পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে চার দেশের কর্মকৌশল অনুসরণ
রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১২ ডিসেম্বর ২০২২ ১৯:১৮; আপডেট: ১ মে ২০২৫ ০৫:১১
-2022-12-12-08-18-13.jpg)
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সুইজারল্যান্ডের কর্মকৌশলকে মডেল হিসাবে অনুসরণ করবে বাংলাদেশ। এসব ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে ‘পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার: আইনি কাঠামো ও কৌশলগত প্রক্রিয়া’ শীর্ষক গাইডলাইনে। খবর যুগান্তরের।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ‘অর্থ পাচার প্রতিরোধসংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটি’-এর বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
ওই গাইডলাইনে বলা হয়, যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে বা হচ্ছে তার অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ যৌথভাবে তদন্ত করবে। এক্ষেত্রে কোনো দেশে পাচার হওয়া অর্থের সুনির্দিষ্ট সন্ধান মিললে ওই দেশের সরকারের সঙ্গে সন্তোষজনক আলোচনার মাধ্যমে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় তা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টির আওতায় ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে বাংলাদেশিদের গোপনীয় অস্থাবর সম্পদ বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বৈধ করার সুযোগ দিয়েছিল সরকার। কিন্তু এই অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি এখনো কেউ নেয়নি।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক (অবসর) মইনুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের বিষয়ে কয়েকটি দেশের মডেল অনুসরণের বিষয়ে আমি মত দিতে পারছি না। কারণ, ওইসব দেশ কীভাবে অর্থ উদ্ধার করছে জানা নেই। আদৌ সেভাবে উদ্ধার প্রক্রিয়া সম্ভব হবে কি না, এ নিয়েও প্রশ্ন আছে। তবে বাংলাদেশ থেকে আটটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, দুবাই, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও অস্ট্রেলিয়ায় টাকা পাচার হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোয় বাংলাদেশের তদন্ত টিম পাঠিয়ে অনুসন্ধান করা দরকার। কারা ওই দেশগুলোয় টাকা পাচার করছে, এর তালিকা এনে বর্তমান তাদের অবস্থা শনাক্ত করতে হবে। যদি পাচারকারীরা কোনো কর্মক্ষেত্রে থাকলে তাদের বরখাস্ত করতে হবে। ঋণগ্রহীতা হলে তার ঋণের টাকা ফেরত নিতে হবে। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। তা না হলে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধার সম্ভব হবে না।
অর্থ পাচারের ব্যাপারে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আমদানি-রপ্তানির আড়ালে মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অর্থ পাচার হচ্ছে। বেশি দামের পণ্য কম দামে এলসি খুলে বাকি অর্থ হুন্ডিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। তিনি পণ্য আমদানিতে মিথ্যা ঘোষণার কিছু উদাহরণ টেনে বলেন, এক লাখ ডলারের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি মাত্র ২০ হাজার ডলারে আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। বাকি অর্থ হুন্ডিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার আমদানি করা বিভিন্ন পণ্যে ২০ থেকে ২০০ শতাংশ পর্যন্ত ওভার ইনভয়েস (আমদানি মূল্য বাড়িয়ে দেখানো) হয়েছে। গত জুলাইয়ে এমন আশ্চর্যজনক প্রায় ১০০টি ঋণপত্র বন্ধ করা হয়েছে। বিষয়টি এরপর আরও আলোচনা আসে।
জানা যায়, সুইস ব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারের জন্য ২০১৯ সালে নভেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি অর্থ উদ্ধারের কার্যক্রমের কার্যকর কৌশল নির্ধারণের লক্ষ্যে একটি প্রতিবেদন প্রণয়ন করে। ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর এ প্রতিবেদনটি অর্থ পাচার প্রতিরোধসংক্রান্ত জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে উত্থাপন করে। এরপর প্রতিবেদনের ওপর ওয়ার্কিং কমিটির দুদফা মতামত নেওয়া হয়। পরে ২০২২ সালের মার্চে জাতীয় সমন্বয় কমিটির বৈঠকে এ প্রতিবেদন উত্থাপন করা হয়। এরপর সর্বশেষ ৩০ নভেম্বর সমন্বয় কমিটির বৈঠকে এটি অনুমোদন দেওয়া হয়।
সূত্র আরও জানায়, এ গাইডলাইনসহ পূর্ণাঙ্গ একটি প্রতিবেদন শিগগিরই পাঠানো হবে উচ্চ আদালতে। কারণ, পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশের করণীয় সম্পর্কে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত।
অর্থ উদ্ধারের গাইডলাইনে বলা হয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) অথবা সরকারি কোনো গোয়েন্দা সংস্থা তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানে কিংবা সম্মিলিত উদ্যোগে পাচার হওয়া অর্থের হদিস পায় অথবা গোপনীয় কোনো সম্পদের উৎস জানতে পারে, তাহলে ওই সমুদয় অর্থ বা সম্পদ সরকার জব্দ বা বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
এদিকে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও উদ্ধার কার্যক্রম সক্রিয় হয়ে উঠেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। রোববার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহর সভাপতিত্বে অর্থ পাচার প্রতিরোধসংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বিদেশ থেকে অর্থ ফেরত আনা, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ সম্পর্কিত মামলার ক্ষেত্রে পৃথক অ্যাটর্নি সার্ভিস চালু, জমি রেজিস্ট্রেশনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে মার্কেট বেজড ট্রানজেকশন চালুর অগ্রগতি বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়। এছাড়া পাচারকৃত অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশের করণীয় বিষয়ে আদালত থেকে যে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে, সেটি নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
এর বাইরেও সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা টাকার পরিমাণ এক বছরের ব্যবধানে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা বৃদ্ধির খবর দিয়েছে সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১ সালে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাংক, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর, অর্থাৎ ২০২০ সালে, এই অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা।
আর দেশ থেকে প্রতিবছর পাচার হচ্ছে ৬৪ হাজার কোটি টাকা-এমন তথ্য দিয়েছে গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির সর্বশেষ প্রতিবেদনে। এসব টাকা পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, থাইল্যান্ডসহ ১০টি দেশে।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: