বিদ্যুৎ খাতে বৃহৎ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর উদ্যোগগুলো কি ঝুঁকিপূর্ণ
রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ২১:৪৬; আপডেট: ১ মে ২০২৫ ০৫:৪১
-2022-12-14-10-46-03.jpg)
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের অন্যতম বড় প্রকল্প পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে সংকটে কয়লা আমদানি করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। খবর বণিক বার্তার।
আবার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির বিদেশী ঋণ পরিশোধের মেয়াদ শুরু হয়েছে। কিন্তু সেখানেও বাদ সাধছে ডলার সংকট। চলতি মাসের শুরুর দিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রদেয় একটি ঋণের কিস্তি সময়মতো শোধ করা যায়নি। ডিসেম্বরের মধ্যেই বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে ডলারে এ কিস্তিসহ জরুরি ভিত্তিতে বড় অংকের অর্থ জোগাড় করতে হবে বলে জানা গিয়েছে।
দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে এখন কমবেশি একই ধরনের সমস্যার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতে এ সমস্যা অনুভূত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। গত কয়েক বছরে বিদ্যুৎ খাতে বড় অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেছেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা। এসব বিনিয়োগের অর্থায়ন হয়েছে বিদেশী বিভিন্ন ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেয়া ঋণের ভিত্তিতে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) তথ্য অনুযায়ী, দেশের বিদ্যুৎ খাতে চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৫০ কোটি ডলার বা তার বেশি পরিমাণ বিনিয়োগ রয়েছে তিনটি প্রতিষ্ঠানের—এস আলম গ্রুপ, সামিট গ্রুপ ও ওরিয়ন গ্রুপের। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের বিনিয়োগ রয়েছে প্রায় ২৪৬ কোটি ডলার। সামিট গ্রুপের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি ডলার। ওরিয়ন গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় বিনিয়োগ ও অর্থায়নের পরিমাণ ৭০ কোটি ডলার।
বিদেশী অর্থায়নে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগে নির্মাণ হলেও জ্বালানি ও ডলার সংকটের মুখে সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সময়মতো উৎপাদনে আনা যাবে কিনা, সে বিষয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের আশঙ্কা, এসব ঋণের বেশির ভাগের উৎস চীনভিত্তিক ব্যাংকগুলো। এসব ব্যাংক ঋণের ওপর সুদহারও ধার্য করে অন্যান্য উৎসের চেয়ে বেশি। ডলার ও জ্বালানি সংকটের বর্তমান পরিস্থিতি চলমান থাকলে ভবিষ্যতে বিদেশী ঋণ নিয়ে বড় ধরনের বিপত্তিতে পড়তে পারে বিদ্যুৎ খাতের বৃহৎ বেসরকারি কোম্পানিগুলো।
বিষয়টি নিয়ে বিদ্যুৎ খাতের বৃহৎ কয়েকটি বেসরকারি উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে বিদেশী ব্যাংকগুলোর অর্থায়নের বড় একটি অংশ এসেছে গত পাঁচ বছরে। এডিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের আগের দুই বছরে দেশে বিভিন্ন প্রকল্পে ১০ কোটি ডলারের বেশি অর্থায়ন করেছে সাতটি বিদেশী প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে শীর্ষ পাঁচটিই চীনের। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ব্যাংক অব চায়না, এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট ব্যাংক অব চায়না (চায়না এক্সিম ব্যাংক) ও চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংকের প্রতিটির বাংলাদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৯ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এক্সিম ব্যাংক অব চায়না ঋণ দিয়েছে ৪৬ কোটি ১০ লাখ ডলার। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়নার কাছ থেকে বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়েছে ৪০ কোটি ডলার। জাপানের সুমিতমো মিত্সুই ব্যাংকিং করপোরেশন ঋণ দিয়েছে প্রায় ২২ কোটি ডলার। ১৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঋণ দিয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক ক্লিফোর্ড ক্যাপিটাল। এসব ঋণের বড় একটি অংশ এসেছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে।
বৃহৎ ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোর নিজ নিজ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপের নির্মীয়মান ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ২৪৯ কোটি ডলার। এর মধ্যে প্রায় ১৭৬ কোটি ডলারের ঋণ অর্থায়ন হয়েছে চীনা উৎস থেকে। নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে সামিট গ্রুপের বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ৪৯ কোটি ৯২ লাখ ডলার। ওরিয়ন গ্রুপের সব মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়েকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ৮৫০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ডলার সংকটের ক্ষত এখন বেশ জোরেশোরেই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সামনের দিনগুলোয় বিষয়টি বড় ধরনের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের। এ নিয়ে তাদের বক্তব্য হলো একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হলেও এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে সঞ্চালন ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি। আবার ডলার সংকটে এখন প্রয়োজনমাফিক জ্বালানি আমদানি করা যাচ্ছে না। বিদ্যমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ভুগছে জ্বালানি সংকটে। প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে তা বাংলাদেশের সার্বিক ঋণমানে প্রভাব ফেলতে পারে। এমনকি এ ঋণের বোঝা একপর্যায়ে রাষ্ট্রের ওপর এসে বর্তানোরও বড় আশঙ্কা রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জের মেঘনাঘাটে নির্মাণ হচ্ছে সামিট গ্রুপের ৫৮৩ মেগাওয়াট সক্ষমতার এলএনজি-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম এখন পড়তির দিকে থাকলেও স্পট মার্কেট থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মূল জ্বালানি এলএনজি আমদানি করতে পারছে না বাংলাদেশ। মার্কিন একটি কোম্পানির সঙ্গে এলএনজি আমদানিতে সমঝোতা হয়েছে সামিট গ্রুপের। যদিও ডলার সংকটের কারণে উৎপাদনক্ষম হয়ে ওঠার পর বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহের নিশ্চয়তা দিতে পারছে না কেউই।
এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বড় প্রকল্পগুলোর প্রায় সব’কটিতে সরকারের গ্যারান্টি আছে। যেগুলো এরই মধ্যে সচল হয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, একদিকে চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি করে ফেলেছে, অন্যদিকে যেটুকু উৎপাদন হচ্ছে, সঞ্চালন লাইনে বিনিয়োগ না হওয়ার কারণে সেটিকে গ্রাহকের কাছে নেয়া যাচ্ছে না, যা এক ধরনের অদূরদর্শিতার প্রমাণ। এমন পরিস্থিতিতেও নতুন প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে। কিছু প্রকল্প যৌক্তিকতা ছাড়া নবায়নও করা হচ্ছে। বর্তমান সংকট সাময়িক নয় আবার দীর্ঘমেয়াদিও নয়। অন্তত আরো ছয় মাস থেকে এক বছর থাকতে পারে। যদি ডলার সংকট থাকে তাহলে প্রতিটি প্রকল্পই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। অনেক বেশি সতর্কতা প্রয়োজন। আমাদের ক্ষতি ও ঝুঁকি বেশি হয়ে যাচ্ছে, যা সামনে আরো বাড়বে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিদেশী উৎস থেকে গৃহীত বেসরকারি খাতের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের স্থিতি চলতি বছরের জুন শেষে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের কাছাকাছি। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ ৮১৯ কোটি ডলারের বেশি, যার মধ্যে ৪১০ কোটি ডলারই নিয়েছে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ ঋণের একটি অংশ এখন খেলাপি হওয়ার পথে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকাররা। তাদের ভাষ্যমতে, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও রিজার্ভ সংকট বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের জন্য বিড়ম্বনার কারণ হয়ে উঠেছে। তারা চাইলেও মধ্যস্থতাকারী দেশী ব্যাংকগুলো বিদেশী ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারছে না। ফলে উদ্যোক্তারা নির্দিষ্ট সময়ে ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছেন। বিদেশীদের কাছে খেলাপি হওয়া থেকে বাঁচতে এরই মধ্যে কেউ কেউ ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে নিয়েছেন। আবার ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান মেয়াদ বৃদ্ধিতে অসম্মত হলে অন্য বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বেশি সুদে ঋণ নিয়ে দায় সমন্বয়ের চেষ্টা করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুতে বড় প্রকল্পগুলোর বিপরীতে বিদেশী ঋণ আছে। এগুলো যদি ঋণগ্রহীতা দিতে না পারেন, তাহলে যিনি গ্যারান্টার তিনি পরিশোধ করবেন। বিষয়টি বিবেচনায় বর্তমান পরিস্থিতিতে অবশ্যই ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে যে দায় সৃষ্টি হয়, সেটাকে কনটিনজেন্ট লায়াবিলিটি (বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটলে যে দায় সৃষ্টি হয়) বলা হয়। এ ধরনের ঝুঁকি অনেক বেড়ে গিয়েছে। কোনো কোনো উদ্যোক্তা হয়তো প্রকৃত অর্থেই বিপদে পড়বেন। আবার কেউ কেউ এর সুযোগও নিতে পারেন। দুদিক থেকেই ঝুঁকিটা বাড়ছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের কাছ থেকেও বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ পাওনা অর্থ পাচ্ছে না বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে বিক্রি করার কথা। যদিও বছর বছর লোকসান ও দায়দেনার বোঝা ভারী হয়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির বেসরকারি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কাছ থেকে সময়মতো বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ মূল্য পরিশোধের সক্ষমতাই এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। বেসরকারি বিদ্যুৎ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ) জানিয়েছে, বর্তমানে শুধু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর (আইপিপি) কাছেই বিপিডিবির দেনা রয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা।
যদিও বিদ্যুৎ খাতের নীতিনির্ধারকদের দাবি, বর্তমান সমস্যা সাময়িক। অচিরেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা। বিদ্যুৎ খাতের নীতিগবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বর্তমান সংকট বৈশ্বিক। এটা থামবে। আর এ সংকটের মধ্যে কোনো খাতকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। সবাইকেই সংকট বহন করতে হবে। এটা শুধু বিদ্যুৎ খাতের ইস্যু নয়। বর্তমান সমস্যা সাময়িক। এখন কোম্পানিগুলো আমাদের সহযোগিতা করছে। আশা করছি বর্তমান সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এটা খুব বেশি দিন টেকসই হবে না। বড় যাদের সঙ্গে আমাদের কাজ হচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমাদের আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। তারা আমাদের সঙ্গে সমস্যাগুলো ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। আমি মনে করি, এ নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই।’
বণিক বার্তার প্রতিবেদনটির লিঙ্ক
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: