বাংলার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভাষা ও ধর্ম

শাহ্ সুফি মহিব্বুল আরেফিন | প্রকাশিত: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:৫৪; আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:০৪

 ছবি কনসেপ্ট- শাহ্ সুফি মহিব্বুল আরেফিন

বাংলার আদিবাসী জনগোষ্ঠী কারা এ নিয়ে প্রচুর মতভেদ রয়েছে। প্রাচীনকালে এ দেশের সবটুকু সমুদ্র গর্ভ থেকে জেগে না উঠলেও এখানে প্রাগৈতিহাসিক যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে। তাই পাঁচ ছয় হাজার বছর পূর্বেও এখানে মানুষের বসবাস ছিলো বলে অনুমান করা হয়। অতি প্রাচীনকালে এখানে আর্যদের আগমনের পূর্বে অন্ততঃপক্ষে আরো চারটি জাতি নেগ্রিটো, অষ্ট্রো-এশিয়াটিক, দ্রাবিড় ও ভোটচীনীয় বা মঙ্গলীয়র নাম উল্লেখ করা হয়। একসময় নিগ্রোদের ন্যায় দেহ গঠনযুক্ত এক আদিম জাতির বসবাসের কথা অনুমান করা হয়।

কালের বিবর্তনে বর্তমানে তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিলুপ্ত। প্রায় পাঁচ-ছয় হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে আসাম হয়ে অষ্ট্রো-এশিয়াটিক বা অষ্ট্রিক জাতি বাংলায় প্রবেশ করে। তারা নেগ্রিটোদের উৎখাত করে বলে ধারণা করা হয়। এরাই কোল, ভীল, সাঁওতাল, মুন্ডা প্রভৃতি নৃ- গোষ্ঠীর পূর্বপুরুষ বলে ধারণা করা হয়। আর এ অঞ্চলের নেগ্রিটো, দ্রাবিড়, তিব্বতী-মোঙ্গল ও অষ্ট্রো-এশিয়াটিক মানবগোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নভাবে উচ্চারিত আধো আধো ভাষার সম্মিলিত রূপ হচ্ছে আদি বাংলা ভাষার অলিখিত রূপ।

এসময় বঙ্গোপসাগরের তটরেখা ছিল ঢাকা শহরের উত্তর সীমানা স্পর্শ করে পশ্চিমে রাজশাহী বিভাগের দক্ষিণ সীমানা বরাবর বামে মোড় নিয়ে ভাগীরথী নদীর পশ্চিম অববাহিকা হয়ে বর্তমানকালের গঙ্গা মোহনা পর্যন্ত বিস্তৃত। হিমালয়ের পাদদেশ পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের হরিকেল (চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম), উত্তর পশ্চিমে পুন্ড্র-বরেন্দ্র-গৌড়-বঙ্গ (রাজশাহী ও বিহারের কিছু অংশ) এবং দক্ষিণে রাঢ়-কলিঙ্গ (উড়িষ্যার কিছু অংশ) নিয়ে অর্ধচন্দ্রাকৃতির এ ভূ-ভাগ ছিল প্রায় জনমানব শূন্য বনভূমি। ঐতিহাসিক তথ্য মতে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এ অঞ্চলে মানুষের স্থায়ী কোন বসবাস ছিলোনা। খ্রিষ্টপূর্ব দেড় হাজার বছর পূর্বে ইউরোপের আলপাইন ও রাশিয়ার ইউরাল পার্বত্য অঞ্চল থেকে বৈদিক আর্যরা খাইবার গিরিপথ দিয়ে ভারতবর্ষে আগমন করে। খ্রিষ্টীয় ৭ম-৮ম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের পর সেমিয় রক্তধারাও তৎকালীন জনগোষ্ঠীর সাথে সংমিশ্রিত হয়ে বর্তমান বাঙালি জাতি হিসেবে বিচিত্র এক জনসমষ্টির উদ্ভূত হয়।

ধর্মীয় দিক থেকে আর্যদের আগমনের পূর্বে এ বাংলায় বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রচলন ছিলো। আর আর্যদের আগমনের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলে বৈদিক ধর্মের প্রচলন লাভ করে। ঐতিহাসিক সূত্র বলে, প্রথম অবস্থায় তারা দেবতায় বিশ্বাসী হলেও পৌত্তলিক ছিল না। পরবর্তীতে কোন এক সময় উপনিষদের ভিত্তিতে ‘ব্রক্ষ্ম (ব্রহ্ম) উপাসনা’ শুরু হয়। এতে মুনি-ঋষিদের দেবধর্মের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কারণে প্রতীক পূজার প্রচলন ঘটে। তৎকালীন সমাজে প্রচলিত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মানুসারীদের মধ্যে ধর্ম হিসেবে নয় বরং তান্ত্রিক আচরণ ও কিংবদন্তি গল্পের ভিত্তিতে বৈদিক বা হিন্দু ধর্ম প্রসার লাভ করে। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ্যবাদের ব্যাপক যাজকীয় নীতি পদ্ধতির মাধ্যমে এ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে কোন কোন বর্ণনায় একেশ্বরবাদী জীবনদর্শন এখানে উপস্থিত ছিল কিনা তা নিশ্চিতভাবে উল্লেখ না করলেও হিন্দু ধর্মগ্রন্থসমূহের কিছু উপনিষদের বর্ণনায় স্পষ্ট হয় যে, তারা কোন এককালে ‘তাওহিদ’ বা ‘একেশ্বরবাদি’ দাওয়াতের সংস্পর্শে এসেছিলো। পর্যায়ক্রমে নৈতিক, চারিত্রিক ও ধর্মীয় দিক দিয়ে অধঃপতনে ডুবে যায় বাংলার প্রাচীন মানব সমাজ। ধর্মের নামে তথা দেব-দেবীকে কেন্দ্র করে চরম অন্ধকারাচ্ছন্ন কার্যক্রমে লিপ্ত ছিল তৎকালীন সমাজ। মদ, নৃত্য-গীত, অশ্লীলতা, ব্যভিচার ইত্যাদি ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা।

