গ্যাসের তীব্র সংকট, চরমভাবে ব্যাহত শিল্প ও আবাসিক খাত!

রাজটাইমস ডেস্ক: | প্রকাশিত: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৩ ১০:৪০; আপডেট: ২ মে ২০২৪ ২০:৪১

ছবি: সংগৃহীত

শীত এলেই দেশে তীব্র হয় গ্যাস সংকট, বিশেষ করে আবাসিক গ্রাহকরা এ সময় চরম দুর্ভোগে পড়েন। এবার এমন পরিস্থিতি শুধু আবাসিকে সীমাবদ্ধ নেই। সরবরাহ কমে যাওয়ায় শিল্প খাতেও চলছে চরম বিড়ম্বনা। দেশে উৎপাদন কমে যাওয়ার পাশাপাশি ডলার সংকটে এলএনজি আমদানি করতে না পারা এবং আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় এবার দেশে গ্যাসের সংকট প্রকট রূপ নিয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। খবর দৈনিক কালবেলার। 

উদ্যোক্তারা জানান, গ্যাস সংকটের কারণে অনেক এলাকায় শিল্পকারখানার উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। ফলে উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। উপায়ান্তর না দেখে ব্যবসায়ীরা শিল্পকারখানায় অতি উচ্চ দামের এলপিজি ব্যবহার করছেন।

আবাসিক গ্রাহকদের অবস্থাও একই। রাজধানীর অনেক এলাকার বাসিন্দাদের এক থেকে দুই বেলার খাবার হোটেল থেকে এনে খেতে হচ্ছে। অথবা গভীর রাতে রান্নার কাজ সারতে হচ্ছে। অনেকেই আবার বাসাবাড়িতে বিকল্প হিসেবে পাইপলাইনের গ্যাস সংযোগ থাকার পরও এলপিজি বা বোতল গ্যাস ব্যবহার করছেন।

চলতি বছরের শুরুতে ১৮ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম রেকর্ড ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সরবরাহ নির্বিঘ্ন করার জন্যই দাম বাড়ানো হয়েছে বলে সেই সময় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। কিন্তু রেকর্ড দাম বাড়ানোর পরও সংকট কাটেনি, বরং দিন দিন বাড়ছে। এ অবস্থায় খাতভিত্তিক রেশনিং করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আগামী মার্চের আগে পরিস্থিতি উন্নতির কোনো সম্ভাবনা নেই বলে পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা জানান।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন্স অ্যান্ড মাইনস-অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. আবদুল মান্নান পাটওয়ারী বলেন, ‘এলএনজি সরবরাহ কমে যাওয়ায় সংকট তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি দেশের গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদনও কমেছে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি টার্মিনাল বন্ধ আছে। গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে কাজ শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও দুই মাসের মতো সময় লাগবে।’

চলমান গ্যাস সংকটে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে শিল্প খাতে। বিভিন্ন ধরনের শিল্পকারখানায় গ্যাসের তীব্র সংকটের কারণে উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। উৎপাদন কমে আসায় শ্রমিকরা বসে থাকছেন, এতে কর্মঘণ্টাও নষ্ট হচ্ছে। সর্বোপরি উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

শিল্পে গ্যাসের সংকট বা চাপ কম থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। সারা বছরই এ সংকট কম-বেশি লেগে থাকে। বছরের অন্যান্য সময় গ্যাসের সংকট থাকলেও সাধারণত শীতকালে শিল্পে গ্যাসের সরবরাহ কিছু উন্নতি হয়। কারণ, এ সময় বিদ্যুতের চাহিদা কমে যায়। ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের একাংশ শিল্পে সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। বিদ্যুতে গ্যাসের সরবরাহ কম হলেও সার উৎপাদনে সরবরাহ বাড়ানোর কারণে শিল্পে সরবরাহ কমে এসেছে।

এ অবস্থায় শিল্পকারখানায় গ্যাসের সরবরাহ ঠিক রাখতে গত ৫ ডিসেম্বর পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের কাছে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিকেএমইএ)। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর কাছেও এর অনুলিপি পাঠানো হয়। পরে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতারা সরাসরি সাক্ষাৎ করেও গ্যাস সংকটের কথা জানান।

