রাশিয়া থেকে নেপোলিয়নের সৈন্যদের পিছু হটার কারণ প্রকাশ করলো বিজ্ঞানীরা

অনলাইন ডেস্ক | প্রকাশিত: ২৫ অক্টোবর ২০২৫ ২১:২৭; আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২৫ ০১:০৮

১৮১২ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের রাশিয়া আক্রমণের ফলে তার বিশাল "গ্র্যান্ড আর্মি" প্রায় ধ্বংস হয়ে যায় ক্ষুধা, শত্রুর আক্রমণ এবং নিষ্ঠুর শীতের কারণে। কিন্তু এখন, বিজ্ঞানীরা আরেকটি মারাত্মক কারণ সনাক্ত করেছেন যা ফরাসি সেনাবাহিনীকে পিছু হটতে বাধ্য করেছিল - দুটি অপ্রত্যাশিত রোগ যা আগে সন্দেহ করা হয়নি। গবেষকরা ইতিমধ্যেই বিশ্বাস করেন যে ফরাসি সেনাবাহিনীর ধ্বংসে সংক্রামক রোগ ভূমিকা পালন করেছিল এবং দীর্ঘদিন ধরে ধারণা করা হচ্ছিল যে টাইফাস এবং ট্রেঞ্চ ফিভার হাজার হাজার ফরাসি সৈন্যকে হত্যা করে। কিন্তু লিথুয়ানিয়ায় ফরাসি সৈন্যদের কঙ্কাল দিয়ে ভরা একটি গণকবরের নতুন বিশ্লেষণে বিজ্ঞানীদের সামনে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য । সম্প্রতি ১৩ জন সৈন্যের দাঁত থেকে প্রাপ্ত ব্যাকটেরিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণ করে নতুন এক গবেষণায় আরও দুটি ভয়ংকর রোগের সন্ধান মিলেছে— প্যারাটাইফয়েড জ্বর এবং রিল্যাপ্সিং ফিভার।

'কারেন্ট বায়োলজি' জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, মৃত সৈন্যদের দাঁতের মধ্যে বিজ্ঞানীরা সালমোনেলা এন্টারিকা (যা দূষিত খাদ্য ও পানির মাধ্যমে ছড়ায়) এবং বোরেলিয়া রিকারেন্টিস (যা উকুন দ্বারা বাহিত হয়) নামক অণুজীবের ডিএনএ খুঁজে পেয়েছেন। এই নতুন গবেষণাটিতে দেখা গেছে যে, আধুনিক জিন-সিকোয়েন্সিং পদ্ধতি কীভাবে আমাদের প্রাগৈতিহাসিক অভিবাসন, পূর্বপুরুষ এবং সাম্প্রতিক ইতিহাসের বড় ঘটনাগুলোকে নতুন করে বুঝতে সাহায্য করছে। নেপোলিয়ন প্রায় ৬,০০,০০০ সৈন্য নিয়ে তার রাশিয়ান অভিযান শুরু করেছিলেন, কিন্তু ৫০,০০০ এরও কম সৈন্য বেঁচে ছিলেন। ইতিহাসবিদরা সন্দেহ করেছিলেন যে মাসব্যাপী পশ্চাদপসরণকালে হিমশীতল ঠান্ডা এবং অনাহার টাইফাস ব্যাকটেরিয়া (রিকেটসিয়া প্রোওয়াজেকি) দ্বারা সৃষ্ট মহামারীতে পরিণত হয়েছিল। এটি বিভিন্ন জীবাণুর কারণে হতে পারে। সেইসঙ্গে ছিল বার্টোনেলা কুইন্টানা দ্বারা সৃষ্ট ট্রেঞ্চ ফিভার।

