নিঃসঙ্গ মানুষের জন্য মহানবী (সা.)-এর আদর্শ

রাজটাইমস ডেস্ক | প্রকাশিত: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০৯:০৫; আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ২২:৩৭

ছবি: প্রতীকী

সাধারণত নিঃসঙ্গতা বলতে পরিবার-পরিজন থেকে আলাদা হয়ে যাওয়াকে বোঝায়। তবে কোনো নির্জন-জনশূন্য স্থানে একাকিত্বের মাধ্যমেও মানুষ নিঃসঙ্গ হতে পারে। নবীজীবনে দুটি অভিজ্ঞতাই অর্জিত হয়েছিল। পিতৃ-মাতৃহীন কিশোরজীবনে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে মক্কার মরুভূমিতে তিনি বাধ্য হয়ে অন্যদের সঙ্গে রাখালিজীবন কাটিয়েছেন।

আবার স্বেচ্ছায় মক্কার হেরা পর্বতে নির্জনে সময় কাটিয়েছিলেন প্রায় দুই বছর। আয়শা (রা.) নবীজীবনের এই অভিজ্ঞতাকে ‘আল-খালা’ অর্থাৎ নির্জনতা বলে উল্লেখ করেছেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস ৩)

ইসলামে নির্জনতার প্রকৃতি : ইসলামে ব্যক্তি বাস্তবে কখনো নির্জন হয় না। আল্লাহ তাআলা প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি ব্যক্তির যাবতীয় অবস্থা সম্পর্কে অবহিত। ব্যক্তি নির্জনে-নিভৃতে যেখানেই থাকুক, তিনি তার সঙ্গে আছেন। (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ৪)

নবীজীবনে হিজরতের ঘটনায় নবীজি (সা.) এবং আবু বকর (রা.) যখন সাওর গুহায় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছিলেন, তখন তাঁদের তৃতীয়জন ছিলেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা। (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৪০)

প্রত্যেক ব্যক্তির নির্জনকালীন আল্লাহর দ্বিতীয়জন হিসেবে উপস্থিতি অনুভবের সামর্থ্য বস্তুত মুমিনের জন্য নবীজীবনের অভিজ্ঞতা। মুমিনজীবনে মানসিক শক্তির উৎস হিসেবে এ ধারণা অতীব ক্রিয়াশীল।

নিঃসঙ্গ জীবনের সুন্নাহ : একাকিত্ব বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হয়। মূল কারণ শনাক্ত করে তার উপশমই নিঃসঙ্গতার উপযুক্ত ব্যবস্থাপনা। প্রত্যেকের ক্ষেত্রে একক ব্যবস্থাপনা কখনো কার্যকর হতে পারে না। সমাজ ও সভ্যতার চরম অগ্রগতিতে নিঃসঙ্গতার অনিবার্য পরিস্থিতিগুলোতে বিকল্প ব্যবস্থাপনা সুন্নাহর আলোকে সাজানো যেতে পারে।

এক. ইবাদত : একাকিত্ব প্রকৃতপক্ষে লক্ষ্যের অভাব থেকে জন্ম নেয়। মুমিনজীবনের মৌলিক লক্ষ্য আল্লাহর ইবাদত। যাবতীয় অভিযোগ-অনুযোগ এড়িয়ে অনন্ত জীবনের সৌন্দর্যের জন্য ইহজাগতিক জীবনকে ইবাদতের পথে কাটিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে একাকিত্বের উপশম হতে পারে। মুমিনজীবনের সব অনুযোগ তো কেবল আল্লাহর কাছে। (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৮৬)

নবীজীবনে দুঃসাধ্য পথ অতিক্রম করে হেরায় আরোহণ করে নিঃসঙ্গ হওয়ার লক্ষ্য ছিল ইবাদত। গভীর রজনীতে শয্যা ত্যাগ করে রবের সান্নিধ্য কামনার তাৎপর্য মূলত নির্জনতা।

দুই. তিলাওয়াত : নির্জনতা কাটানোর একটি উপশম আল্লাহর সঙ্গে কথা বলা। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত আল্লাহ তাআলার সঙ্গে কথা বলার মাধ্যম। নবীজি (সা.) বলেছেন, গায়িকা তার গানের প্রতি যতটা একাগ্র থাকে, আল্লাহ তাআলা সুকণ্ঠে ও সশব্দে কোরআন তিলাওয়াতকারীর তিলাওয়াত তার চেয়ে অধিক কান লাগিয়ে শোনেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ১৩৪০)। গভীর রজনীর তিলাওয়াত কিয়ামতে সাক্ষ্য। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস ৬৬২৬)

এর মর্মার্থ হলো, নির্জনতায় আপন রবের সঙ্গে কথোপকথন। একটি ভালো বই একাকী নিঃসঙ্গজীবনের শ্রেষ্ঠ সঙ্গী। পবিত্র কোরআনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ আর কী হতে পারে!

তিন. বন্ধুবান্ধব : একজন ব্যক্তির পরিবারের বাইরে বিভিন্ন পরিমণ্ডলে সাহচর্য ও মিথস্ক্রিয়ার ফলে স্বজনতা-ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। নবীজি (সা.) মরুভূমির অন্য রাখালের সঙ্গে স্বজন সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। তাঁরা কখনো কখনো তাঁর কোনো কাজ পালন করতে সচেষ্ট ছিলেন। (আদ-দালাইল, পৃষ্ঠা ১২৮)

বিভিন্ন পরিমণ্ডলে গড়ে ওঠা বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে নিঃসঙ্গ সময় শেয়ার করা যায়। ইসলামে মা-বাবার ইন্তেকালের পরও তাঁদের বন্ধুবান্ধবকে সম্মান-মর্যাদা দিয়ে উত্তম ব্যবহার করার জন্য সন্তানদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৫১৪২)

চার. ইতিকাফ : ইতিকাফ মানে স্থির থাকা বা অবস্থান করা। জাগতিক কার্যকলাপ ও পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সওয়াবের উদ্দেশ্যে মসজিদে বা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করা বা স্থিতিশীল থাকাকে শরয়ি ইতিকাফ বলে। বিদ্যমান বাস্তবতার শিকার নিঃসঙ্গ ব্যক্তিরা আহলু সুফফাহর মতো ধর্মীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের খিদমতে নিজেদের সম্পদ ও সময় কাটিয়ে দিতে আক্ষরিক ইতিকাফ করতে পারেন। ভারতীয় উপমহাদেশে তাবলিগ জামাতে অংশ নেওয়া এক ধরনের আক্ষরিক ইতিকাফ। এভাবে কারো কারো অবসর বা নিঃসঙ্গতার মুহূর্তগুলো দ্বিনি দাওয়াতের কাজে ব্যয় করার মাধ্যমে জীবনকে কিছুটা স্নিগ্ধময় করা যায়।

পাঁচ. মুসাফিরখানা : আরব ভূমির বৈশিষ্ট্যের প্রভাবে মুসাফিরদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাপনা ছিল একটি উন্নত সংস্কৃতি। আরবরা পথে পথে মুসাফিরখানা তৈরি করত। (সুরা : শুআরা, আয়াত : ১২৮)

পবিত্র কোরআনে বর্ণিত জাকাত বণ্টনের খাতগুলোতে ‘ইবনু সাবিল’ বলে মুসাফিরদের বোঝানো হয়েছে। নবীজি (সা.) হিজরতের সময় উম্মু মাবাদের তাঁবুতে মুসাফির হয়েছিলেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো নিঃসঙ্গ ব্যক্তিদের জন্য বিশেষ সুবিধা যুক্ত করতে পারে। অনেক নিঃসঙ্গ ব্যক্তি আর্থিকভাবে সচ্ছল থাকেন, তাঁদের আর্থিক কোরবানি থেকে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন উপকৃত হতে পারে, তেমনি প্রতিষ্ঠানের সেবা গ্রহণ করে তাঁরাও স্বাচ্ছন্দ্যময় সময় কাটাতে পারেন। ইসলামী ওয়াকফ, এতিমখানা, ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ধরনের ব্যবস্থাপনা রাখতে পারে।

নবীজীবনে উদ্দীপ্ত হয়ে নিঃসঙ্গ মানুষের জীবনের দুর্বিষহ যাতনা কিছুটা লাঘবের তাওফিক আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রদান করুন। আমিন।

লেখক : ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, সহযোগী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা



বিষয়:


বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top