দেশের অন্যতম রপ্তানি খাত নিট শিল্প ক্রান্তিলগ্ন পার করছে বলে মন্তব্য করে বিকেএমইএ তাদের চিঠিতে বলেছে, ‘রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে এমনিতেই পুরো শিল্প খাতে বিরূপ প্রভাব পড়েছে, এর সঙ্গে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং গ্যাস সংকটের কারণে উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। গ্যাস সংকটের কারণে কারখানা চালু রাখা যাচ্ছে না। পরিস্থিতি দিন দিন নাজুক হচ্ছে। অনেক কারখানা সময়মতো শিপমেন্ট করতে পারছে না।’

একাধিক ব্যবসায়ী জানান, গ্যাস সংকটের কারণে জ্বালানি তেল দিয়ে কারখানা চালাতে হচ্ছে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। একটি মধ্যম মানের কারখানায় প্রতিদিন ৬ থেকে ৮ লাখ টাকার বাড়তি ডিজেল ব্যবহার করতে হচ্ছে। আর প্রথম সারির কারখানায় এর পরিমাণ ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকার মতো। কিন্তু বিপুল পরিমাণ এ টাকা খরচের সামর্থ্য অনেক কারখানার মালিকের নেই। নিট শিল্পে সরাসরি প্রায় ১৫ লাখ শ্রমিক কর্মরত রয়েছেন। আর পরোক্ষভাবে কাজ করছেন আরও ৭০ হাজার মানুষ।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘গ্যাস সংকট এখন চরমে। এর কোনো উন্নতি হয়নি। পুরো নারায়ণগঞ্জে গ্যাস নেই। আমরা পরিস্থিতি তুলে ধরে পেট্রোবাংলাসহ সব দপ্তরে চিঠি দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছি। আমরা বলেছি, সারে যে গ্যাস দিচ্ছে, তা যদি শিল্পে দেওয়া হয়, সার আমদানি করতে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রয়োজন, তার সংস্থান আমরা করে দেব। কিন্তু পরিস্থিতির কোনো উন্নতি নেই, বরং অবনতি হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘সরকার নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস দেওয়ার কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল। আমরা সেটা মেনে নিয়েছি; কিন্তু এখন গ্যাস পাচ্ছি না। কারখানার উৎপাদন অনেক কমে গেছে। সময়মতো পণ্য সরবরাহ করা যাচ্ছে না। শিপমেন্ট শিডিউল ফেইল করার কারণে বায়াররা (ক্রেতা) ত্যক্তবিরক্ত হয়ে অর্ডার ক্যানসেল করে দেওয়ার কথা বলেছে। নতুন কার্যাদেশ পাওয়া নিয়ে সংশয় তৈরি হচ্ছে।’

ব্যবসায়ীরা জানান, ঢাকার উত্তর অংশসহ আশুলিয়া, সাভার, জয়দেবপুর, সফিপুর, কাশিমপুর, কোনাবাড়ী, টাঙ্গাইল, এলেঙ্গা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী ও এর আশপাশের এলাকায় তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। হঠাৎ করেই এসব অঞ্চলের পোশাক কারখানাগুলোতে গ্যাসের চাপ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ২-৩ পাউন্ডে (পিএসআই) নেমে এসেছে। সাধারণত জেনারেটর বা বয়লার চালানোর জন্য পোশাক কারখানাগুলোয় ১৫ পিএসআই চাপের গ্যাস প্রয়োজন। এ চাপ ৭ থেকে ১০ পিএসআইয়ে নেমে আসায় ধুঁকে ধুঁকে চলছে গ্যাসচালিত মেশিনের কারখানাগুলো। ঢাকার বাইরের অবস্থা আরও নাজুক বলে ব্যবসায়ীরা জানান।

জানা গেছে, আমদানি করা তরল গ্যাস বা এলএনজি ফের গ্যাসে রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহ করতে কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল রয়েছে। এর মধ্যে গত ১ নভেম্বর থেকে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনালটি সংস্কার কাজের জন্য সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। আগামী মাসের শুরুতে এ টার্মিনালটি ফের চালুর আশা করছে পেট্রোবাংলা।

এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনাল চালুর পর আরেকটি টার্মিনালও সংস্কারের জন্য পাঠানো হবে। দ্বিতীয় টার্মিনালটির মালিকানায় রয়েছে সামিট। এটি সংস্কারের জন্য গেলে মার্চের আগে ঠিক হবে না। টার্মিনাল দুটি থেকে দৈনিক সাড়ে ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যেত। একটি বন্ধ থাকায় বর্তমানে অন্যটি থেকে দৈনিক সাড়ে চারশ থেকে ৪৯১ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে।

এ ছাড়া দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা আর জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন কমেছে। এ দুটি ক্ষেত্রের দায়িত্বে রয়েছে মার্কিন কোম্পানি শেভরন। কোম্পানিটি গ্যাসক্ষেত্র দুটির মধ্যে বিবিয়ানা থেকে উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এতে আরও কিছু সময় লাগবে। পাশাপাশি তীব্র ডলার সংকটের কারণে এই মুহূর্তে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করা যাচ্ছে না। এসব কারণে গ্যাসের সংকট প্রকট হয়েছে।

শিল্পে গ্যাসের সংকট সামাল দিতে সরকার সম্প্রতি ভোলার গ্যাস সিএনজি করে সরবরাহ করছে। শিল্পকারখানার মালিকদের এ গ্যাস কিনতে হবে ঘনমিটারপ্রতি ৪৭ টাকা ৬০ পয়সা দরে। ব্যবসায়ীরা এ উচ্চ দামের গ্যাস নেওয়ার পক্ষে নন। তারা বলছেন, এই দামে গ্যাস নেব জরুরি প্রয়োজনে; কিন্তু সবসময় এ দামে নিলে তো শিল্প টিকিয়ে রাখা যাবে না।

বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এ বিষয়ে বলেন, ‘এ দামে গ্যাস কিনে শিল্প চালানো সম্ভব নয়। তাই এতে ব্যবসায়ীরা উৎসাহ পাচ্ছেন না।’

এদিকে শিল্পকারখানার মতো আবাসিকেও গ্যাস সংকট তীব্র হচ্ছে। পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ না পেয়ে আবাসিক গ্রাহকরা পড়েছেন বেশি ভোগান্তিতে। সামর্থ্যবান অনেকেই পাইপলাইনের গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাস ব্যবহার করছেন। এতে জীবনযাপনের ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।

ঢাকার ভূতের গলির বাসিন্দা রেখা পারভীন বলেন, ‘ভোর থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত গ্যাস একেবারেই থাকে না। তারপর গ্যাস পাওয়া গেলেও চাপ কম থাকে। আর গভীর রাতে গ্যাসের চাপ বাড়ে। দিনের বেলায় পরিবারের খাবার তৈরি করতে এখন বিকল্প হিসেবে এলপি গ্যাস ব্যবহার করছি। এতে মাসে অতিরিক্ত দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা ব্যয় বেড়েছে। কিন্তু কিছু করার নেই।’ রাজধানীর মহাখালী, পল্লবী, কাফরুল, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০, রায়েরবাগ, গ্রিনরোড, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, মগবাজার, মালিবাগ, রামপুরা, বাসাবো, আরামবাগ, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা ও উত্তরা এলাকায় এ গ্যাস সংকটের খবর পাওয়া গেছে।

পেট্রোবাংলার দৈনিক গ্যাস উৎপাদন ও সরবরাহ তালিকা থেকে জানা গেছে, গতকাল শুক্রবার সাড়ে ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে ২ হাজার ৫৪৮ মিলিয়ন। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ২৫৯ মিলিয়ন ঘনফুট। আর ৪৯১ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে ৭২৮ মিলিয়ন ঘনফুট এবং সার উৎপাদনে ৩২৯ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা হয়েছে। বাকি গ্যাস শিল্প, আবাসিকসহ অন্যান্য খাতে সরবরাহ করা হয়।

এমন পরিস্থিতিতে দেশি গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, ‘এলএনজি আমদানি করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করার কথা বলেই দাম বাড়ানো হয়েছিল। এখন ডলার সংকটে আমদানি করতে পারছে না। তাই স্বাভাবিক গ্যাস সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। দেশে অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোরালো উদ্যোগ না নিলে গ্যাস সংকট থেকে ভোক্তারা সহজে মুক্তি পাবেন না। বরং সংকট আরও ঘনীভূত হতে পারে।’




বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top