হয়েছিল কভিডের আগে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে। সে সময়ও মূলধনি আমদানি সীমিত ছিল সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে।

মূলধনি পণ্য আমদানি এক বছরের ব্যবধানে এভাবে বেড়ে যাওয়ার বিষয়টিকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যায় না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ‘সন্দেহাতীতভাবে উদ্বেগজনক’ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন ব্যাংকাররাও। তাদের ভাষ্যমতে, এ এক অর্থবছরে দেশের বেসরকারি খাতের ঋণ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ। কিন্তু একই সময়ে মূলধনি যন্ত্র আমদানি ব্যয় এক ধাক্কায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ বা স্বাভাবিক নয়।

যেসব খাতে মূলধনি যন্ত্র আমদানি ব্যয় ব্যাপক মাত্রায় বাড়ার তথ্য উঠে এসেছে তার অন্যতম হলো মেকানিক্যাল অ্যাপ্লায়েন্স (এইচএস কোড ১৬৮৪২৪)। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ ধরনের পণ্য আমদানি হয়েছিল প্রায় ২ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের। গত অর্থবছরে প্রায় ১০ হাজার শতাংশ বেড়ে গত অর্থবছরে এ-জাতীয় পণ্য আমদানি দাঁড়িয়েছে ২৯ কোটি ৭৪ লাখ ৩৮ হাজার ডলারে, যার অধিকাংশই এসেছে চীন থেকে।

একইভাবে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে জাহাজে পণ্য ওঠা-নামা করানোর ডেরিক ও ক্রেন আমদানিতেও (এইচএস কোড ১৬৮৪২৬)। ২০২০-২১-এ ডেরিক ও ক্রেন আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ৫ কোটি ৭৪ লাখ ৭৬ হাজার ডলার। ২০২১-২২-এ ব্যয় হয়েছে ৯৩ কোটি ১ লাখ ডলার। এ হিসেবে এ অর্থবছরে পণ্যটিও আমদানি ব্যয় বেড়েছে দেড় হাজার শতাংশেরও বেশি। পণ্যটির মূল উৎস চীন।

শিপবোর্ডস ও ফ্লোটিং স্ট্রাকচারের মতো মূলধনি সম্পদের ক্ষেত্রেও আমদানি ব্যয়ে বড় ধরনের উল্লম্ফন দেখা গিয়েছে গত অর্থবছরে। এগুলোর বেশির ভাগই এসেছে চীন ও জাপান থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে মূলধনি যন্ত্র বা যন্ত্রাংশ বিবেচিত এমন অনেক পণ্যের উল্লেখ আছে, যেগুলোর আমদানি ব্যয় ৭০ থেকে ৩০০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।

মূলত বিলম্বিত ঋণপত্রের অর্থ পরিশোধের কারণেই গত অর্থবছরে দেশের আমদানি বাবদ অর্থ ব্যয়ের পরিসংখ্যানে এত বড় উল্লস্ফন দেখা যাচ্ছে বলে দাবি করছেন শিল্পোদ্যোক্তারা। এছাড়া শিল্প খাতে মূলধনি যন্ত্র আমদানি বাবদ ওভার ইনভয়েসিংয়ের কোনো সুযোগ নেই বলেও দাবি করছেন তারা।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমদানীকৃত মূলধনি যন্ত্রের মধ্যে আমাদের খাতেরই আছে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলারের মতো। অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রকল্পগুলোয়ও অনেক মূলধনি যন্ত্র আমদানি হয়েছে। সেগুলোর প্রভাবও থাকতে পারে। বস্ত্র খাতে মূলধনি যন্ত্র যা আমদানি হয় তার বেশির ভাগই এখন ইউরোপের দেশগুলো থেকে আসে। এক্ষেত্রে দাম বেশি দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। রিফাইনারি শিল্পের পাশাপাশি এলপিজি প্রকল্পগুলোর পরিসংখ্যানও মূলধনি যন্ত্র আমদানির হিসাবের মধ্যে আছে। আবার সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মূলধনি যন্ত্রও আছে। সব মিলিয়েই আমদানি ব্যয়ের আকারটা অনেক বড় দেখাচ্ছে বলে আমি মনে করি।’

বাংলাদেশে বেশি মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি হয় সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার চীন থেকে। আবার এ চীনের সঙ্গেই বাণিজ্য পরিসংখ্যান নিয়ে গরমিল দেখা যায় বেশি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যের সঙ্গে চীনা শুল্ক কর্তৃপক্ষের তথ্য মিলিয়ে দেখা যায়, দুই দেশের সরকারিভাবে প্রকাশিত বাণিজ্য তথ্যে গরমিল ৫৬৮ কোটি ডলারের বেশি।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) লিমিটেডের বোর্ড অব গভর্নরসের সদস্য ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এক বছরের ব্যবধানে মূলধনি যন্ত্র আমদানি ব্যয় কেন এত বেড়ে গেল, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। পরিসংখ্যানটি অবশ্যই উদ্বেগের জন্ম দেয়। এক্ষেত্রে যদি অর্থ পাচার হয়, তা খতিয়ে দেখতে হবে। কোন ব্যাংক থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ পরিশোধ হয়েছে, সেটিও বিচার-বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কোন পণ্যে হয়েছে সেটিও জানা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। অবশ্যই এ নিয়ে অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন।’

আমদানি ঋণপত্রে ব্যাপক ওভার ইনভয়েসিং হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি পঞ্জিকাবর্ষে (২০২২ সাল) ঋণপত্রে কমপক্ষে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েসিং হয়েছে বলে সন্দেহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার ১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে জানান, এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত প্রতি মাসে শুধু আমদানির জন্য গড়ে ৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। এতে ওভার ইনভয়েসিং হয়েছে কিনা তা দেখতে গত বছর ও চলতি বছরের অনেক এলসির তথ্য নিয়ে যাচাই-বাছাই শুরু করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত জুলাই থেকে যাচাই-বাছাই চালিয়ে এ পর্যন্ত ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত পণ্য আমদানিতে দাম বাড়িয়ে দেখানোর বিষয়টি প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করতে পেরেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

পুরনো এলসির বিলম্বিত পরিশোধ এবং মেগা প্রকল্পের জন্য মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির বিষয়টিও এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘একটি হলো অনেক অর্থ পরিশোধ আটকে ছিল। অর্থাৎ এলসির বিপরীতে বিলম্বিতভাবে অর্থ পরিশোধ হয়েছে। আবার মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবও রয়েছে। দেখা গিয়েছে একই পণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে। এছাড়া সরকারি প্রকল্পের মূলধনি যন্ত্রও এখানে থাকতে পারে।’

অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের খুব সতর্কতার সঙ্গে খতিয়ে দেখা দরকার। কারণ মূলধনি যন্ত্রের বেশির ভাগই শূন্য শুল্কে আমদানি হয়। সুতরাং এখানে ওভার ইনভয়েসিংয়ের বিরাট একটা সুযোগ আছে। কোথায় আমদানি হলো, কত দামে হলো, এর একটা অনুসন্ধান কর্মসূচি সম্পন্ন করে বিষয়গুলো নিয়ে পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া এ এক বছরে এমন কোনো বড় বিনিয়োগও হয়নি, যার জন্য বিপুল পরিমাণে মূলধনি যন্ত্র আমদানির প্রয়োজন পড়েছে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা অনেক বছর ধরেই বলছি যে মূলধনি যন্ত্রের আমদানি যেহেতু শূন্য শুল্ক সুবিধায় আনা হয়, এখানে ওভার ইনভয়েসিংয়ের একটা বড় ধরনের আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ চলে যায়, বিভিন্ন বৈশ্বিক সমীক্ষায় দেখা যায় যে এর ৮০ শতাংশই হয় ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। এই যে আশ্চর্যজনক উল্লম্ফন, সেটির পরিপ্রেক্ষিতেও পরিসংখ্যানগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আর এখন আমাদের একটা সংকট হচ্ছে, সেটির পরিপ্রেক্ষিতেও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বেড়েছে। দেখা প্রয়োজন যে কোথাও নিয়মের ব্যত্যয় হয়েছে কিনা। ভবিষ্যতে এ ধরনের সমস্যা মোকাবেলার জন্য হলেও এখন খতিয়ে দেখতে হবে। এখন রিজার্ভের প্রত্যেকটি ডলার জরুরি।’

মূলত পুরনো এলসির অর্থ পরিশোধই মূলধনি যন্ত্রের আমদানি ব্যয় বাড়িয়েছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের নেতারা। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূলধনি যন্ত্রের অর্থ পরিশোধ বাবদ যে পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে সেখানে আগের বছরগুলোয় খোলা ঋণপত্রের অর্থ পরিশোধও আছে। এছাড়া এখানে বিদ্যুৎ খাত ও স্পিনিং মিলের পরিসংখ্যানও আছে। সরকারের প্রকল্পের পরিসংখ্যানও এখানে থাকতে পারে। গত তিন বছর কোনো শিল্পেরই তেমন কোনো উন্নয়ন হয়নি। বস্ত্র খাতে স্পিনিং মিলগুলোর এলসি খোলা হয়েছে বছর তিনেক আগে। সেগুলোর অর্থ পরিশোধ হয়েছে চলতি বছরের শুরু থেকে। পরিসংখ্যানে মূলত বিলম্বিত অর্থ পরিশোধের প্রভাব দেখা যাচ্ছে।’

বণিক বার্তার প্রতিবেদনটির লিঙ্ক



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top