বাংলা ভাষার সর্বপ্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে যার অস্তিত্ব আজও কালের সাক্ষী হয়ে আছে। পাশাপাশি দেব-দেবীর রুচী বিবর্জিত অশ্লীল মূর্তি নির্মাণ শিল্প-কর্ম ও সাহিত্যে পরবর্তীকালে মানবিক ও সামাজিক অধঃপতনের ভয়াবহ চিত্র সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের ভারতবর্ষ আক্রমণকালে বাংলায় গঙ্গারিডই নামে একটি শক্তিশালী রাজ্য ছিল বলে গ্রিক লেখকদের বিবরণে উল্লেখ করা হয়। ঐতিহাসিকদের বর্ণনায় এটিই ইতিহাসে পাওয়া এ অঞ্চলের প্রথম সাম্রাজ্য। পরবর্তীতে এটি বিহারের মগধ, নন্দ, মৌর্য এবং সুঙ্গ সাম্রাজ্যের সাথে একত্রিত হয়ে যায়। পরবর্তী ৩’শ থেকে ৬’শ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মৌর্য, সুঙ্গ, গুপ্ত ও হর্ষবর্ধন বংশ বঙ্গদেশ শাসন করে। সপ্তম শতাব্দীর প্রথমভাগে বাংলার সর্বপ্রথম স্বাধীন রাজা হন শশাঙ্ক। আর বঙ্গদেশ তখন গৌড় হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করে। এ সময়ই আরবের বুকে ইসলামের বার্তা নিয়ে রহমাতুল্লিল আলামিন হজরত মুহম্মদ মুস্তফা (ﷺ) এঁর আগমন ঘটে। এদিকে বাংলায় শশাঙ্কের মৃত্যুর (৬৩৭ খ্রি.) পরবর্তী একশ বছর চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। যা ইতিহাসের পাতায় ‘মাৎস্যন্যায়’ নামে পরিচিতি লাভ করে। অতঃপর ৭৫০ খ্রি. থেকে পরবর্তী ৪’শ বছর বাংলা শাসন করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী পাল বংশ। পাহাড়পুরের বিখ্যাত সোমপুর বৌদ্ধবিহার এ সময় প্রতিষ্ঠিত হয়। এ শাসনামলের শেষদিকে হিন্দু সেন বংশ বাংলার রাঢ় অঞ্চলে সেনরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমান মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুর ছিল তখনকার বাংলার রাজধানী। সেন বংশের শেষ রাজা লক্ষণ সেনের শাসনামলে ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজি বাংলায় অভিযান করলে লক্ষণ সেন পূর্ববঙ্গে পলিয়ে যায়। সেখানে কিছুকাল পর ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন। মূলতঃ এখান থেকেই শুরু হয় বাংলায় মুসলিম শাসনামল।

পবিত্র ইসলাম ধর্মের আনুষ্ঠানিক সূচনা ৭ম শতকের শুরুতে পবিত্র মক্কা নগরীতে। আর নবি পাক হজরত মুহম্মদ (ﷺ) এঁর জীবনকালেই এই উপমহাদেশে পবিত্র ইসলাম ধর্মের দাওয়াত এসে পৌঁছে যায়। তবে ৮ম শতক নাগাদ উমাইয়া খিলাফত পশ্চিমে ইবেরিয়া (স্পেন) থেকে পূর্বে সিন্ধু নদ পর্যন্ত বিরাট অঞ্চল জুড়ে সম্প্রসারিত হয়। আর ৮ম থেকে ১৩ শতককে ঐতিহ্যগতভাবে ইসলামি স্বর্ণযুগ বলা হয়। আবার ঐতিহাসিকভাবে আব্বাসীয় খিলাফতের আমলে মুসলিম বিশ্ব বৈজ্ঞানিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে উন্নতির শীর্ষে ছিল। মধ্যযুগে পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রসার ঘটেছে মূলতঃ ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে। আর মুসলিম রাজ্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে তা পূর্ণতা পায়। এসময় বিভিন্ন রাজ্য জয় হয়েছে আলাদা আলাদা সাম্রাজ্যের দ্বারা। পরবর্তীতে মুসলিম রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য উত্থানের সময় ‘বাংলা’ ভারতীয় উপমহাদেশের অধীনে ছোট রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখানকার অধিবাসীদের অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। (ইসলামে সুফিবাদের ধারণা ও মধ্যযুগের ওলি-আউলিয়াদের ভূমিকা গ্রন্থের অংশ বিশেষ --চলবে)

 লেখক: গণমাধ্যম কর্মী ও সূফী গবেষক

ই-মেইল: [email protected]



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top