অর্থনৈতিক বিবাদ নিরসনে সালিশের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ৭ ডিসেম্বর ২০২২ ২১:৫৯; আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ২১:৩৫

ছবি: সংগৃহিত

স্বল্প খরচ, গোপনীয়তা রক্ষা সহ নানা কারণে অর্থনৈতিক বিরোধে জনপ্রিয়তা বাড়ছে আদালতের বাইরে সালিশি ব্যবস্থার। ফলে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো মামলার বিকল্প হিসেবে তাদের বিবাদ নিরসনে এই ব্যবস্থাকেই বেছে নিচ্ছে। টিবিএসের প্রতিবেদন। 

সিঙ্গাপুর ভিত্তিক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান (আইটি) লিমকন টেকনোলজি সলিউশন্স থেকে কম্পিউটার এক্সেসরিজ ও সফটওয়্যার সংগ্রহ করতো বাংলাদেশের খান আইটি অ্যান্ড সার্ভিসেস। কিন্তু, সময়মতো পরিশোধ না করায় ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৩৭৮ কোটি টাকা পাওনা দাঁড়ায় লিমকনের।

পাওনা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তিতে দুটি সমাধান ছিল সিঙ্গাপুরের কোম্পানিটির: হয় তাদের খান আইটির বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতে মামলা করতে হতো; অথবা রুদ্ধদ্বার শুনানির মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তির উদ্যোগ। বিদেশি প্রতিষ্ঠানটি শেষোক্ত উপায়টিই বেছে নেয় এবং ২০২০ সালে বাংলাদেশের হাইকোর্টে অর্থ আদায়ের জন্য মামলা না করে সালিশের মাধ্যমে বিরোধটি নিষ্পত্তির আবেদন করে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে, সংশ্লিষ্ট দুই পক্ষের আইনজীবী এবং একজন ব্যবসায়ী নেতার সমন্বয়ে একটি সালিশি প্যানেল গঠন করে দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে, প্যানেলটিকে ১৫ দিনের মধ্যে বিষয়টির সমাধান করে আদালতে একটি প্রতিবেদন দাখিল করার আদেশ দেয়া হয়।

এরপর সালিশি প্যানেলের সিদ্ধান্তমূলক প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করা হয়। এই সিদ্ধান্তকে বলা হয় অ্যাওয়ার্ড। হাইকোর্ট সেটি ঘোষণা করেন এবং তা মেনে নিয়ে ছয় কিস্তিতে পাওনা পরিশোধ করে খান আইটি।

সিঙ্গাপুরের আইটি প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশের প্রতিনিধি তাহেরুল ইসলাম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'সালিশি অ্যাওয়ার্ড নিয়ে উভয় পক্ষই খুশি। কারণ মাত্র দুই মাসে এত বড় একটি বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। এজন্য উভয় পক্ষের টাকাও খরচ হয়েছে খুব কম। পাওনা পরিশোধও দ্রুত সম্পন্ন হয়েছে'।

কিন্তু, লিমকন যদি প্রথম উপায়টি গ্রহণ করে খান আইটির বিরুদ্ধে মামলা করতো– তাহলে কী হতো?

কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ এবং অন্তত ৩০টি দেশে সালিশি মামলার প্রাকটিশনার ব্যারিস্টার আজমাউল হোসেন কিউসি টিবিএসকে বলেন, "এ ধরনের বিরোধ কেন্দ্র করে মামলা হলে- বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তিন থেকে ১০ বছর বছর সময় প্রয়োজন হতো শুধু একটি রায় আসতে। এরপর আবার উচ্চতর আদালতে আপিলের বিষয়টি তো আছেই।"

তিনি বলেন, এসব মামলা পরিচালনার খরচও অনেক বেশি। অনেক সময় দেখা যায়, যে পরিমাণ অর্থদাবি কেন্দ্র করে বিরোধ তৈরি হয়- তার এক-চতুর্থাংশ বা অর্ধেক খরচ হয়ে যায় আইনি লড়াইয়ে।

এই আইনজীবী জানান, আরবিট্রেশন বা সালিশি বেশি আকর্ষণীয়; কারণ এর মাধ্যমে বাণিজ্যিক বিষয়াদি সবার সামনে আলোচিত না হয়ে, রুদ্ধদ্বার পরিবেশে সমাধান হয়। তাই এটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, তুলনামূলক সস্তা এবং মামলার শুনানির জন্য উভয়পক্ষ তাদের নিজস্ব আরবিট্রেটর (মধ্যস্ততাকারী) নিয়োগ দিতে পারে।

২০০১ সালে সালিশি আইন করে বাংলাদেশ। দেওয়ানি কার্যবিধিতে এই পদ্ধতি অবলম্বনের বিধান বাধ্যতামূলক করা হয়। এছাড়াও, কোম্পানি আইন অনুযায়ীও বিরোধ নিষ্পত্তি সম্ভব।

কাজ করে জাদুর মতই

ব্যারিস্টার আজমাউল হোসেন কিউসি জানান, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সালিশের এই পদ্ধতি জাদুর মতোই কাজ করে, কারণ এতে অর্থ, সময় ও শ্রম- সবেরই সাশ্রয় হয়।

সালিশি কীভাবে কাজ করে তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, আন্তঃসীমান্ত বিরোধের ক্ষেত্রে এতে জড়িত একটি পক্ষকে প্রথমে সিভিল কোর্টে বা হাইকোর্টে সালিশির আবেদন করতে হয়। এরপর আদালত উভয়পক্ষের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল গঠন করে দেন। সালিশি প্রক্রিয়া শুরুর আগে দুই পক্ষকেই সম্মতি দিতে হয় যে, তারা এখানে যে সিদ্ধান্ত হবে- সেটি মেনে নেবে। শুনানির সময়, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলি এতে ভার্চুয়ালি যুক্ত থাকতে পারে এবং তাদের দাবিকে সমর্থন করে এমন নথিপত্র জমা দিতে পারে।

সালিশি মামলা বাড়ছেই

২০১৭ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত, ১৪ হাজার সালিশি আবেদন (মামলা) নিষ্পত্তি করেছেন হাইকোর্ট, যার সাথে জড়িত ছিল প্রায় ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার বিরোধ। এই তথ্য জানা গেছে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের সূত্রে।

আনুষ্ঠানিক রেকর্ডে দেখা যায়, এসময়ে দেশজুড়ে ৩২ হাজার ৫১৪টি সালিশের আবেদন করা হয় বিভিন্ন দেওয়ানি আদালতে, যার সাথে জড়িত ছিল প্রায় ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকার বিরোধ।

ব্যারিস্টার আজমাউল হোসেন বলেন, বাংলাদেশে সালিশের মাধ্যমে বাণিজ্য বিরোধে নিষ্পত্তি বাড়ছে, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে। একইসঙ্গে আরও বেশি স্থানীয় ও কর্পোরেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্রতিনিয়ত আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির দিকে ঝুঁকছে।

তার বক্তব্যকে সমর্থন করছে, সুপ্রিম কোর্ট এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইংয়ের তথ্যও।

২০১৭ সালে ১,৩৫৪টি সালিশি আবেদন (মামলা) নিষ্পত্তি করেছেন হাইকোর্ট। ২০১৮ সালে ২,১০০, ২০১৯ সালে ২,৪০৮, ২০২০ সালে ২,৬১৪, ২০২১ সালে ২,৯৫৪ এবং এই বছরের জুন পর্যন্ত ১,৯০৭টি সালিশি আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে।

এছাড়া, ২০১৭ সালে সারা দেশের দেওয়ানি আদালতগুলো ৪,০৮৬টি সালিশি আবেদন (মামলা) নিষ্পত্তি করেছেন। ২০১৮ সালে ৫,৩০৯, ২০১৯ সালে ৫,৪০৮, ২০২০ সালে ৬,৬০০, ২০২১ সালে ৬,৮১১ এবং চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৪,৩০০টির নিষ্পত্তি হয়েছে।

সুপ্রিম কোর্টের সূত্রমতে, গত বছর হাইকোর্ট ও নিম্ন আদালতে যেসব আরবিট্রেশন নিষ্পতি হয়ে অ্যাওয়ার্ড (রায়) প্রদান করা হয়, সেগুলোর অর্ধেকের বেশি ছিল বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানি, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের। আগের বছরগুলোর রেকর্ডেও একই ধারা ছিল।

সালিশির ৭০ শতাংশ মামলাই বাণিজ্য বিরোধ সংক্রান্ত। পাশাপাশি শেয়ার হস্তান্তর, মালিকানা, চুক্তি লঙ্ঘন, বিনিয়োগ এবং মানহীন পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত বিরোধও রয়েছে।

সহজে ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক একটি ব্যবস্থা

কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজিব-উল- আলম জানান, যেসব দেশ সহজে ব্যবসা করার সূচকে এগিয়ে রয়েছে, তাদের ৯০ শতাংশ ব্যবসায়িক বিরোধ সালিশের মাধ্যমে সমাধান করা হয়।

আদালতের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তির অধিক কার্যকারিতেকেই তিনি এসব দেশের উন্নত ব্যবসায়িক পরিবেশের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন।

সালিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তির ক্রমবর্ধমান ধারাটিকে আরও এগিয়ে নিতে– সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে সমন্বিত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, অনেক বহুজাতিক কোম্পানি মনে করে বাংলাদেশে মামলা-মোকাদ্দমা কখনোই চূড়ান্ত সমাধানে পৌঁছায় না। এতে তারা এদেশে বিনিয়োগে বিমুখ হচ্ছে। তাই বাণিজ্য সালিশিকে অগ্রাধিকার দিয়ে সরকারকে তার নীতি সমন্বয় করতে হবে।

সালিশের মিছিলে যোগ দিয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও

আদালত ছাড়াও বাংলাদেশের সাতটি প্রতিষ্ঠান সালিশির কাজ করছে। এদের মধ্যে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অভ আরবিট্রেশন, বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টার, বিমাক- বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়েশন অ্যান্ড আরবিট্রেশন সেন্টার এবং আরবিট্রেশন অ্যান্ড মিডিয়েশন সেন্টার, ঢাকা উল্লেখযোগ্য।

এবি ব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল আরবিট্রেশন সেন্টারের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ. (রুমি) আলী জানান, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক– উভয় ধরনের ব্যবসায়িক বিরোধ নিষ্পত্তিতে সালিশের মামলা বাড়ছে।

বাংলাদেশের আদালতে ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত প্রায় ২ লাখ ১১ হাজার মামলা এখনো পর্যন্ত অনিষ্পন্ন রয়েছে, যার সাথে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকার বিরোধ যুক্ত।

এই বাস্তবতায়, সালিশ একটি ভালো বিকল্প হতে পারে বলে টিবিএসকে জানান, ফেডারেশন অভ বাংলাদেশ চেম্বার্স অভ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি'র (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসীম উদ্দিন।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক টিবিএসকে বলেছেন, ব্যবসাবাণিজ্যের বিরোধ নিষ্পত্তিতে সালিশকে বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে সরকারও ভাবছে।

টিবিএসের প্রতিবেদনটির লিঙ্ক 



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top