যখন কোনো ব্যক্তি সিস্টেমিক সংক্রমণে আক্রান্ত হয় এবং তা রক্তে প্রবেশ করে, তখন তাদের দাঁতের ভেতরের ডেন্টাল পাল্পে অণুজীবের ডিএনএ অবশেষ শনাক্ত করা যায়। গবেষক দলটি টাইফাস সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ খণ্ড খুঁজে পেয়েছিল। ইনস্টিটিউট পাস্তুরের পোস্টডক্টরাল গবেষক রেমি বার্বিয়েরি এই পুরনো নমুনাগুলোতে ফিরে গিয়ে আধুনিক কৌশল ব্যবহার করে টাইফাস সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়ার সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স করার ধারণা দেন। মাইক্রোবিয়াল প্যালিওজেনোমিক্স ইউনিটের প্রধান নিকোলাস রাস্কোভানের সাথে তিনি একটি রোগজীবাণুর বিবর্তন অধ্যয়ন করার জন্য কাজ শুরু করেন। মাত্র দুই দশক আগেও বিজ্ঞানীরা সুনির্দিষ্ট রোগজীবাণু শনাক্ত করার জন্য সেই জীবাণুর ডিএনএ খণ্ড খুঁজতেন, যেখানে তাদের পূর্বধারণা থাকত কী খুঁজতে হবে। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির বদৌলতে গবেষকরা এখন দাঁতের অভ্যন্তরে থাকা সমস্ত ডিএনএ খণ্ডাংশ সিকোয়েন্স করতে সক্ষম হয়েছেন। গবেষকরা চারটি নমুনায় সালমোনেলা এন্টারিকার একটি সংস্করণ খুঁজে পেয়েছেন, যা প্যারাটাইফয়েড জ্বরের কারণ। এই রোগে র‍্যাশ, জ্বর এবং হজম সংক্রান্ত নানা সমস্যা দেখা দেয়।

একটি নমুনায় এবং সম্ভবত দুইটিতেও তারা বোরেলিয়া রিকারেন্টিস এর প্রমাণ পেয়েছেন, যা উকুনবাহিত রিল্যাপ্সিং ফিভারের কারণ। বার্বিয়েরি বলছেন, 'আধুনিক সময়ে এই রোগগুলো সাধারণত প্রাণঘাতী নয়। কিন্তু নেপোলিয়নের সেনাবাহিনী ছিল চরম দুর্দশার মধ্যে। আমরা এমন একটি সেনাবাহিনীর কথা বলছি যারা ছিল অত্যন্ত ভঙ্গুর অবস্থায়—এমন একটি রোগজীবাণু সহজেই কারো প্রাণ কেড়ে নিতে পারত।' নেপোলিয়ানের তিন হাজারেরও বেশি মৃতদেহের মধ্যে অন্তত ১৩ জনের ক্ষেত্রে অন্যান্য রোগও বিদ্যমান ছিল বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা । বার্সেলোনার পম্পেউ ফ্যাব্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান ও বিবর্তন ইনস্টিটিউটের জিনতত্ত্ববিদ কার্লেস লালুয়েজা-ফক্স নতুন গবেষণায় জড়িত ছিলেন না, তবে তিনি ১৬৫২ সালে মারা যাওয়া স্প্যানিশ সৈন্যদের দেহাবশেষে এস. এন্টেরিকার চিহ্ন নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি সর্বশেষ গবেষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন।

লাইভ সায়েন্সকে একটি ইমেলে তিনি জানিয়েছেন - রোগজীবাণু এবং মহামারী কীভাবে অতীতের সামরিক, অভিবাসন এবং উপনিবেশ স্থাপনের প্রক্রিয়ার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তা আমাদের সামনে তুলে ধরে। ফক্স আরও বলেন যে, জীববিজ্ঞান এবং প্রত্নতত্ত্ব অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার বোঝাপড়ায় নতুন মাত্রা যোগ করছে: "মহামারী কেবল মৃত্যুহারের ক্ষেত্রেই নয় সামাজিক, রাজনৈতিক এবং এমনকি সাংস্কৃতিক দিকগুলোকেও প্রভাবিত করেছে ।"

সূত্র : ইয়া



বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস
এই বিভাগের জনপ্রিয় খবর
Top